একটি খড়ের গাদায় আগুন এবং অতঃপর

লিখেছেন লিখেছেন আজাদ আব্দুল্লাহ ১৯ মার্চ, ২০১৪, ১০:২৯:৩২ সকাল

আগুন। জ্বলছে দাউ দাউ করে। খড়ের গাদায়। তাপদাহে ছোটাছুটি করছে পাশের গোয়াল ঘরের গরু গুলো ও। পানি ছুড়ছে গ্রাম বাসী। কিছুটা নেভানো গেলেও খড় গুলো আর টিকানো গেলো না। গভীর রাতে পুড়ে গেল নসু মিয়ার মিনারের মত খড়ের গাদা টি। সবাই আফসুস করে। আহারে! বোবা প্রাণী গুলোর খাবার। কোন অমানুষ এমন কাজ টি করতে পারল। সন্দেহের তীর যায় হাসু মিয়ার দিকে। হাসু হচ্ছে গ্রামে নসু মিয়ার একমাত্র শত্রু। মাত্র ক’দিন আগেই জমি দখল নিয়ে তাদের মধ্য মারামারি হয়েছে যাতে হাসু মিয়ার দুই ভাই বল্লমের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে। শালিসের তারিখ ঠিক হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ-ই হাসু মিয়ার পক্ষে ছিল। কিন্তু আজকের এই আগুন দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। মানুষে মানুষে হানাহানি হয়েছে তো কি হয়েছে তাই বলে এই বোবা প্রাণীর উপর প্রতিশোধ? আহারে! কথা বলতে পারে না। আঁখি ছলছল নির্বাক গরু গুলোর দিকে তাকিয়ে সবাই চোখ মুছে। ছুটে আসে নসু মিয়া। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করে, কে লাগিয়েছে আগুন? হাইস্যা না? আদর পেয়ে গরু মাথা নাড়ে আর নসু চিৎকার করে সবাই কে ডাকে দেখছেন বোবা প্রাণী মিথ্যা বলে না। সবাই বিশ্বাস করে। কারন গরুর ভাষা বুঝে শুধু নসুই। তারপর শালিস বসে তবে হাসুর আহত দুই ভাইয়ের জন্য নয়। খড়ের গাদায় আগুনের বিচার করতে। সর্বসম্মতিতেই হাসু অপরাধী। জরিমানা হয় তার। বোবা প্রাণীর উপর আঘাত বলে কথা।

উপদ্বীপের মত ছোট্ট এ গ্রামটির নাম রহমতের চর। তিন দিকে নদী বেষ্টিত গ্রামের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীই নিরক্ষর। নদীর বুকে মাছ ধরাই তাদের প্রধান পেশা। নাম রহমতের চর হলেও রহমত মরে গেছে সেই কবেই। ঝগড়া-হানাহানি লেগেই আছে। একসময় এই গ্রামের কোন অস্তিত্বই ছিল না। ছিল অথৈ নদী। স্রোতের পরিক্রমায় চর পড়ে, গড়ে উঠে লোকালয়। শুরু থেকেই জমি দখল নিয়ে হয় হানাহানি। সেই যে শুরু আর থামে নি। কোন এক প্রভাবশালী মাতব্বর রহমত আলী নিজের নামে এই চরের নামকরন করে ‘রহমতের চর’। এই রহমতের-ই বংশধর নসু মিয়া। কাল কালান্তরে পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি জিইয়ে রেখেছে এখনো। অবশ্য চরে তার ভক্তের সংখ্যা ও কম নয়। মেলা মানুষ তার কথায় উঠে বসে। তার ডাকে সাড়া দেয়।

দীর্ঘদিন একক আধিপত্য বজায় রাখলেও নতুন করে জন্ম হয় আরেক হাসু মিয়ার। অনেকটা নসু’র আচরণে অতিষ্ট হয়েই নব্য এই প্রতিদ্বন্দ্বীকে স্বাগত জানায় গ্রামের অসহায় মানুষ। মাঝে মাঝেই তাদের মাঝে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ও এই দুই শিবিরেই বিভক্ত। মাঝে মাঝে আবার দল পালটায়। কখনো বিরক্ত হয়ে কখনো ভালবেসে। কিছু মানুষ নিরপেক্ষ সুশীল প্রকৃতির, ঝগড়া বিবাদ হলে মীমাংসা করে দেয়। কখনো জরিমানা করে কখনো শাস্তি। এইভাবেই দিন যায়।

কিছুদিন পর আবার ও নসু-হাসু’র দলের যুদ্ধ হয়। এবার হয় গ্রাম সরকার নির্বাচন নিয়ে। নিহত হয় হাসু’র ছোট ভাই। নসুর বিরুদ্ধে গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়। এরই মধ্যে পূর্বের মতই আগুনে পুড়ে যায় নসুর খড়ের গাদা। অধিকন্তু এবার সাথে একটা বাছুর ও। নসুর অভিযোগ আর হাত বুলানোয় আদর পাওয়া গরুর মাথা নাড়ানো সব কিছু মিলে জরিমানা হয় হাসুর। বোবা প্রাণীর প্রতি মানুষের ভালবাসা আর সহমর্মিতা আশীর্বাদ হয়ে ফিরেছে নসুর নিয়তিতে। গ্রাম সরকারের প্রেসিডেন্ট হয় সে।

এভাবে চলতে থাকে দিন। মাঝে মাঝেই খড়ের গাদায় কে বা কাহারা আগুন দেয় আর কপাল খুলে নসুর। এতেই আনন্দ। কয় টাকার খড়-ই আর পুড়ে!

জমি নিয়ে আবার সংঘর্ষ হয় তাদের। হাসু মিয়ার গোয়েন্দারা গোপনে পাহারা দিচ্ছে নসুর খড়ের গাদা। গভীর রাতে হাতে কুপি হাতে খড়ের গাদার পাশে কে যেন। হাতেনাতে ধরা পড়ে নসু। কিন্তু না; নসু এসেছিল তার গরুর বাছুর টাকে খুঁজতে। হাসু মিয়ার এ লোকরাই বরং এসেছিল আগুন দিতে। প্রচার চলে সারা গ্রাম। তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ‘আন্তর্জাতিক বোবা প্রাণীর খাবার সংরক্ষন সমিতি’। হাসু মিয়ার কুশপুত্তলিকায় আগুন লাগায় ‘পরিবেশ পরিষদ’। গোয়াল ঘর অভিমুখী লংমার্চ এর আয়োজন করে ‘গো-সংহতি মঞ্চ’। ঘরে বাইরে তীব্র সমালোচনা হয় হাসু বাহিনীর।

সময় বয়ে যায় অন্ধকারে আগুন আগুন খেলায়। প্রজ্জ্বলনকারী রয়ে যায় আড়ালেই।

বিষয়: বিবিধ

১৪২৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

194582
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৩৮
ক্যরিয়ার স্পেশালিস্ট লিখেছেন : বাস্তবতার আবহে আপনি তো অসাধারণ কথা সাহিতে্যর জন্ম দিলেন।
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:১৬
145112
আজাদ আব্দুল্লাহ লিখেছেন : মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
194591
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৫৫
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম, জাজাকাল্লাহুল খাইরান, শিক্ষনীয় পোস্ট
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:১৭
145114
আজাদ আব্দুল্লাহ লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম। জাজাকাল্লাহ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File