আনন্দাশ্রু (ছোটগল্প)

লিখেছেন লিখেছেন হাসান কবীর ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:৫১:০০ দুপুর

পাঁচ বছরের চঞ্চলা সীমা হঠাৎই নীরব হয়ে গেছে। আগের মত ওর মুখে হাসি নেই, কথার খৈ ফুটাতো দুরের কথা প্রয়োজনীয় কথাও যেন আর ফুটে না। খেলার সাথীরা সবাই আগের মতই খেলায় যোগ দেয়, যাবার বেলায় ওকে ডাকে, কিন্তু ওর সাড়া নেই। কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে মেয়েটি।

ক’দিন পরেই ঈদুল আযহা। সাধারণত লোকেরা একে কোরবানীর ঈদ বা বকরী ঈদ বলে ডাকে। ঈদকে ঘিরে সব শিশুদের মত সীমার মনেও আনন্দ বাসা বেঁেধছিল। খেলার সাথীরা সবাই মিলে বলাবলি করতো আমার বাবা এত্তো বড় গরু আনবে, আমার বাবা তোর বাবার চাইতে বড় গরু আনবে, আমার বাবা মহিষ আনবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সীমাও বলত- আমার বাবা ঢাকা থেকে আসার সময় সবার চেয়ে বড় গরু আনবে। আমার জন্য সুন্দর সুন্দর খেলনা আর জামা কাপড়ও আনবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঈদ ঘনিয়ে এসেছে। সোমবারে ঈদ হবে। সরকারি চাকুরীজীবীগণ এবার ঈদের আগে পুরো তিন দিন ছুটি পেয়েছেন। সবাই বাড়ি ফিরছে। তবে জনসাধারণের কথা বিবেচনা করে শুক্র ও শনি এ দুদিন ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সীমার বাবা শফিক মিয়া বেসরকারি একটি বীমা কোম্পানীতে অল্প বেতনে ছোট একটি পোস্টে চাকুরি করেন। যে টাকা মাইনে পান তাতে মাসের সাধারণ খরচাদি সারতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। সঞ্চয়েরতো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া হাতঘষা স্বভাব তার কোন কালেই ছিল না। থাকলে পরের পকেট কেটে তিনি নিজের পকেট ভারী করতে পারতেন সহজেই। মেধাবী ছাত্র ছিলেন, নীতি বিসর্জন দিলে ভাল একটা সরকারি চাকুরিতে ঢুকতে পারতেন। ওরকম প্রস্তাব পেয়েছেন কয়েকবার, কিন্তু নীতির ব্যাপারে কঠিন হওয়ায় সাড়া দেননি।

এ মাসের মাইনের উপর কিছু টাকা ঈদ বোনাস পেয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে কোরবানী দেবার মত তার সামর্থ নেই। তাই বাড়ি যাবারও এত তাড়া নেই। মেয়ের জন্য কিছু খেলনা, আর স্ত্রীর জন্য কিছু কেনা কাটা করে বাড়ি ফিরবেন বলে মনস্থির করেছেন। সিদ্ধান্ত মত পরের দিন শুক্রবার জুম্মার নামায পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।

শুক্রবার সকাল হতেই সীমার মন খারাপ। তার খেলার সাথী জেসমিনের বাবাও ঢাকায় চাকরি করেন। তিনি ফিরে এসেছেন। সাথে দামী দামী অনেক খেলনা আর কাপড়-চোপড় এনেছেন জেসমিনের জন্য। জেসমিন এক সেট নতুন কাপড় পরে এসে সীমাকে দর্শন দিয়ে বলে গেছে- দেখেছিস, আমার বাবা আমার জন্য কত্তো সুন্দর জামা এনেছে। বাবা একটু পরে শিমুলকান্দির হাটে গরু কিনতে যাবে। তুই না বলেছিলি তোর বাবা তোর জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর খেলনা আনবে, কই, দেখি তোর খেলনা?

সাথে সাথে সীমার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কারণ ওর বাবা এখনো ফিরেনি। সে কোত্থেকে জেসমিনকে খেলনা দেখাবে? জেসমিনের মুখ ভেংচি সহ্য করে ঘরে চলে গেছে। শুধু জেসমিন নয়, সকাল হতে আরো কয়েক জনের নতুন পোশাক এবং মুখ ভেংচি তার মনে বেদনা দিয়েছে। তাই সে আজ আর খেলার আসরে যায়নি। কারণ ওর আজ গল্প করার অবলম্বন নেই। মোটামুটি সবার বাবাই ফিরে এসেছে, আসেনি কেবল ওর বাবাই।

ঘরে গিয়ে মাকে বলল- মা, বাবা কখন আসবে?

ঃ আসবে মা, আসবে।

ঃ বাবা আসে না কেন? সবার বাবাইতো সুন্দর সুন্দর জামা আর খেলনা নিয়ে ফিরে এসেছেন। আমার বাবা কখন আসবে?

ঃ তোমার বাবাও তোমার জন্য অনেক খেলনা আর সুন্দর সুন্দর জামা নিয়ে আসবেন। তুমি কোন চিন্তা করো না খেলতে যাও।

ঃ না, বাবা না এলে আমি খেলতে যাবো না। বাবা এলে আমি নতুন জামা পরে খেলনা নিয়ে খেলতে যাবো। বাবা কখন আসবে বলো না।

ঃ এইতো মা, তোমার বাবা আজকেই চলে আসবেন। দেখো, ঠিক আজকেই আসবেন। তুমি খেলতে না গেলে পড়ার টেবিলে বসে তোমার বাবার জন্য খুব সুন্দর করে একটি ছবি আঁকো গিয়ে। তোমার বাবা তোমাকে অনেক সুন্দর জামা দেবেন, খেলনা দেবেন, তুমিও তোমার বাবাকে সুন্দর একটা ছবি দেবে। দেখবে তোমার বাবা অনেক খুশি হবেন।

সীমা আর কথা না বাড়িয়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বাবার জন্য ছবি আঁকতে বসে গেল। মনোযোগ দিয়ে বাবার জন্য ছবি আঁকছে। আর মনে মনে কল্পনা করছে- বাবা আমার জন্য কত্তো সুন্দর সুন্দর খেলনা আনবেন, জামা আনবেন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। এশার নামাযের কিছুক্ষণ আগে সীমার বাবা বাড়ি ফিরে এলেন সীমার জন্যে অনেক জামা কাপড় আর খেলনা নিয়ে। দেখে খুশিতে সীমার মন প্রজাপতির মত উড়াউড়ি শুরু করলো। সীমাও বাবাকে তার আঁকা নদী-নালা সম্বলিত একটি সবুজ গাঁয়ের ছবি উপহার দিল। মেয়ের উপহার পেয়ে শফিক মিয়াও দারুণ খুশি। বাবা মেয়ের খুশি দেখে সীমার মা রহিমা বেগমের চোখ ফেটে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে সীমা বাবাকে ঘরে পায়নি। ভেবেছে বাবা হয়তো গরু কিনতে হাটে গেছে। সে নাস্তা সেরে নতুন জামা পরে খেলায় যোগ দিতে গেল। সন্ধ্যার পর বাবার সাথে গল্প করতে করতে গরুর কথা ভুলে গেল সীমা। পরের দিন রবিবার একই ঘটনা ঘটল। কিন্তু গোধূলীলগ্নে খেলার আসর থেকে ফিরে যখন দেখল বাড়িতে গরু নেই, পাশের বাড়িতে কোরবানীর গরু হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে, তখন সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো- বাবা আমাদের গরু কোথায়?

শফিক সাহেব মূলত কোরবানী দিতে পারবেন না এ ব্যাপারটি যেন মেয়েকে না বলতে হয় সে জন্যেই মেয়েকে এড়িয়ে চলছিলেন। কিন্তু এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। উত্তর না দিয়ে উপায় নেই। তিনি বললেন- দেখ মামনি, আমরা এ বছর গরু কিনতে পারিনি। আল্লাহ্‌ চাহেতু আমরা আগামীতে গরু কিনে কোরবানী দেবো।

আজ ঈদের দিন। সীমার মনে কোন আনন্দ নেই। মনটা কেমন ছোট হয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। কাউকে কিছু বলছে না। নতুন জামা কাপড়ে তার কোন আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই খেলার সাথীদের সাথে দেখা করার, গল্প করার। শুধু গোছল করে বাবা-মাকে সালাম করে গিয়ে চুপটি মেরে ঘরে বসে রয়েছে। মেয়ের বিষয়টা শফিক মিয়া ও রহিমা বেগম দুজনেই আঁচ করতে পেরেছেন। বিধায় তাদের মনটাও ছোট হয়ে গেছে। একটি মাত্র মেয়ে, আজ ঈদের দিনে তার মনে আনন্দ নেই। অথচ কোরবানীর উদ্দেশ্য কী সে জানে না, জানে না কেন কোরবানী দেয়া হয়। শুধু জানে তারা কোরবানী দিতে পারছে না। কোরবাণী দিতে না পারায় আজ ঈদের দিনে বেদনায় ভারাক্রান্ত তিনটি প্রাণ।

কিছু লোক পেটে ক্ষুধা নিয়েও বসে থাকে। পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কারো কাছে লজ্জায় হাত পাতে না। শফিক মিয়া এমন শ্রেণির লোক। নিজে কোরবানী দিচ্ছে না, কারো বাড়িতে গরু কাটতেও যাবে না লজ্জায়। গরু কাটলে মাংস দেবে এমন ভুলে ভরা সমাজে তার বাস। মেয়েটি কেমন চুপটি মেরে আছে। সব বুঝেও শফিক মিয়া ঘরে খিল দিয়ে বসে আসে স্ত্রী কন্যা নিয়ে।

সকাল বেলা রান্না করা মিঠাই আর মাছ তরকারি সাদা ভাতে তাদের সারাটি দিন গত হয়েছে। পাশের বাড়িগুলোতে গরু জবাই হয়েছে, রান্না হয়েছে। অথচ কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। সীমার মন এখনো বিষন্ন। যেন দিগন্ত জোড়া মেঘমালা এসে ভীড়েছে ওর চেহারায়। ওর অবস্থা দেখে শফিক মিয়া ও রহিমা বেগমের কোরবানী দিতে না পারার যন্ত্রণা হাজার গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাশের গাঁয়ে শফিক মিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী এমদাদ মিয়ার বাস। সন্ধ্যার পর তার হঠাৎ মনে পড়ে তার বন্ধু শফিক মিয়ার সাথে রেলস্টেশনে কথা হয়েছিল। কথায় কথায় জেনেছিল এবার সে কোরবানী দিতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজ থেকে এক পুটলা গোস্ত নিয়ে এসে হাজির হয় শফিক মিয়ার বাড়িতে। গোস্ত দেখে আনন্দে নেচে উঠে সীমার শিশু মন। মূহুর্তেই সকালের রোদের মত ঝলমলিয়ে উঠে তার চেহারা। সীমার হাসিমাখা মুখ দেখে সবার চোখে গড়িয়ে পড়ে আনন্দাশ্রু।

বিষয়: বিবিধ

১২০৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

290974
০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৫
তোমার হৃদয় জুড়ে আমি লিখেছেন : পড়ে কষ্টের মাঝে আনন্দ পেলাম। আমরা সবাই যদি এমদাদ মিয়ার মত হতে পারতাম। খুব সুন্দর লিখেছেন। ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File