ইতিহাসের আলোকে ভাষা আন্দোলন

লিখেছেন লিখেছেন আবু নিশাত ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৭:০৮:৫৪ সন্ধ্যা

পত্রিকা হাতে নিয়ে একজন প্রফেসর সাহেব বললেন, ভাষা আন্দোলনে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী নাকি সমর্থন করেছিলেন ! তার আশ্চর্য্যভাব দেখে আমি বললাম, কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী নয় বরং অধিকাংশ পাকিস্তানি শেষদিকে ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন । আমার কথা শুনে প্রফেসর সাহেবের আশ্চর্য্যরে মাত্রা আরও বেড়ে গেল । তিনি মুখ হা করে তাকিয়ে থাকলেন । আমি বুঝলাম আমার উত্তরটি একটু ব্যাখ্যা করে দেয়া দরকার, কারণ ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের যে দূরাবস্তা, তাতে প্রফেসর সাহেবকে ব্যাখ্যা না করলে, তিনি মনে মনে আমাকে রাজাকার ভাববেন । বললাম, অধিকাংশ পাকিস্তানী ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন, তবে তারা ভাষাগত দিক হতে ছিলেন বাঙ্গালী । এবার আরও বিপদে পড়লাম, প্রফেসর সাহেব বললেন, বাঙ্গালী কিভাবে পাকিস্তানী হয় ? এবার বললাম, পাকিস্তানী শব্দটি ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের সাথে সম্পর্কিত । ১৯৪৭ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রের নাম পাকিস্তান থাকার কারণে আমরা ভৌগলিক দিক হতে পাকিস্তানী ছিলাম এবং ভাষার দিক হতে বাঙ্গালী এবং বর্তমানে ভৌগলিক দিক হতে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত ।

৪৭ এ ভারত বিভাগের পূর্বেই ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় । তবে এ বিতর্ক ছিল লেখনীর মাধ্যমে, পত্রিকায় বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে, সরাসরি কোন আন্দোলনের মাধ্যমে নয় । কারণ তখন আন্দোলনের মূখ্য বিষয় ছিল ভারত এক থাকবে না বিভক্ত হবে । সে সময় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন । আর উপমহাদেশের মুসলমানরা হিন্দীর বিপরীতে উর্দুকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাইলেন । উর্দু ভাষার প্রচলন মুসলমানদের হাতে হয়েছিল বলে শিক্ষিত মুসলমানদের ঝোঁক ছিল উর্দুর প্রতি । আবার হিন্দী ভাষায় সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য থাকায় হিন্দুদের নিকট এ ভাষার কদর ছিল বেশি । মূলত সে সময় সারা ভারতে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস উর্দু ও হিন্দীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল । উর্দু ও হিন্দীর পাশাপাশি বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা, এ নিয়ে তেমন কোন আলোচনা ছিল না । তবে মাওলানা আকরম খাঁ এর ‘আযাদ’ পত্রিকায় ‘বাংলাকে’ সারা ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছিল ।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম সমস্যা দেখা দেয় ভাষা নিয়ে । সমস্যাটি হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে ? ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন । তার এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেন, গণপরিষদ সদস্য (পূর্ব বাংলা হতে নির্বাচিত) প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টপাধ্যায় । অন্যদিকে বাঙ্গালী গণপরিষদ সদস্য তমিজুদ্দিন খানের (১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে স্পিকার ছিলেন) নেতৃত্বে পরিষদের সকল মুসলমান সদস্য (পূর্ব বাংলার সদস্যরাও) ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন । তখনকার সময়ে কংগ্রেস শাসিত বৈরী দেশ ভারতে হিন্দি এবং ইংরেজিকে তাদের রাষ্ট্রভাষা (সরকারি ভাষা) করা হয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান পশ্চিম বাংলায় ‘বাংলা’ ভারতের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না পাওয়ার কারণে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি । সেখানে ভারতীয় আইন পরিষদে কোন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টপাধ্যায় খুঁজে পাওয়া গেল না, বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেয়ার দাবী করার জন্য । অথচ বাংলা সাহিত্যের গদ্য, উপন্যাস, কবিতা, গান ইত্যাদির বিকাশ সাধনে পশ্চিম বাংলার কবি সাহিত্যিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীরা ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশের পরিবর্তে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিলীন হওয়াটাকে পছন্দ করলেন । তাই ‘বাংলা’ ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না । ভারতের মত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারও উর্দু এবং ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষার করার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ছাত্র-শিক্ষকরা মেনে নিতে পারেননি । তাদের আচরণ হলো সম্পূর্ণরূপে পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবিদের বিপরীত । তারা বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে চাইলেন । এখানে একটি মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিম বাংলার বাংগালীরা পূর্ব বাংলার লোকদের বাংগালী হিসেবে মানতে চান না । তাদের সাহিত্যে দেখা য়ায়, লেখা থাকে, “একজন বাংগালী এবং একজন মুসলমান এসেছে ।” অর্থাৎ পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালিরা ‘বাঙ্গালী’ নয় বরং বিদেশী বা বহিরাগত হিসেবে চিনেন । ভাষা আন্দোলন পশ্চিম বাংলায় হলো না, কিন্তু পূর্ব বাংলায় হলো, বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরা (পশ্চিম বাংলার) যে আন্দোলন করলেন না, সেই আন্দোলন বরং বাঙ্গালী মুসলিম বুদ্ধজীবিরা (পূর্ব বাংলার) কেন করলেন, তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে ।

রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষার মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান, তা পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী হিন্দু বুদ্ধিজীবিরা বুঝতে সক্ষম হলেও পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের একটি বড় অংশ বুঝতে সক্ষম হননি । যদি প্রদেশের ভাষা নিজ ভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষা হত, তবে সে প্রদেশের জনগণ একসময় তার নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলত । ভারত এবং বর্তমান পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা যথাক্রমে হিন্দী ও উর্দু হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে নিজ মাতৃভাষা চালু থাকার কারণে কোন প্রদেশে মাতৃভাষা হারিয়ে যায়নি । এ কারণেই পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরা সরকারি ভাষা হিন্দী ও ইংরেজি এর বিরোধীতা করেননি, যেহেতু বাংলা হলো তাদের প্রাদেশিক ভাষা । তারা মনে করেছিলেন সরকারি ভাষা হিন্দী বা ইংরেজি ভারতের বহু ভাষাভাষীদের মধ্যে একতা স্থাপন করবে, যা তাদের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে । কিন্তু ১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল পূর্ব বাংলা প্রদেশের সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাংলা পাশ হওয়ার পরও পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী মুসলিম বুদ্ধিজীবিরা বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন চালিয়ে যান । এ সমস্ত বাঙ্গালী মুসলিম বুদ্ধিজীবিরা যেমন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল গফুর, অলি আহাদ, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, শাহেদ আলী প্রমুখ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কট্টর ভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু তাদের এ আন্দোলন বলে দেয়, উনারা দূরদর্শী সম্পন্ন ছিলেন না । তাই পরবর্তীতে উনাদের আন্দোলনকে উনাদের বিপরীত বিশ্বাসের লোকেরা নিজেদের মত করে ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে সক্ষম হয়েছেন ।

এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করল না, কিন্তু উর্দুকে করল ? এক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের যুক্তি হলো, উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা ছিল না (একইভাবে ভারতের অধিকাংশ প্রদেশের ভাষা হিন্দী নয়) । যেমন পান্জাবের ভাষা হচ্ছে পান্জাবি, সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু, বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচ, সিন্ধু প্রদেশের ভাষা সিন্ধি এবং পূর্ব বাংলার ভাষা হচ্ছে বাংলা । এখানে জেনে রাখাটা ভাল হবে যে, হিন্দী ও উর্দু হলো ‘খাড়িবুলি’ ভাষার দুটি রূপ । ‘খাড়িবুলি’ ভাষায় সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য দিয়ে হিন্দী ভাষার উৎপত্তি ঘটে, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীর (হিন্দু) নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায় । অন্যদিকে দিল্লীর সালতানাত এবং মোগল আমলে ‘খাড়িবুলি’ ভাষায় তুর্কি, ফার্সী এবং আরবী শব্দের আধিক্যের মাধ্যমে উর্দু ভাষার বিকাশ হয়, যা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য ভাষায় পরিণত হয় । বৃটিশ আমল হতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা বৃটিশ বিরোধী হওয়ার কারণে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করে নিজস্ব তৈরী করা মাদ্রাসায় যে শিক্ষা গ্রহণ করত, তার ভাষা ছিল উর্দু এবং ফার্সী । এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসায় উর্দু ভাষার চর্চা আছে । যেহেতু উর্দু কোন অঞ্চলের ভাষা ছিল না এবং এটি ছিল শিক্ষিত মুসলমানদের ভাষা, (ঢাকার নবাব পরিবার যাদের অবদানে নিজ জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের ভাষা ছিল উর্দু) সেহেতু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যাতে কোন অঞ্চল দাবী করতে না পারে অমুক অঞ্চলের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে । এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষা উর্দু ছিল না ।

১৯৪৮ সালে রেসকোর্সের ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে বলে ছিলেন “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কোন অঞ্চলের ভাষা হওয়া উচিত হবে না । তাই উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা । কিন্তু প্রদেশের ভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করবে ঐ প্রদেশের জনগণ ।” ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ হতে ৭৫” বইয়ে জনাব জিন্নাহর পুরো ভাষণটি দেয়া আছে । কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে, সে জন্য বলা হয়েছিল প্রদেশের ভাষা কী হবে তা প্রাদেশিক পরিষদ নির্ধারণ করবে । ফলে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল প্রদেশের সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাংলা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ।

অন্যদিকে যারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা চেয়েছিলেন, তাদের দাবী ছিল পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের ভাষা ছিল ‘বাংলা’ । পাকিস্তানের অন্য অংশ কেন তাদের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চায়নি, এটি তাদের ব্যাপার । কিন্তু পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ তাদের মাতৃভাষা ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চায় । পূর্ব পাকিস্তানের মত পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষার ব্যাপারে কোন আন্দোলন গড়ে উঠেনি । এখানে একটি বিষয় অবশ্যই বলতে হবে, তখনকার সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকারী ছাত্র-শিক্ষকরা উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হবে, এর বিপক্ষে ছিলেন না। উনাদের দাবী ছিল, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও যেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয় । এ ব্যাপারে ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক জনাব অলি আহাদ, তার বইতে লিখেছেন, ২১ শে ফেব্রুয়ারির পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যে মিছিল হয়েছিল, সে মিছিলের শ্লোগান ছিল-

“নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই

উর্দু-বাংলায় বিরোধ নেই

খুনী নূরুল আমীনের বিচার চাই

খুনের বদলা খুন চাই ।”

(জাতীয় রাজনীতি, ১৪৩ পৃষ্ঠা)

উপরের এই শ্লোগান স্পষ্ট বলে দেয়, বিভোক্ষকারীদের আক্রোশ ছিল পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের মূখ্যমন্ত্রি নুরুল আমীন এর উপর, উর্দুর উপর কোন আক্রোশ ছিল না । এটা ঠিক যে, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির পর নুরুল আমিন বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবি এবং ছাত্রদের নিকট ভিলেন হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব ছিলেন । এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচন যেখানে অওয়ামিলীগের জয়জয়কার ছিল, সেখানে নুরুল আমিন তার আসনে নির্বাচিত হন ।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যারা দেখতে চেয়েছিলেন এবং ঐ সময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন তমুদ্দিন মজলিষের প্রতিষ্ঠাতা জনাব প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম । প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমসহ ৩৪ জন ভাষা সৈনিক এবং ২ জন শহীদের আত্মীয়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে মোস্তাফা কামালের “ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন ” যা ১৯৮৭ সালের ফেব্রুযারি মাসে প্রকাশ পায় । তাই ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আমরা আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার হতে জানার চেষ্টা করব । এখানে সরাসরি আন্দোলনকারীদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে । তাই আশাকরি এখনে কোন ইতিহাস বিকৃতি ঘটবে না এবং সত্যিকারের ইতিহাস পাওয়া যাবে । এক্ষেত্রে বই এর যে পৃষ্ঠা নাম্বার দেয়া হয়েছে , তা ১৯৮৭ সালের বই এর ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে।

প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ১৯২০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার ছেবন্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ভাষা আন্দোলনের মূল নেতা এবং অগ্রপথিক ছিলেন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম । এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই । তিনি ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । আবুল কাসেম সাক্ষাৎকারে যা বলেন, তার সারসংক্ষেপ হলো-

“ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ‘তমদ্দুন মজলিসের’ মাধ্যমে । ১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসের পর পরই ১লা সেপ্টেম্বরে আমারই উদ্যোগে এবং প্রচেষ্টায় ১৯ নম্বর আজিমপূরে ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ নামে এ বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে । আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ১৯ নম্বর আজিমপূরে থাকি । বাংলাকে রষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার কথা আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি । ---তমদ্দুন মজলিসের প্রাথমিক কর্মসূচী ছিল ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে সাহিত্য সভা এবং সেমিনার অনুষ্ঠান । এ সব সাহিত্য সভা ও সেমিনারে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীর প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবি, সাহিত্যিক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করতেন । ---- ১৫ সেপ্টেম্বর আমার চেষ্টায় ও সম্পাদনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী সম্বলিত প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ?’ তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক বংশালের বলিয়াদী প্রিন্টিং প্রেস হতে মুদ্রিত ও ১৯ আজিমপূর হতে প্রকাশিত হয় । এই বইয়ের লেখক ছিলাম আমরা ৩ জন - অধ্যাপক মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আমি নিজে । বইটির মুখবন্ধে আমার যে প্রস্তাবটি সন্নিবেশিত হয়, তাতে বলা হয় -

(১) বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা, অফিসাদির ভাষা ।

(২) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি - বাংলা ও উর্দু ।

(৩) পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তপ্রাদেশিক ভাষা । ইংরেজি হবে পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা ।

------ এ বইটি কেনার ৫ জন লোকও প্রথমে ক্যাম্পাসে পাওয়া যায়নি । মজলিসের কর্মীদের সঙ্গে করে বইটি নিয়ে অনেক জায়গায় ছুটে গিয়েছি কিন্তু দু’এক জায়গা ছাড়া প্রায় সব জায়গা হতেই নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছি । পাকিস্তান লাভের সফলতা তখন সারা জাতিকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে । ----- ক্যাম্পাসের তখনকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র ‘মুসলিম হল ’ এবং ‘ফজলুল হক হলেও’ আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে বৈঠক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি । ------ তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় । -----রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর পরই আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব ফজলুর রহমান এর সঙ্গে নাজিরা বাজার মাওলা সাহেবের বাসায় সাক্ষাৎ করি । তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে তুমুল বিতর্ক হয় । ------- কয়েক সপ্তাহের চেষ্টায় কয়েক হাজার দস্তখত সংগ্রহ করা হয় । এই মেমোরেন্ডাম আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের নিকট পেশ করি । পূর্ব পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বাংলাভাষী মন্ত্রীরাও এ স্মারকলিপির প্রস্তাব সমর্থন করেন । ------ করাচীর শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত উর্দুর স্বপক্ষে গৃহীত প্রস্তাব পত্রিকায় দেখার পর ক্যাম্পাসে এবং সচেতন বুদ্ধিজীবি মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি করে । শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় । রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে এটাই প্রথম প্রতিবাদ সভা । ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, ইনসাফ, জিন্দেগী ও দেশের দাবী পত্রিকার প্রতিনিধি নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণ ও পুনর্গঠন করা হয় । ৭ই মার্চের বৈঠক অনুযায়ী ১১ই মার্চ ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট ও প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের কর্মসূচী দেয়া হয় । ------১১ই মার্চের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রভাষার দাবী নতুন গতি লাভ করে । ------আন্দোলন এভাবে দানা বেঁধে উঠার সাথে সাথে একে গোড়াতেই পন্ডু করে দিয়ে এর মাধ্যমে স্বার্থোদ্ধারের চেষ্টা চলতে থাকে । ------ভাষা আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে ‘মন্ত্রিত্ব সংকট আন্দোলনে’ পরিণত করার জন্য এরা উঠে-পড়ে লাগেন । এ সময়ে বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে মোহাম্মদ আলী সাহেব, তোফাজ্জল আলী সাহেব ও নছরুল্লাহ সাহেব প্রমুখ এম এল এ (সংসদ সদস্য) বাংলা-ভক্ত হয়ে ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হতে চেষ্টা করেন এবং নাজিমুদ্দিন সাহেবকে (প্রধানমন্ত্রি) জনপ্রিয়তা দেখিয়ে আন্দোলনকে থামাবার শক্তি রাখেন বুঝিয়ে মন্ত্রিত্ব পাবার তদবীর করতে থাকেন । তৃতীয় আরও একটি দল ছাত্র ফেডারেশন (বামপন্থি ছাত্র সংগঠন) , গোপনে পাকিস্তান বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক কয়েকটি হ্যান্ডবিল ও পোস্টার দিয়ে জনগণকে আন্দোলন বিরোধী করে তোলে । জনসাধারণ তখন সন্দেহ করতে থাকে , এ আন্দোলন নিশ্চয়ই ভারতের প্ররোচিত । -------সত্য কথা বলতে কি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র ও কর্মীদের এত চেষ্টা সত্বেও জনসাধারণ এ আন্দোলনের বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকে । ------ ঢাকার জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনের ফলে খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে । তারা ভাষা আন্দোলনকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে । মজলিস কর্মীদের ও ছাত্রদের তখন শহরে প্রবেশ একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। -------এদিকে উর্দু সমর্থক আন্দোলন গড়ে উঠে । স্বনামখ্যাত মৌলানা দীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় এবং মফস্বলের বহু স্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা হয় । এরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মেমোরেন্ডাম পেশ করেন । ------এত বিপত্তি সত্বেও আন্দোলন চলতে থাকে । --মফস্বলের নোয়াখালী ও যশোহরে সফলভাবে হরতাল ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয় । রাজশাহীতে ছাত্ররা দুটি দলে বিভক্ত হয় । দলাদলিকে ভিত্তি করে কলেজ কর্তৃপক্ষ বাংলা ভাষা সমর্থকদের উপর দারুণ নির্যাতন চালায় । চট্টগ্রামে আমরা যে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলাম তারা কোন কাজ করার সুযোগ পায়নি । সিলেটে গোবিন্দ পার্কে স্থানীয় লোকেরা হামলা করে মিটিং এর উদ্যোক্তাদের দারুণভাবে প্রহার করে এবং মাইকটি ভেঙ্গে ফেলে । অন্যান্য স্থানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । কিন্তু কোথাও সামগ্রীকভাবে জনসাধারণের তেমন সক্রিয় সমর্থন মেলেনি । ------ইতিমধ্যে খবর আসে কায়দে আজম ঢাকা সফরে আসবেন । -----১৯শে মার্চ (১৯৪৮) কায়দে আজম ঢাকা সফরে আসেন । রেসকোর্সের ময়দানে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশে বক্তৃতায় পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা এখানকার জনসাধারণ ঠিক করবে বলে মন্তব্য করেন । কিন্তু কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, তা জোরের সাথে বলেন । রেসকোর্সের এ সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আহ্বান জানিয়ে মজলিসের পক্ষে একটি ইশতেহার বিলি করা হয় । এ সময়ে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমরা কায়দে আজমের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । -----এরপর এসেম্বলির (সংসদ) অধিবেশনে নাজিমুদ্দিন সাহেব সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির অন্যতম দাবী অনুযায়ী এক প্রস্তাব পেশ করেন । এতে বাংলাকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব করা হয় । সকলে এ প্রস্তাব সমর্থন করার পর সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয় । ------এর পর ৪৮ সাল হতে ৫২ পর্যন্ত ভাষা নিয়ে আর ব্যাপক কোন আন্দোলন সৃষ্টি করা যায়নি । ৪৮ এর এসেম্বলিতে বাংলাকে এখানকার সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম স্বীকৃতি দেয়ায় কর্মীরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন । ------৫২ এর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায় শুরু হয় খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টনের ঘোষণার মাধ্যমে । তিনি পুনরায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন । --------কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠিত হয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রদেশ ব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালনের কর্মসূচী গ্রহণ করে । সরকার আকস্মিকভাবে ২০ তারিখে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে । ফলে অসন্তোষ আরো ধুমায়িত হতে থাকে । -------ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে জমায়েত হয়ে ১৪৪ ধারা বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে । -------পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে ঢিল ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং পুলিশ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে । এ গুলিতে শহীদ হয় বরকত , জব্বারসহ আরো কিছু প্রাণ । -------মায়ের ভাষার দাবীতে ছাত্রদের এভাবে গুলি করে হত্যা করার সংবাদে জনগণের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে উঠে । যে ঢাকার জনসাধারণ ১৯৪৮ সনে উর্দুর পক্ষে থেকে সরকারকে সবরকমের সাহায্য করেছে - তারাও সরকারের উপর ক্ষেপে যায় । স্বাধীন দেশে এভাবে গুলি করে ছাত্র হত্যায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে ।” (পৃঃ ৩৭-৬৩ ) প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল ১৯৮৪ সালের এপ্রিল এবং ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে ।

তমুদ্দিন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা, ভাষা অন্দোলনের মূল নেতৃত্বদানকারী জনাব আবুল কাসেমের সাক্ষাৎকার হতে নিম্নে কয়েকটি বিষয় নতুন প্রজন্মের জন্য পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো-

(১) প্রথম দাবী ছিল, বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা, অফিসাদির ভাষা, যা পূর্ব বাংলার গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রি জনাব নাজিমউদ্দিন উপস্থাপন করে পাশ করেন ।

(২) বাংলা প্রাদেশিক ভাষা হওয়ার পর ৪৮ হতে ৫২ এর আগ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় । ।

(৩) প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কোন ধরনের সমর্থন ছিল না ।

(৪) অনেক চেষ্টার পর বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কয়েক হাজার দস্তখত সংগ্রহ হয়, কিন্তু যারা বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ছিলেন না, তারা মওলানা দীন মুহাম্মদের নেতৃত্বে কয়েক লাখ দস্তখত সংগ্রহ করেন ।

(৫) বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ফেডারেশন’ পাকিস্তান বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক কয়েকটি হ্যান্ডবিল ও পোস্টার দিয়ে জনগণকে আন্দোলন বিরোধী করে তোলে ।

(৬) বাঙলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে পূঁজি করে, অনেকে রাজনৈতিক সুবিধা যেমন মন্ত্রিত্ব বাগানোর চেষ্টা করেছেন ।

(৭) ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার কারণে যারা উর্দুর পক্ষে ছিলেন, তারাও বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন ।

কাজী গোলাম মাহবুব ১৯৫২ সালে গঠিন ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ এর আহ্বায়ক ছিলেন । তিনি বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার কাজী কসবা গ্রামে ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন । কাজী গোলাম মাহবুব সাক্ষাৎকারে যা বলেন, তার সারসংক্ষেপ হলো Ñ

“১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় । এই সংগ্রাম পরিষদে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম, নূরুল হক ভূঁইয়া, আব্দুল গফুর, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, কমরুদ্দিন, নইমুদ্দীন, লিলি খান, নূরুল আলম, শামসুল আলম, নুরুল হুদা এবং আমি । ---রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করা এবং জনমত গড়ে তোলাই ছিল এ পরিষদের উদ্দেশ্য । ----জনগণের মাঝে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । ঢাকার অধিবাসীরা এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে ছিল । ----পরিষদে (সংসদে) খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আহমদ খান, ওসমান আলী, তফাজ্জল আলী, মোঃ আলী, ডাঃ মালেক প্রমুখ রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখতেন । পরিষদের ভিতর এরা সোহরাওয়ার্দী সমর্থক (প্রধানমন্ত্রি নাজিমুদ্দিন বিরোধী) ছিলেন । তাই বলে এরা সবাই মন-প্রাণ দিয়ে পরিষদের অভ্যন্তরে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য রাখতেন না । এদের অনেকে ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে নাজিমুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রন্ট গঠনে তৎপর হন । কেউ কেউ আবার পরবর্তী সময়ে নাজিমুদ্দিনের সাথে নেগোসিয়েশন করে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা চালান এবং ভাষা আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন । ----এই ফ্রন্টের উদ্দেশ্য ছিল ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার (পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা) পতন ঘটানো । সোহরাওয়ার্দী সমর্থক বলে পরিচিত এই ফ্রন্ট গড়ে তোলার ব্যাপারে শেখ মুজিবও তৎপর ছিলেন । ----(কার্জন হলে) কায়দে আজম উর্দুর স্বপক্ষে বক্তব্য রাখার পর সম্মিলিতভাবে নো নো প্রতিবাদ উঠেছিল । সেখানে কোন ছাত্রের নেতৃত্ব দেয়ার কথা সম্পূর্ণ অতিরণ্জিত । নো নো প্রতিবাদের পরই কায়দে আজম, It is my view বলে তার বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করেন । (রেসকোর্সের ময়দানে) কোন প্রতিবাদ উঠেনি । ---১৯৫২ সালের ৩০ শে জানুয়ারী ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠিত হয় । ----আমি এ পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হই । ---প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, নাজিমুদ্দিন গভর্ণর জেনারেল হিসেবে (সারা পাকিস্তানের প্রধান) ২৭ জানুয়ারিতে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনরায় ঘোষণা দেন । নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা ছাত্র সমাজকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে । ---সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । ১১ ভোট ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে এবং ৪ ভোট ভঙ্গের পক্ষে ছিল । এরূপ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । ---আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে পর্যায়ক্রমে দূর্বার গতি দিতে চেয়েছিলাম । আমাদের আশংকা ছিল, চরম সিদ্ধান্ত নিলে সরকারি স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপও চরমে উঠবে এবং আমাদের আন্দোলনের মূল কাঠামো বা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে উদ্যোত হবে। প্রকৃতপক্ষে সরকার সে সুযোগের জন্য ওৎ পেতে ছিল । আর বাস্তবে তাই ঘটেছিল ।” (পৃঃ ১৯২-২০৪)। কাজী গোলাম মাহবুবের এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল ১৯৭৮ সালের মে এবং ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কাজী গোলাম মাহবুব যিনি মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার সাথে জনাব আবুল কাসেমের বক্তব্য তুলনা করলে দেখা যাবে যে, উভয়ের বক্তব্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই । তবে কাজী গোলাম মাহবুব এর নিচের পয়েন্টটি নিয়ে বিশদভাবে চিন্তা করলে তৎকালীন আন্দোলন এবং বর্তমান আন্দোলনের মধ্যে একটি অদ্ভূত মিল পাওয়া যাবে, আর তা হলো একটি তরতাজা প্রাণকে মেরে ফেলা, প্রয়োজন একটি লাশ । পয়েন্টটি হলো -

(১) “আমাদের আশংকা ছিল, চরম সিদ্ধান্ত নিলে সরকারি স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপও চরমে উঠবে এবং আমাদের আন্দোলনের মূল কাঠামো বা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে উদ্যোত হবে। প্রকৃতপক্ষে সরকার সে সুযোগের জন্য ওৎ পেতে ছিল । আর বাস্তবে তাই ঘটেছিল ।”

‘‘আর বাস্তবে তাই ঘটেছিল ।” বাস্তবে কারা ঘটালেন ? এটিই হলো ভাষা আন্দোলনের পিছনে একটি শক্তির ভূমিকা, যারা কখনও সামনে থেকে কাজ করেনি এবং এখনও এই শক্তি তৎপর এবং তা পূর্বের চেয়ে আরও বেশি শক্তি নিয়ে কাজ করছে ।

মোহাম্মদ তোয়াহা বাম ধারার রাজনীতি করতেন এবং ভাষা আন্দোলনের জন্য কারাবরণ করেন । তবে তিনি সরাসরি তমুদ্দিন মজলিসের সাথে যুক্ত না থেকেও তাদের সাথে আন্দোলন করেন । তিনি ১৯২২ সালে লক্ষীপূর জেলার কুশাখালীতে জন্মগ্রহণ করেন । এখানে খুবই সংক্ষেপে তাঁর সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো -

“বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা এ নিয়ে ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবি মহলে প্রথম চিন্তার সূত্রপাত করে তমুদ্দিন মজলিস । এই তমুদ্দিন মজলিস ইসলামী আদর্শে প্রভাবিত আধা রাজনৈতিক এবং আধা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান । ---তমুদ্দিন মজলিস ৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ‘ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ’ এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে । এই পুস্তিকায় কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নিবন্ধ ছাপা হয় ।” (পৃঃ৬৬)। “রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে ছাত্ররা একদিন চকবাজারে জনতা কর্তৃক ঘেরাও হয় । তখন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল ছিল । ছাত্ররা উত্তেজিত জনতার সামনে অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয় । এ সময় গোলাম আযম (জামায়াত নেতা) সাহস করে এগিয়ে যান । তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, আরে ভাই আমরা কি বলতে চাই, তা আগে শুনবেন তো । এই বলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কী উপকার হবে তার উপর একটি ছোট-খাট বক্তৃতা দিয়ে উপস্থিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন ।” (পৃঃ ৬৮) । -----“ একদিন আমি ও তাজউদ্দিন (প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রি) আইন পরিষদের সদস্য মোঃ তোফাজ্জল আলীর বাড়ীতে যাই । তিনি আমাদের দেখেই দূর থেকে চীৎকার করে বলে উঠলেন আরে এসো এসো তোমাদের খবর আছে । ----- তোমরা দুটি মন্ত্রিত্ব ও একটি রাষ্ট্রদূতের পদ পাচ্ছ । মুজিব (বঙ্গবন্ধু ) তোমাদের কিছু বলেনি । -----আইন পরিষদের (সংসদে) ভিতরে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থকদের একটি গ্রুপ ছিল । এদের মধ্যে ছিলেন মোঃ তফাজ্জল আলী, মফিজ উদ্দিন, আনোয়ারা বেগম, ওসমান আলী, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ । শেখ মুজিব এদের কাছে আনাগোনা করতেন এবং প্রচার করে বেড়াতেন যে, ইউনিভার্সিটিতে যেসব আন্দোলন হচ্ছে তা তিনি এবং তার সমর্থকেরাই করছেন । সুতরাং তাদের মধ্য থেকে (সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ) যদি মন্ত্রিত্বে না নেয়া হয়, তবে যে কোন মূল্যে আন্দোলন করে নাজিমুদ্দিন সরকারকে উৎখাত করা হবে । এইভাবে শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী বনাম নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমিনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মহান ভাষা আন্দোলনের উত্তাল জোয়ারকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন । ---- ” (পৃঃ ৭১,৭২) । “সত্যিকারের ঘটনা হচ্ছে (কার্জন হলে জিন্নাহর বক্তব্যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ) ব্যক্তিগতভাবে কেউ প্রতিবাদ করেনি এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না । এ প্রতিবাদ ছিল সম্মিলিত আওয়াজ বিশেষ । --- তবে এ প্রতিবাদ ধ্বনির (নো নো ) বিপক্ষেও সামনের শ্রোতাদের মধ্য হতে পাল্টা ধ্বনি ওঠে । -----(রেসকোর্সের জনসভায় ) কোন প্রতিবাদ ওঠেনি ।” (পৃঃ ৭৭) । “পুনরায় ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন যখন পল্টন ময়দানে ঘোষণা করেন, উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । তখন থেকে ভাষা অন্দোলন আবারও দূর্বার গতি লাভ করে । ---১৯৫২ সালের ৩০ শে জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠিত হয় । -- ছাত্রলীগের কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে এ কর্ম পরিষদ গঠিত হয় । --কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় সভা, শোভাযাত্রা এবং হরতালের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে । ---২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা হতেই ডাকায় অব্যাহতভাবে ১৪৪ ধারা জারী হয় । ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল আবার আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাজেট অধিবেশনের দিন । ১৪৪ ধরার সম্পর্কে আলোচনার জন্য আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয় । অধিকাংশ সদস্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেন । তাদের যুক্তি ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হবে । কিন্তু ছাত্রদের মত ছিল যে কোন পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে বদ্ধ পরিকর । ---এক পর্যায়ে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধরা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ---সাড়ে বারোটার দিকে (২১ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা আরম্ভ হয় । ছাত্র-নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা দেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে সমবেত ছাত্র-জনতার হাতে ছেড়ে দেন । ----বিভিন্ন দিক হতে শুরু হয় ছাত্র-পুলিশের লড়াই । সে লড়াইয়ের দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা নয়, শুধু অনুভব করার ।” (পৃঃ ৭৮ ৭৯) । সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে ।

ডক্টর এ এস এম নূরুল হক ভূইয়া ভাষা আন্দোলনে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ (‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ নয়) আহ্বায়ক ছিলেন । তিনি ১৯২৩ সালের ১লা মে নারায়নগন্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার গোবিন্দপূর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । এখানে খুবই সংক্ষেপে তাঁর সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো -

“৪৭ এর অক্টোবরে যখন মনি-অর্ডার ফরম, ডাক টিকেট এবং মুদ্রায় বাংলাকে বাদ দিয়ে একের পর এক উর্দু, ইংরেজি ব্যবহার শুরু হলো, তখন আমরা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম । ---সমর্থক কিছু ছাত্র এবং তমুদ্দিন মজলিস কর্মীরা ছাড়া কেউ তখন প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তৎপর ছিলেন না” (পৃঃ ৮৫) । “পুরোনো ঢাকায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে অনেক কর্মী নাজেহাল হয়েছেন । অনেকে বিরোধীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন । ---পুরোনো ঢাকা ছাড়াও ঢাকার অন্যান্য স্থানে শিক্ষিত লোকজনের নিকট হতে দুঃখজনকভাবে বিরূপ ব্যবহার পাওয়া গিয়েছে । কিন্তু সব জায়গায় এমনটি ঘটেনি । ----জনমন তখনও প্রতিকূল ছিল । তবে ছাত্রদের মধ্যে অনুকূল সাড়া পরিলক্ষিত হচ্ছিল ।” (পৃঃ ৮৮ , ৮৯) । “১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি করাচীতে গণ পরিষদের বৈঠক বসে । ---ধীরেন্দ্রনাথ সুস্পষ্টভাবে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রাখেন । কিন্তু সে দাবী ও প্রস্তাব গণপরিষদ অগ্রাহ্য করে । ---রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে গণপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানাই । ----১১ই মার্চ প্রদেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট এবং ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয় । ---১৫ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয় । এর পূর্বে অর্থাৎ ১৪ই মার্চ সন্ধ্যার দিকে খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন । ---দুদফা আলোচনার পর নাজিমুদ্দিন এর সাথে সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । খসড়া চুক্তিটি ১১ই মার্চ গ্রেফতারকৃত শামসুল হক, শওকত আলী, অলি আহাদ, শেখ মুজিব, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ ছাত্র নেতাদের জেলের অভ্যন্তরে দেখানো হয় । প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সাহেব পরে চুক্তিটি বর্তমান শহীদ মিনারের সামনে সমবেত ছাত্রদের পড়ে শোনান । -----ঐ দিন সন্ধ্যায় ২/১ জন ছাড়া অধিকাংশ ছাত্র ও সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ মুক্তি লাভ করেন । ---২১শে মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে কায়দে আজমের জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । (উর্দু রাষ্ট্র ভাষা বলায়) ৮/১০ জন নো নো প্রতিবাদ করতে দেখেছি । তাঁরা মজলিস কর্মীদের একাংশ । ওরা নো নো করে ওঠলে জনসভার শ্রোতারা তাদের বসিয়ে দেয় । ---বিশাল জনসভা । সংগঠিতভাবে প্রতিবাদের কর্মসূচী ছিল না, সে অবস্থাও ছিল না । বিচ্ছিন্নভাবে যে কয়েকজন প্রতিবাদ করেছে , অনেকে তাদের ধ্বনি শুনেন নি । আর বিশাল জনসভায় তা শোনারও কথা নয়” (পৃঃ ৯১,৯২) । “১৯৫২ সালে ২৭শে জানুয়ারি নাজিমুদ্দিন সাহেব পল্টনের ময়দানে আবার ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা । ---বার লাইব্রেরীতে ৩০শে জানুয়ারি সর্বদলীয় সম্মেলনে পুনরায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় এবং কাজী গোলাম মাহবুব এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন । এই সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ---২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয় । সেই দিন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি চাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধ হয় ও পুলিশ গুলি বর্ষণ করে । এ গুলি বর্ষণে সেদিন ও পরের দিন রফিক, বরকত, জব্বার ও সালামসহ কয়েকটি অমূল্য প্রাণ শাহাদাৎ বরণ করেন । পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় সরকার নির্মম পুলিশী ব্যবস্থার মাধ্যমে ৪/৫ দিনের মধ্যে আন্দোলনের গতিকে রুদ্ধ করে দেয়” (পৃঃ ৯৬,৯৭) । সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ১৯৭৮ সালের নভেম্বর এবং ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে ।

অধ্যাপক গোলাম আযম (জামায়াতের প্রাক্তন আমীর) ভাষা আন্দোলনের গোড়া থেকেই জড়িত ছিলেন । তিনি ১৯২২ সালের ৭ই নভেম্বর ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পৈত্রিক নিবাস হল ব্রাক্ষণবাড়ী জেলার নবীনগর থানার বীরগাঁও গ্রামে । অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৪৮ সালে ২৭শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমন্যাসিয়াম মাঠে ছাত্রদের সামনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলী খান যে বক্তব্য রাখেন, সে সমাবেশে ডাকসুর তৎকালিন জি. এস. হিসেবে বাংলা ভাষার পক্ষে মেমোরেন্ডাম পাঠ করেন । ভাষা আন্দোলনের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালে গ্রেফতার হন । তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে যা বলেন, তার সারসংক্ষেপ হলো, তমুদ্দিন মজলিসের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমুদ্দিন মজলিস গঠিত হয় । কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আগমণের পূর্বে রাষ্ট্রভাষার দাবী প্রথমে আন্দোলনের রূপ নেয় । সরকারের সাথে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের চুক্তির পর এবং কায়দে আযমের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় । ব্যাপক আন্দোলন রূপ না নিলেও ক্রমে ক্রমে দানা বাঁধতে থাকে । প্রধানমন্ত্রি নাজিমুদ্দীনের ৫২ সালে পল্টনের ঘোষণার পর (উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা) আন্দোলন সত্যিকার অর্থে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয় এবং গুলিবর্ষণের পর সর্বপ্রথম গণ আন্দোলনে পরিণত হয় ।

রাষ্ট্রভাষার সমর্থন সম্পর্কে গোলাম আযম বলেন, ছাত্রমহলে ভাষা সম্পর্কে বিরোধীতা দেখা যায়নি । হয় সমর্থন না নির্লিপ্ততা ছিল । ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ৫২ সালে হয় । ঢাকার আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল এক ধরনের অশুদ্ধ উর্দু । তাই ভাষার প্রশ্নে তাদের সমর্থন পাওয়া যায়নি । পুরোনো ঢাকার মাওলানা দীন মুহাম্মদ, মাওলানা জাফর আহমদ ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপূরী প্রমুখের প্রভাব থাকায় এখানকার অধিবাসীরা উর্দুর পক্ষে ছিল । এ দেশের ওলামা সমাজ উর্দুর পক্ষে ছিলেন । নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকরা উর্দুর পক্ষে ছিলেন । আরও একটি শ্রেণী উর্দুর পক্ষে ছিলেন, যারা সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে উর্দুকে হিন্দির বিরুদ্ধে মুসলিম জাতির সাধারণ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন । আর আন্দোলনকারীদের যুক্তি হল বাংলা হলো অধিকাংশ লোকের মুখের ভাষা । পাকিস্তান আন্দোলন কর্মীদের একটি অংশ অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী - আবুল হাশিমের গ্রুপ বাংলার পক্ষে ছিলেন । সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে।

ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে ফরিদপূর জেলার পাংশা থানার দাদপূর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সৈনিক’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক এবং সম্পাদক ছিলেন । তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তমুদ্দিন মজলিসের সমস্ত সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদি সৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ পেত । ছাত্র-জনতাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সচেতন এবং আন্দোলনকে দুর্বার করার জন্য সৈনিক সদা সচেষ্ট ছিল । ১৯ নং আেজিমপূরে মজলিস ও সৈনিকের অফিস ছিল । অধ্যাপক শাহেদ আলী সাহেব সৈনিকের সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি ছিলেন । একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে সৈনিকের বিশেষ শহীদ সংখ্যা বের হয় । সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ।

ভাষা সৈনিক অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি” বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় বলেন “ঢাকা শহরের আদিবাসীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোরবিরোধী ছিল । তাহাদের দৃষ্টিতে আমাদের আন্দোলন ছিল মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারী ও হিন্দুদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ।” এ সম্পর্কে ভাষা সৈনিক এবং বামধারার রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত জনাব গাজীউল হক বলেছেন “এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব কোন কর্ম পদ্ধতি ছিল না । প্রকৃতপক্ষে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির লেজুড় বিশেষ । ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরা তো ছিলেন প্রায় সবাই হিন্দু । তারা আদর্শের দিক থেকে যতটুকু কমিউনিস্ট ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন হিন্দু ।” (“ভাষা আন্দোলন ঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন” ১৮৮ , ১৮৯ পৃষ্ঠা) ।

আজ বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম বিশ্বাস করে, সে সময় পূর্ব বাংলার সবাই রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলার’ পক্ষে ছিলেন এবং উর্দুভাষীরা বাঙ্গালীদের গুলি হত্যা করেছিল । বাস্তবে সে সময় পূর্ব বাংলার সবাই বাংলা ভাষার পক্ষে ছিলেন না । তবে যারা বাংলার বিপক্ষে ছিলেন, তারা কিন্তু প্রাদেশিক ভাষা বাংলা হবে, এ ব্যাপারে একমত ছিলেন । মতবিরোধ হচ্ছে কেন্দ্রে ভাষা বাংলা না উর্দু হবে ? তবে ভাষা সৈনিকদের সাক্ষাৎকার হতে স্পষ্ট যে, ১৯৪৮ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন ছাত্রদের নিকট হতে তেমন সমর্থন পাওয়া যায়নি এবং জনগণের বিরোধীতা ছিল খুবই শক্ত ধরনের । অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের জনগণের নিকট হতে মার খেতে হয়েছে এবং এক পর্যায়ে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় । এরপরও আন্দোলনকারীদের নিরলস প্রচেষ্টায় আন্দোলন ধীর গতিতে চলতে থাকে, ছাত্রদের মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে এবং জনগণও একে ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে থাকে এবং ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়াররি গুলিবর্ষণের পর তা ব্যাপক আন্দোলনে রূপ নেয় । ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির পর পুলিশী দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দূর্বল হয়ে যায় । কিন্তু ২১ শে ফেব্রুয়ারির কিছু তরুণের প্রাণহীণ নিস্তবদ্ধ দেহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ও বিপক্ষের সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে এবং ৫৬ এর সংবিধানে বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে ।

১৯৫২ সাল হতে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় । কিন্তু এর পিছনে যাদের অবদান, সেই প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, মোহাম্মদ তোয়াহা, ডক্টর নুরুল হক ভূইয়া, কাজী গোলাম মাহবুব, অধ্যাপক গোলাম আযম, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, শাহেদ আলী, অলি আহাদসহ অনেককেই স্মরণ করা হয় না । এরাই ভাষা আন্দোলনের সময় প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশের আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন ।

৫৬ এর সংবিধানে ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় । কিন্তু এর অনেক আগেই পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল প্রদেশের সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাংলা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । কিন্তু আজ ২০১৮ সালেও কি বাংলা সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা হয়েছে ? সেই ১৯৪৮ সালে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম যেমন ইংরেজি ছিল, আদালতের ভাষা যেমন ইংরেজি ছিল, আজও তার কোন পরিবর্তন হয়নি। ৭১ এ যদি রাষ্ট্র ভেঙ্গে বাংলাদেশ না হত, অর্থাৎ আজ যদি পাকিস্তান থাকত, তবে আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এর কারণ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দায়ী করতেন । কিন্তু আজ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত বাংলা উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম বা আদালাতের ভাষা না হওয়ার পিছনে বুদ্ধিজীবিরা কাকে দায়ী করবেন ?

ইতিহাস এবং সাহিতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে । বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ না করে গল্প, উপ্যানাস এবং কবিতার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে থাকেন । ফলে আমাদের ইতিহাস চর্চা না হয়ে, হয় সাহিত্য চর্চা, যেখানে থাকে সাহিত্যের উপাদান । ফলে আমাদের ইতিহাস হারিয়ে যায় কাল্পনিক জগতে । ফলে কারবালার প্রকৃত ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে মীর মোশাররফের ‘বিষাদ সিন্ধুর’ মধ্যে । আজকের নতুন প্রজন্মরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানে না, তারা জানে, গল্প-ঔপন্যাসিক-কবির রং-তুলির কারুকাজ । আজ অনেকেই জানেন, ভাষা আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছিল । যখন বলি, কিছু শহীদের নাম বলুন, তখন বলেন, সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক । যখন বলি ৫ এর ঘর ত পার হলো না, আরও নাম বলুন । তখন আর কোন উত্তর আসে না । যখন বলি, আন্দোলনকারী কতজন আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ? উত্তর হলো জনাব আব্দুল জব্বারের গান- “সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে------হাসি মুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ”। এখানেইত বলা হয়েছে, হাসি মুখে ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দেয়া হয়েছে । এই হলো আমাদের ইতিহাস জ্ঞান ! কে বুঝাবে, গান আর ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য আছে ।

ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পর বংশাল রোডে অবস্থিত “দৈনিক সংবাদ” পত্রিকা আক্রমণ করার সময় পুলিশ গুলি চালায় । সেখানে একজন রিক্সা চালক আব্দুস সালাম মারা যান (জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, ১৪৮পৃ) । একই বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হাইকোর্ট এর কর্মচারী শফিউর রহমান নওয়াবপূর রোডে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন । জনাব আব্দুল জব্বার তার শ্বাশুরির চিকিৎসার জন্য ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসেছিলেন, কিন্তু পুলিশের গুলিতে ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে এই পৃথিবী হতে বিদায় নিতে হলো । জনাব আবুল বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ১২ নং শেডে গুলিবদ্ধ হয়ে রাতে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । জনাব রফিক সরাসরি ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন । ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করায় পুলিশের গুলিতে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যান ।

বলা হয়ে থাকে, ভাষার জন্য বাঙ্গালিরা প্রথম শহীদ হয় । এটাও একধরনের ইতিহাস বিকৃতি । ভাষার জন্য প্রথম প্রাণ দেয়, তামিলরা । ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস ১১টি প্রদেশ এর মধ্যে ৮টি প্রদেশে জয়ী হওয়ার পর হিন্দী ভাষাকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করায় তামিলরা এর প্রতিবাদ করে এবং তামিলদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি করলে ২ জন নিহত হয় এবং নারী ও শিশুসহ ১১৯৮ জনকে গ্রেফতার করে কংগ্রেস সরকার । এর প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে Lord Erskin মাদ্রাজে (বর্তমান তামিলনাড়ু) বাধ্যতামূলক হিন্দী পড়ানো রদ করেন । লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রি থাকাকালীন সময়ে ১৯৬৫ সালে হিন্দী বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ৬৮ জন তামিল প্রাণ হারায় । ১৯৮৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রি রাজীব গান্ধি যে জাতীয় শিক্ষা নীতি চালু করেছিলেন, সেখানে নবোদম বিদ্যালয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, যেখানে হিন্দী হবে বাধ্যতামূলক । কিন্তু এবারও তামিলরা তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলে । ভারত সরকার ২০ হাজার তামিল গ্রেফতার করে এবং আত্মহত্যার নামে ২১ জন তামিলকে হত্যা করে (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া) । উল্লেখ্য যে, ভারত ১৯৫০ সালে হিন্দী ও ইংরেজি উভয়কে সরকারি ভাষা রাখলেও পর্যায়ক্রমে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দীকে এককভাবে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে চেয়েছিল । অন্যদিকে তামিলরা কিন্তু সরকারি ভাষা হিসাবে নিজেদের ভাষাকে দাবী করেনি । তারা দাবী করেছিল হিন্দী একমাত্র সরকারি ভাষা হতে পারবে না, সাথে ই্ংরেজিও থাকতে হবে । আর এ জন্য, তামিলদেরকে যুগ যুগ ধরে আন্দোলন করতে হচ্ছে এবং প্রাণ দিতে হচ্ছে । অন্যদিকে পাকিস্তানে সেই তুলনায় কোন আেেন্দালন না করেই আঞ্চলিক ভাষা “বাংলা”, রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পায়।

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া সম্ভব হয়েছে । কিন্তু এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) ছাত্রদের উপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তা আমরা যাদেরকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করি যেমন দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, শাহেদ আলী, প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, গোলাম আযম, গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল গফুর, তারা অনুধাবন করতে পারেননি । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ছাত্রদের আইন ভঙ্গ করাটাকে বীরের কাজ বলে শিখিয়েছি । রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় যাওয়ার সহজ পথ হিসাবে ছাত্রদের ব্যবহার করার শুভ উদ্বোধন করেছেন ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে । তাই পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্ররা শ্রেণী কক্ষে না গিয়ে রাস্তায় মিছিল করেছে, করেছে ব্যাংক-বীমা, সরকারি অফিস, সংবাদপত্র অফিস ভাঙ্গচুর । ছাত্ররা পরিণত হলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পেটোয়া বাহিনীতে । তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আমরা দেখলাম, আমাদের ছাত্র রাজনীতি ৪৭ হতে ৭১ পর্যন্ত যে চরিত্র গঠন করেছিল, সেই চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি । স্বাধীনতার পর ছাত্রদের নিকট হতে উপহার পাওয়া গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার কেস, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের মহড়া, হল দখল প্রতিযোগীতা, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি । ছাত্রের উপর শিক্ষকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ আছে রাজনৈতিক নেতার । কিন্তু বাংলাদেশের কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে যে চিত্র দেখা যায়, সেই চিত্র নেই ভারত এবং পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখানে কোন মারামারি নেই, নেই কোন অস্ত্রবাজি, সেখানে ছাত্রদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয় না, তারা থাকে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে । প্রশ্ন হলো উপমাহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ হলো শান্ত এবং বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ অশান্ত হলো কেন ? এর উত্তর হলো বাংলাদেশের মত ভারত ও পাকিস্তানে ছাত্রদের ব্যবহার করে কোন আন্দোলন গড়ে তুলা হয়নি । ভারত ও পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আর যাই করুন না কেন, উনারা উনাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস হতে টেনে রাস্তায় নিয়ে আসেননি ।

আমরা যদি নিরপেক্ষ মন নিয়ে চিন্তা করি, তবে বলতে হবে, এই বাঙ্গালী জাতির দূর্দশার জন্য ১৯৪৭ এর পর জন্ম নেয়া বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরাই দায়ী । এই বুদ্ধিজীবিরা ভুলে গেল যে, ৪৭ এর পূর্বে তারা কৃষিজীবি শ্রেণীতে ছিল । কিন্তু ৪৭ এর ১৪ই অগাস্ট ভারত বিভক্তি এবং পশ্চিম বাংলার বর্ণ হিন্দুদের হাত হতে মুক্তি পাওয়ার কারণেই তাদের শিক্ষা গ্রহণ এবং চাকুরি পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয় । রাতারাতি আরও সুবিধা আদায়ের জন্য সৃষ্টি করা হলো আঞ্চলিক জাতি বিদ্বেষ । সুবিধাভোগী এই বুদ্ধিজীবিরা তাদের স্বার্থের জন্য রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছে এবং বিবৃতিগুলো ছিল দোষারোপের বিবৃতি । ইতিহাস বিকৃত করা ছিল এ সমস্ত বুদ্ধিজীবিদের মহান দায়িত্ব ।

আমাদের দূভার্গ্য যে, আমাদের বুদ্ধিজীবিদের গঠনমূলক কাজে কোনই ভূমিকা ছিল না বরং বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের ব্যবহার করা এবং বিবৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব বিবৃতিজীবি হিসেবে শেষ করেছেন । দেশে এ ধরনের কিছু বিবৃতিজীবি থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বও এদেরকে ব্যবহার করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছেন । প্রকৃতপক্ষে ‘বাংলা ভাষার’ প্রতি প্রকৃত দরদ এসমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ছিল না । বরং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা এবং সে ব্যাপারে সফল হওয়া সম্পর্কে আমরা ভাষা সৈনিকদের সাক্ষাৎকার হতে জানতে পেরেছি । এরা বাংলা ভাষার সম্প্রসারণ না করে বরং ভাষা ভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে এবং একই সাথে সৃষ্টি করে বিভেদ, বিদ্বেষ এবং শত্রুতার পরিবেশ । পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরা, বাংলা সাহিত্যে যাদের অবদান আমাদের চেয়েও বেশি, তারা কিন্তু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি না করে সর্ব ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিলীন হয়েছে । অন্যদিকে আমরা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বলতে বলতে নিজ দেশে ভূমি ক্রয় করার (পার্বত্য জেলায়) অধিকার হারিয়েছি ।

প্রতিটি ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্টি । নিজ ভাষায় মানুষ সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারে বলেই আল্লাহপাক প্রত্যেক জাতির নিকট তাদের নিজ ভাষায় নবী প্রেরণ করেছিলেন । তাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ নয়, আমরা যদি দরদ নিয়ে বাংলা ভাষা চর্চা করি, তবে আমাদের ধর্মীয়, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান চিকিৎসা, প্রকৌশল বিভিন্ন শাখায় উন্নতি হবে । আর এজন্য প্রয়োজন বুদ্ধিজীবিদের গঠনমূলক কাজ । চিকিৎসা বিজ্ঞানের বুদ্ধিজীবিরা বা শিক্ষাবিদরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করতেন, তবে বাংলাদেশে ভাল ডাক্তারের অভাব হত না । যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা পড়তে পারত, ‘প্যারাসিটামল একটি ড্রাগ, যা জ্বর, মাথা ব্যাথা, কানের ব্যাথা উপসমে ব্যবহৃত হয় । শিশুদের জন্য এর মাত্রা হলো এত এত এবং বয়স্কদের জন্য এত এত ।’ তাহলে আমরা প্রতি বছরই ভাল ডাক্তার পেতাম । এখানে আমি ‘প্যারাসিটামল’ এর বাংলা অনুবাদ করার কথা বলছি না, বরং বাংলায় অনুবাদ করতে হবে তার ব্যবহার বিধি এবং ম্যাকানিজম । জার্মান, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, কোরিয়া, জাপান, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এভাবেই চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, প্রকৌশল ইত্যাদি শাখার অনুবাদ নিজ ভাষায় করতে পেরেছে বলেই তাদের শিক্ষার মাধ্যম নিজ ভাষা হতে পেরেছে । আর আমরা প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করে অপর জাতিকে বিনা কারণে গালাগালি করি এবং দিবসটি শেষ করি, আর বিশ্ববিদ্যালায়ে গিয়ে অন্যের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করি । আজ যদি আমাদের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবিরা রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি না করে, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা, জীব বিদ্যা, উদ্ভিদ বিদ্যা, গণিত, অর্থনীতি ইত্যাদি বইগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতেন, তখন ৫২ এর ভাষা আন্দোলন সার্থক রূপ নিত । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ৫২ তে ওলামা শ্রেণীরা ভারতীয় মুসলমানদের জনপ্রিয় ভাষা উর্দুর পক্ষে ছিলেন । তারা কিন্তু ধর্মীয় কারণে প্রতি বছর শহীদ মিনারে যান না এবং অপর জাতিকে গালাগালও করেন না । কিন্তু এই ওলেমারাই ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক সময় হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তারাই এ দেশে বাংলাকে প্রকৃত মর্যাদা দিয়েছেন । শহীদ মিনারে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবিরা যান, তারা কি পারবেন, বাংলাদেশের আলেম-ওলেমারা কুরআন-হাদীস, ইসলামী বই যেগুলো ইসলামের প্রথম যুগে বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে এবং বর্তমানেও রচিত হচ্ছে, সেগুলো যদি বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষাকে সম্মানিত করতে পারেন, তবে কেন তারা নিজ নিজ বিষয়ের বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করে বাংলাকে সম্মানিত করতে ? বাংলার জন্য এতটুকু ত্যাগ স্বীকার শহীদ মিনারে যাওয়া কোন বুদ্ধিজীবিরা করবেন কি ? নাকি ‘বাংলা ভাষাকে’ রেখে দিবেন শুধু ১ দিনের জন্য, দিবস পালনের জন্য এবং একটি বিশেষ জাতিকে মিথ্যা গালাগালি করে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ?

বিষয়: বিবিধ

২৩০৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384748
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাত ০২:৫১
ইক্লিপ্স লিখেছেন : অনেক কষ্ট সাধ্য পোষ্ট। নিস:সন্দেহে অসাধারণ। আপনার পোষ্টের দাওয়াত পেয়ে বহুদিন পর এই ব্লগে আসা। ধন্যবাদ নিমন্ত্রণের জন্য। ভালো থাকবেন।
384751
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাত ১০:১৫
তট রেখা লিখেছেন : অসাধারণ পোস্ট, ধন্যবাদ না দিয়ে পারছিনা। ভাষা আন্দোলনে মূলতঃ কাজ করেছে আবেগ, যুক্তি নয়। তবে আজ বছর পর এ রকম বিশ্লেষন হয়ত অনেকের কাছে মেনে নেয়া কঠিন হবে। শুভেচ্ছা রইল।
384851
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাত ০৮:১৩
আবূসামীহা লিখেছেন : আপনার লিখাটা বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। আগে পড়লেও ব্লগে এসে লগইন করা হয় নি বলে মন্তব্য করা হয় নি।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাত ১১:১৩
317400
আবু নিশাত লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে । আজ বড়ই দুঃখ লাগে যখন দেখি ইসলামপন্থিরাও জাতীয়তাবাদী হয় । যখন দেখি তাদের মুখে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের শেখানো ইতিহাস ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File