আওয়ামী আমল: বিপন্ন নারীর অস্বিত্ব

লিখেছেন লিখেছেন নেওয়াজ ১৮ জুন, ২০১৩, ১২:৩৪:০৯ দুপুর



প্রত্যেক সরকারের আমলেই নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের এক নেতা ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব করেছিল। পরে ওই ছাত্রলীগ নেতাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। অতীতের চেয়ে ঘটনার ভয়াবহতা ক্রমেই বাড়ছে। নির্যাতনের বিশেষ করে অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো কারা বেশি ঘটাচ্ছে তাও সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, বেশির ভাগ ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও ক্যাডাররা জড়িত। এ অবস্থা কোনো সুস্থ শান্তিকামী সমাজের পরিচয় বহন করে না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি।

৩ মে ২০০৯ সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার আদিবাসী পল্লী ক্ষিরপঁওতা গ্রামে পূর্বশত্রুতার জের ধরে আদিবাসী গৃহবধূ কাকলী সিংয়ের ওপর দুর্বৃত্তরা এসিড ছুঁড়ে মারে। এতে তার মুখ, গলা ও হাত ঝলসে যায়।

৩ জুলাই ২০০৯ পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর থানা পুলিশ বোরকাপরা দুই ছাত্রী ও এক শিক্ষিকাকে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধ কিছু না পাওয়া সত্ত্বেও শুধু সন্দেহপূর্বক ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় তাদের গ্রেফতার করে। শুধু তা-ই নয়, নিম্ন আদালতের মাধ্যমে তাদের ‘জঙ্গি’ হিসেবে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টাস্কফোর্স ইন্টিলিজেন্স সেলে পাঠানো হয়। টিএফআই সেল ‘জঙ্গিবাদের’ সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়নি। ২০ জুলাই ডেপুটি এটর্নি জেনারেল রাজিক আল জলিল হাইকোর্টকে জানান, বোরকা পরা তিন নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ব্যক্তিগত পছন্দ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার। জিয়ানগর থানা পুলিশ বোরকাপরা তিন নারীকে তল্লাশির পর অবৈধ কিছু না পেয়েও শুধু সন্দেহের কারণে তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় এবং বোরকা খুলে ছবি তুলে পত্রিকায় প্রকাশ করে। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সরকারের প্রশ্রয়ে ধর্মপ্রাণ এই তিন নারী দেশের মানুষের সামনে লাঞ্ছনার শিকার হন। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১৩ মার্চ ২০১০) ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যশোরে দশম শ্রেণীর এক মুসলমান ছাত্রী সিঁদুর পরতে না চাওয়ায় তাকে গণধর্ষণ করা হয়। শিশির ঘোষ নামে এক যুবক এ ধর্ষণ ঘটনার মূল হোতা। শিশির ঘোষ স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার নোয়াপাড়ায় চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে বাজার থেকে বাড়িতে ফেরার সময় ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ অপহরণ করা হয়। ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে লাশ গোয়ালঘরের মাটিতে পুঁতে রাখে ধর্ষকরা। পুলিশ ও গ্রামের মানুষ ৩ অক্টোবর তার লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িত সহোদর মানিক ও সুজনসহ তাদের মাকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ পরিবারটিও সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জলসুখা গ্রামের অধিবাড়ি এলাকায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ ঢাকার স্পিনিং মিলের এক কিশোরী ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে তাকে আটক করে দুর্বৃত্তরা। তাকে রাস্তার পাশে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ৫ জনের নামে থানায় মামলা হয়েছে। কেউ আটক হয়নি।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় পূজামন্ডপ থেকে ফেরার পথে এক কিশোরীকে অপহরণের পর ছাত্রলীগের ১০ কর্মী পালা করে ধর্ষণ করে। এ ঘটনার পর ধর্ষিতার বাবা যাতে আইনগত ব্যবস্থা না নেন, সে জন্য ধর্ষকরা ধর্ষিতার পরিবারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা ৩টি সাদা কাগজে ধর্ষিতা ও তার বাবাকে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেন।

পিরোজপুরে এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের সময় ভিডিওচিত্রে সেই অশ্লীল দৃশ্য ধারণ করা হয়। এ ধর্ষণের ভিডিওচিত্রটি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলে। পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আহসান কবীর মামুন এই ছাত্রীকে ধর্ষণের সময় তার বন্ধুদের দিয়ে ভিডিওচিত্রটি ধারণ করে। ধারণ করা ধর্ষণদৃশ্যগুলো সিডি করে বাজারজাত করা হয়।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ ঢাকার সদরঘাটে ১১ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে উদ্ধার করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৭ নং ওয়ার্ডে ওই কিশোরীকে চিকিৎসা দেয়া হয়।

৩ অক্টোবর ২০০৯ নারায়নগঞ্জ জেলার ফতুল্লা এলাকার এক নববিবাহিত নারী তার স্বামীকে নিয়ে পাগলার নুরবাগে বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে গেলে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী আব্দুল হক ওরফে হক্কার নেতৃত্বে শরীফ, আমজাদ, স্বপন, তাজুল ইসলাম, ওসমান মোল্লা ও সুমন তাকে তুলে নিয়ে চান মিয়ার বাড়িতে গণধর্ষণ করে। পুলিশ এ ঘটনায় ৩ ধর্ষক আমজাদ, তাজুল ইসলাম ও ওসমান মোল্লাকে গ্রেফতার করলেও মূল আসামি আব্দুল হক ওরফে হক্কাকে গ্রেফতার করেনি।

২৯ অক্টোবর ২০০৯ ভোর রাতে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার কমলাপুর গ্রামে দু®কৃতিকারীরা ঘুমিয়ে থাকা দুই বোন শিলা ও শিমুলির মুখে এসিড ছুড়ে মারে। এসিডে শিলা ও শিমুলির চোখ, মুখ গলা ও শরীর ঝলসে যায়। এসিডে পাশে শুয়ে থাকা শিমুলির ২১ মাসের মেয়ে জ্যোতির চোখের পাতা ও মাথায় ক্ষত হয়। এসিডে শরীর ও মুখ ঝলসে যাওয়ার খবরে ওইদিনই বিয়ে ভেঙে যায় শিলার।

১৭ নভেম্বর ২০০৯ নোয়াখালী জেলার কবিরহাটে মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে (১২) গণধর্ষণ করে ১২ যুবলীগ কর্মী। গণধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী দীর্ঘদিন নোয়াখালীর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। ধর্ষণের ঘটনায় পরিবারটি বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় যুবলীগ কর্মী হেদায়েত উল্লাহ ও জহির উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও অন্যদের ব্যাপারে তখন উদাসীন ছিল।

১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ একদল ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করেছে। আনন্দমোহন কলেজের শতবর্ষ পূর্তি উৎসব শেষে তৃতীয় দিনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের কলেজ শাখা ও ছাত্রসংসদ আয়োজিত কনসার্ট চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্তে এই নির্যাতনের সত্যতা বেরিয়ে এসেছে।

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে এক ছাত্রীকে কটূক্তি করে ছাত্রলীগের মাস্টারদা সূর্যসেন হল, মুহসীন হল ও কবি জসীম উদ্দিন হলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় ছাত্রীর সঙ্গে থাকা অভিভাবকরা এর প্রতিবাদ করেন। পরে ছাত্রলীগ কর্মীরা ভিসির বাসভবনের সামনে তাদের গতিরোধ করে। এরপর অশালীন ভাষায় গালিগালাজ এবং ওই ছাত্রী ও তার অভিভাবকদের আটক রেখে হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে।

২০১২ সালের ৬ জানুয়ারি কলেজ ছাত্রী এক নৃত্য শিল্পীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আলোচনায় আসে পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অভি। অভিযোগ ওঠে, প্রেমিকার নগ্ন ছবি সে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়।

২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা মিছবা জামান কর্তৃক ধর্ষিত হন এক নারী। একই বছর ২৪ জানুয়ারি সরাইলে যুবলীগ ক্যাডার জাকির কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হন এক তরুনী।

২০১২ সালের ৫ জুলাই ভর দুপুরে সখীপুর বাজারে খাতা কিনতে গিয়েছিলো একটি মেয়ে। বাড়ি ফেরার পথে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করে উপজেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ধর্ষণের ভিডিও চিত্রও ধারণ করা হয়।

১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ দৈনিক দিনকালে প্রকাশ, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। পাশবিকতার শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছাত্রী এমনকি শিশুরাও। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটছে বহু। অনেক ক্ষেত্রেই ঘটছে লাশ গুম করার ঘটনা। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে নারীকে পুড়িয়েও হত্যা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হতে হচ্ছে অভিভাবকদের। মোট কথা, দেশে এখন নারী নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটছে তা রীতিমত লোমহর্ষক ও বীভৎস।

২০১১ সালে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে অধিকারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওই বছর তিন হাজার ৪৭৫ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের রেকর্ড অনুযায়ী ২০১১ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৩৪৪টি এবং ২০১২ সালে সে সংখ্যা নভেম্বর পর্যন্তই দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৪০৭-এ। ডিসেম্বর মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় আড়াইশ। মোট হিসাবে যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

(সংগৃহীত)

বিষয়: বিবিধ

২০৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File