উস্তায নু'মান আলী খানের সাথে কিছুক্ষণ - কিছু ভালো লাগার অনুভূতি

লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:৪২:৫২ সকাল



ইন্টারনেটের কল্যাণে উস্তায নু’মান আলী খানকে চেনেন না এমন শিক্ষিত মুসলিম খুব কমই আছেন বোধহয় এ সময়ে। উস্তায নু’মান আলী খানই সম্ভবত প্রথম ব্যাক্তি যিনি কোরআনের সৌন্দর্য্য, গভীরতা, পরিপূর্ণতা (perfection) ইংরেজী ভাষায় অত্যন্ত নিপুণতার সাথে তুলে ধরছেন। পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের এই নাগরিক পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের কোরআন একাডেমীতে শাইখ আব্দুস সামীর তত্ত্বধানে আরবী ও উলুমুল কোরআনের উপর শিক্ষা লাভ করেন। কোরআনিক আরবী শিখানোর জন্য তিনি ও তার কলিগ শাইখ আবদুন নাসির ঝাংদা মিলে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ‘আল বায়্যিনাহ ইন্সটিটিউট’ নামে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন যেটার জনপ্রিয়তা যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন বেড়েই চলছে। এখন তো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকেও অনেকে এখানে আরবী শিখতে আসেন। সেই নু’মান আলী খান এখন ‘Light Upon Light’ নামে একটি আরবী ভাষাশিক্ষা একাডেমীর আমন্ত্রণে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করছেন। গতকাল কুয়ালালামপুরে মসজিদ আল উইলায়াতে তাঁর একটি লেকচার ছিল সূরা আর রাহমানের উপর। মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে আন্তর্জাতিক স্পিকাররা আসেন এমন অনেক প্রোগ্রামেই ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার সুযোগ আল্লাহ করে দিয়েছেন। নু’মান আলী খানের এই প্রোগ্রামেও ভলান্টিয়ার হওয়ার অফার পেয়েছিলাম প্রথমে যেটা কিছু ব্যস্ততার অযুহাতে না করে দিয়েছিলাম। পরে আয়োজকদের ভলান্টিয়ার ঘাটতির কারণে আমার ভারতীয় বন্ধু আযহারের একপ্রকার জোরাজুরিতে রাজি হয়েছিলাম ভলান্টিয়ার হতে। আল্লাহর হাজারো শুকরিয়া যে, তিনি আমাকে শেষ পর্যন্ত সুমতি দিয়েছেন ভলান্টিয়ার হতে, যার কারণে উস্তায নু’মানকে একেবারে সামনাসামনি দেখা এবং তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমার ডিউটি ছিল মসজিদের ভেতরে usher হিসেবে। ডিউটির জায়গা ছিল প্রথম কাতারের সামনে। প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা মাগরিব নামায শেষ হওয়ার পরপর। মাগরিব নামাযের কিছুক্ষণ আগে উস্তায নু’মান যখন মিম্বারের পিছন দরজা দিয়ে নামাযের জন্য মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করেন নামায পড়ার জন্য ভাগ্যক্রমে সেখানে দিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে উস্তায নু’মান মুচকি হেসে সালাম দিয়ে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দন করার জন্য। একে তো জীবনে প্রথমবারের মত সামনাসামনি নু'মান আলী খানকে দেখছি তার ওপর তাঁর এই আন্তরিকতা, পুরো ব্যাপারটিই স্বপ্নের মত ঠেকছিল। যাই হোক, মাগরিব নামায শেষ হওয়ার পরপর উনি উনার জন্য তৈরী করা স্টেইজের সোফায় না বসে অডিয়েন্সের দিকে মুখ করে ফ্লোরেই বসলেন। ঐ সময় আমাকে সামনে পাওয়ায় বললেন তাঁকে একটি মুসহাফ এনে দেয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরে আমিও উস্তায নু’মানের কাছে গিয়ে বসলাম। উস্তায নু’মান যে এতটা বন্ধুসুলভ সেটার কোন ধারণা ছিল না গতকাল তাঁকে সামনাসামনি না দেখা পর্যন্ত। খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারেন তিনি। বসার সাথে সাথেই তিনি সামনের সারির অডিয়েন্সের সাথে আড্ডা জুড়ে দিলেন। সবার সাথে কথা বলছিলেন, মজা করছিলেন। অনেকে আবার তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিল, সেগুলোর জবাবও দিচ্ছিলেন।



একেবারে সামনে থাকায় সুযোগ হাতছাড়া না করে উস্তায নু’মানের কাছে দুটো প্রশ্ন করলাম। প্রথম প্রশ্নটি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বায়্যিনাহর শাখা খোলার কোন পরিকল্পনা তাঁর আছে কিনা। তিনি বললেন, পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে। কিন্তু একটু সময় লাগবে। কারণ তিনি অপরিপক্কভাবে কোন কাজ শুরু করতে চান না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল ড. ইসরার আহমেদের (রাহিমাহুল্লাহ) গ্র্যান্ডপ্ল্যান নিয়ে। ড. ইসরার আহমেদের ইন্তেকালের কয়েকদিন পরে উস্তায নুমান আলী খান ড. ইসরার আহমেদের এক শ্রদ্ধাঞ্জলী (tribute) প্রোগ্রামে লেকচার দিয়েছিলেন। ইউটিউবে দেখা এ লেকচারে উস্তায নু’মান আলী খান থেকেই ড. ইসরার আহমেদের এই গ্র্যান্ডপ্ল্যান সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম। উস্তায নু’মান আলী খান নিজেও ড. ইসরার আহমেদের ছাত্র ছিলেন। ড. ইসরার আহমেদের পরিকল্পনা ছিল তাঁর ছাত্রদের মধ্য থেকে যারা কোরআনের উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারবে, তাদেরকে সোশ্যাল সাইন্সের বিভিন্ন সাবজেক্টগুলোর (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, দর্শন, অর্থনীতি ইত্যাদি) উপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য পাশ্চাত্যে পাঠানো। যাতে তারা কোরআনের আলোকে সোশ্যাল সাইন্সের একটি নতুন প্যারাডাইম দাঁড় করাতে পারে। সোশ্যাল সাইন্সের ছাত্ররাই মূলত তাদের নতুন নতুন আইডিয়ার মাধ্যমে সমাজের চিন্তাধারাকে সুনির্দিষ্ট রূপ দান করে যেখানে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তাররা মূলত সমাজের সেবক হিসেবেই কাজ করে থাকেন। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের উপমহাদেশের পিতামাতাদের মধ্যে সন্তানকে হয় ডাক্তার নইলে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর এক ধরনের শক্ত প্রবণতা দেখা যায়। উস্তায নু'মানকে জিজ্ঞেস করলাম, ড. ইসরার আহমেদের এই প্ল্যান নিয়ে তাঁর কোন চিন্তাভাবনা আছে কিনা। বললেন, কিছুটা সংশোধনীসহ ড ইসরার আহমেদের এই প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য কাজ করার চিন্তা আছে তাঁর। আর 'বায়্যিনাহ' দিয়েই এটার শুরু। এরপর শিডিউল অনুযায়ী প্রোগ্রাম শুরু হল।



প্রথমে মসজিদ উইলায়াত এবং ‘Light upon Light’ একাডেমীর ইন্ট্রোডাক্টরী ভিডিও দেখানো হল এরপর শাইখ দাউদ বাট্ট উস্তায নু’মান আলী খানকে পরিচয় করিয়ে দিলেন অডিয়েন্সের কাছে। এরপর উস্তায নু’মান তাঁ বক্তব্য শুরু করলেন। মাত্র দুঘন্টায় পুরো আর রাহমানের উপর লেকচার দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না তা বলে দিলেন। কারণ তাহলে সারা রাতেও শেষ করা সম্ভব না। কেবল প্রথম তিন আয়াত নিয়েই কথা বলবেন বলে জানালেন। প্রথমেই সূরা আর রাহমানের ইন্ট্রোডাকশন দিলেন। এরপর কেবলমাত্র সূরার প্রথম তিন আয়াতের উপরই দুঘন্টার বক্তব্য রাখলেন। সুবহানাল্লাহ! উনি প্রথম আয়াত “الرحمن” এরই যে ব্যাখ্যা দিলেন এরপর শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ যদি সূরা আর রাহমান পড়ে শুধুমাত্র প্রথম আয়াত পড়ার সময়ই অন্যরকম একটা অনুভূতি পেতে সে বাধ্য। মাঝখানে এশার আযানের জন্য ৫ মিনিটের বিরতিসহ দুঘন্টার পুরো লেকচারটাই ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর, আবেগময় এবং যথারীতি তথ্যপূর্ণ। অবশ্য উনার স্বভাবসুলভ সেন্স অফ হিউমার প্রয়োগ করে পুরো অডিয়েন্সকে হাসাতেও ভুলেন নি। এরপর লেকচার শেষে আমরা এশার নামায পড়লাম। নামায শেষে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে না গিয়ে পুরুষদের সারির মধ্য দিয়ে মসজিদের একেবারে পিছনে চলে গেলেন বোনদের সারির কাছে, তাদেরকে প্রশ্নোত্তরের জন্য ৩০ মিনিট সময় দিতে। গোলাকার এ পৃথিবীর ঠিক অন্য প্রান্ত থেকে আসা একজন দায়ীর জন্য মসজিদে উপস্থিত মুসলিমদের ভালোবাসা উপচে পড়ছিল। আমরা usher রা চেইন গঠন করে ভীড় ঠেলে তাঁকে নিয়ে গেলাম বোনদের সারির কাছে। মানুষ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল তাঁর সাথে করমর্দন করার জন্য। তিনি কোনপ্রকার বিরক্তি ছাড়াই হাসিমুখে সবার সাথে করমর্দন করলেন। অনেকে তো আমাদের চেইন ভেঙ্গে ঢুকে উনাকে জড়িয়েও ধরলেন। তাদের সাথেও হাসিমুখে কোলাকুলি করলেন। এরপর বোনদের প্রশ্নোত্তর শেষে মসজিদের ইমাম এবং ভি আই পিদের সাথে ডিনার করার জন্য ভেতরে ঢুকলেন। ডিনার শেষে আমাদের ভলান্টিয়ারদের পরিদর্শন করলেন। সবার টেবিলে গিয়ে ৫-১০ মিনিট সময় দিলেন। সবার সাথে কথা বললেন। এরপর বোনদের টেবিলে গিয়েও আলাদা সময় দিলেন। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ফিরে আসার পাল। তিন বন্ধুর (একজন ভারতীয়, একজন মালদ্বীপ, আরেকজন শ্রীলংকার) সাথে ক্যাম্পাসে ফিরে আসলাম দুঘন্টার কিছু অসাধারণ স্মৃতি আর কিছু ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে। সামনাসামনি কথা বলা তো দূরের কথা তা উস্তায নু’মান আলী খানের সাথে করমর্দন করাটাও আমার স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমার এ স্বপ্ন পূরণ করে দিলেন। নিরহংকারিতা, উম্মাহর প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞান, বাগ্মিতা এককথায় আল্লাহর পথের একজন দা’য়ীর মধ্যে যেসব গুণ থাকার দরকার তার সবকিছুর সমাবেশ দেখতে পেলাম উস্তায নু’মান আলী খানের মধ্যে। আল্লাহ তাঁর কাজগুলোকে কবুল করে নিন এবং উম্মাহকে তাঁর থেকে আরো খিদমত পাওয়ার সুযোগ দান করুন এটাই প্রার্থনা রইল।

বিষয়: বিবিধ

৩৪২৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File