''আমার ঘরের চাবি পরের হাতে''

লিখেছেন লিখেছেন Hossain Al Irfan ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:২৬:০৮ সকাল

ফাঁসির ব্যাপারটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। অপরাধীর বিচার হবে-এটা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কোনো আপত্তি কখনও করেনি। আপত্তিটা উঠেছে মূলত গণআকাঙ্খার সাথে সরকারের কৌশলী আচরণকে কেন্দ্র করে। বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে শুরু থেকে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আন্দাজ করা যাচ্ছিল। নির্বাচনের সব রকম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তথাকথিত সাংবিধানিক নিয়মে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতালিপ্সার নজিরবিহীন রাজনীতি শুরু করেছে, তাতে বিচারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কালিমা এড়াতে পারেনি।

জামায়াত স্বাভাবিকভাবেই এটাকে জুডিশিয়াল কিলিং আখ্যায়িত করে ব্যাপক সহিংসতার পথ ধরে। ফাঁসির পরে সারা দেশে যেন লাশের উৎসব শুরু হয়। সরকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন অংশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে নির্মূলের রাজনীতি বাস্তবায়ন করতে নেমে পড়েছে তা দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। পাল্টা আক্রমণের কৌশল দেখে স্পষ্টতই মানুষ বুঝে গেছে দেশে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। এই অবস্থায় কোনোকিছু নির্বিকারভাবে পর্যালোচনার স্থিতিশীলতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। যথারীতি শাহবাগ আগের ভূমিকায় আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবারের ফিরে আসাটা আরও ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। এই দিকটি নিয়ে আমরা কিছু কথা বলব আজকে।

বাংলাদেশ কিম্বা বর্তমান বিশ্বের কেউ আর '৭১ সালের বাস্তবতায় নেই। কিন্তু তাই বলে '৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা যাবে না তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিচার আমরা চাই। বিচার হতে হবে। কিন্তু সেটা বিচারই হতে হবে। কোনো প্রেশার গ্রুপকে সংযুক্ত করে বিচার নিয়ে রাজনীতি হলে সেটা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বেইমানি। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সীমাহীন সম্ভাবনা চিরতরে বিনষ্ট হয়। জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে চলমান রাজনৈতিক ক্ষমতার হিংসার আলোকে। ফলে জাতীয় চেতনার নামে একতরফা জবরদস্তি বা যেটাকে আমরা ফ্যাসিবাদ বলে জানি তা হাজির হয়। এর মধ্যে কোনো ইসলামী দলের নেতাকে ফাঁসি দিয়ে চেতনার জোয়ার তুলে ক্ষমতার রাজনীতি যে বিভাজন তৈরি করে তা ধর্মযুদ্ধের পরিবেশ প্রস্তুত করে দেয়। তখন মুখোমুখি দাঁড়ায় ইসলাম ও জাতীয় চেতনা।

কিন্তু এটা এত সরলভাবে ঘটলে আতংকিত হওয়ার মহান কোনো কারণ ছিল না! ব্যাপারটা আমদের নিজেদের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। মার্কিন রাজনীতির ছক অনুযায়ী আমরা যদি ব্যাপারটা খেয়াল করি তাইলে পরস্থিতি যা ইঙ্গিত করে তাতে আঁতকে না উঠে উপায় নাই।

আমরা দেখেছি, ওয়ার অন টেররের প্রজেক্টে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন ইন্টারভেনশন হয় ইসলামপন্থি জাতীয়তাবাদীদের কাজে লাগিয়ে। সরকারের ফ্যাসিবাদি আচরণের কারণে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার রাজনীতি করা একটি দলকে নির্মূল করবার কারণে সমাজে একটা বদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলকে তুরুপের তাসের মত উড়িয়ে দিচ্ছে লীগ সরকার। এই জবরদস্তিতে কৌশলে সেনাবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সৈনিক মর্যাদার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই সতর্ক। কিন্তু এখকার সেনাবাহিনীর পুলিশি ভুমিকা সেনার ইজ্জতের দিক থেকে যেমন হুমকি, তেমনি জনমানুষ এই সেনাকে সরকারের খেয়ালখুশির পুতুল বলে মনে করবে। দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর এই ভূমিকায় আহত বোধ করবে সন্দেহ নাই।

এই অবস্থায় পাল্টা প্রতিরোধ যেটা গড়ে উঠবে বা যারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াইয়ে শামিল হবে সেটা কোনো না কোনো ভাবে ইসলামী শক্তি। তার নাম যাই হোক তার সাথে ইসলামের কোনো না কোনো যোগ আছে। এই ধারার ইসলামী আন্দোলন যেন মার্কিন আধিপত্যকে কোনোভাবেই হাল্কা করতে না পারে তার জন্য ৯/১১-এর পরে আমেরিকা একটা প্রকল্প চালু করে এর নাম ‘র‍্যান্ড’ প্রজেক্ট। এতে সালাফিস্ট ধারাকে উৎসাহিত করা হলেও মূলত প্রাধান্য দেয়া হয় পশ্চিমা ধাচের গণতন্ত্র মেনে যেন মুসলিম দেশগুলো একটা আধুনিকতাবাদি পুঁজিবাদের অনুকূলে রাষ্ট্রকাঠামো দাঁড় করাতে পারে।

সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিওগুলোকে ব্যাপক তহবিল সবারহ করা হয়। এর টেস্ট কেইস আকারে ঘটানো হয় আরব স্প্রিং। বলাই বাহুল্য এই ‘র‍্যান্ড’ প্রকল্প ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আরব স্প্রিং আধুনিকতাবাদি পথ ধরে মুসলিম দেশগুলোকে পরিচালনার কাজে হাত না নিয়ে সেখানে বরং বিভিন্ন জেহাদি গ্রুপ শক্তিশালী ভিত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটা উল্টা ফল ফলেছে।

শুরুতে অনেকে শাহবাগকে ‘র‍্যান্ড’ প্রজেক্টের সাথে যুক্ত বলে অনুমান করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতেই পরিষ্কার হল, এই অনুমানের কোন ভিত্তি নাই। বরং গেইমটা উল্টা দিক থেকে দেখা যেতে পারে। শাহবাগ না এখন বিবেচনায় চলে আসবে শাপলা। অবশ্যই অগ্রভাগে থাকবে জামায়াত। যদিও আমরা জানি, জামায়াত আর হেফাজত এক না। কিন্তু আদর্শের দ্বন্দ্ব আর লড়াইয়ের মাঠ এক না -এটাও আমরা জানি। কিন্তু কোনো মার্কিন ছক হুবহু কাজে আসবে না তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। কারণ অলরেডি জিহাদি সংগঠন তালেবান গণজাগরণকে থ্রেট করে বসেছে। সাম্প্রতিক এক ভিডিও ভাষণে আলকায়েদা প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরী বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এই ঘটনা অবশ্যই অতি গুরুত্বের সাথে আমাদের আমলে নিতে হবে। তিনি সেখানে বলছেন, “বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেখানে সরকার আলেমদের শহীদ করছে, তাদেরকে জেলে বন্দী করে রাখছে, নবী করিমকে (সা.) নিয়ে কটুক্তিকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, হাজার হাজার সাধারণ মুসলমানদেরকে শহীদ করা হচ্ছে।’’ [http://www.youtube.com/watch?v=2CryRD4OTb8]

ফলে ‘র‍্যান্ড’ প্রজেক্ট এর মতো কোনোকিছু বাংলাদেশে করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবে এই বিষয়ে আগাম কথা বলার কিছু নাই। মাঠের লড়াই তো আর সবসময় বইয়ে ত্তত্ব মেনে হয় না। গ্র্যান্ড ডিজাইনের সাথে পরিচয় থাকাটাই আমাদের জন্য প্রাথমিক কাজ। এই প্রজেক্ট যে কোনো কাজে আসবে না তা আল-জাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইউসুফ আল কারযাভী পরিষ্কারভাবে বলে দেন, “আমেরিকা তার সুবিধার জন্য একটা ইসলাম চায়। কিন্তু সেটা আর ইসলাম হবে না। সেটা হবে আমেরিকান ইসলাম।''

তিনি আরও বলেন, চরমপন্থা ৯/১১-র ঘটনার আগে থেকেই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। চরমপন্থীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। শুধু মুসলমানদের মধ্যে চরমপন্থা আছে, এটা মোটেও ঠিক নয়। চরমপন্থীরা ইহুদীদের মধ্যেও আছে। চরমপন্থীরা রবিনকে হত্যা করেছে। চরমপন্থার আরো বড় বড় উদাহরণ রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা দুর্ঘটনা। ব্রিটেন, জাপান, ভারতসহ দেশে দেশে চরমপন্থীরা রয়েছে। তাহলে কেন মূলত ইসলামের সাথে চরমপন্থা ও সহিংসতার অপবাদ জুড়ে দেয়া হচ্ছে? এটি ভয়াবহ অবিচার” [আল-কারযাভী: আল-জাজিরা,বিন কিন্নাহ-এর সাথে আলাপ]

সেই দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা নীতিগত অবস্থান আমেরিকার আছে। এটা বোঝা যায়, জামায়াতের সাথে তাঁদের সম্পর্কের ধরণ দেখলে। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের উত্থান এই সম্পর্কের ধরণে নতুন ডাইমেনশান তৈরি করেছে। ফলে বাংলাদেশের ইসলাম যখন রাজনৈতিক ময়দানে হাজির এবং গৃহযুদ্ধের অবস্থা বিরাজ করছে, এই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদের নীতি আমাদের ছেড়ে দিবে না তা হলফ করে বলতে পারি।

ইতিমধ্যে ২৫ নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১১৫ জন নিহত হয়েছে। এদের বেশিরভাগ জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। অন্যদিকে বাংলাদেশে ইসলামের কোনো ধরণের জাগরণ হলে এর প্রভাব পড়বে গোটা বিশ্ব-ব্যবস্থায়। সবচেয়ে হুমকিতে পড়বে ভারত। আমেরিকা ৯/১১ এর পরে মুসলমানদের ব্যাপারে কোনো একতরফা বিবেচনা আর বজায় রাখেনি। ইসলামের সেকুলার ধারাকে ক্ষমতার রাজনীতে সে বরাবরই উৎসাহিত করে আসছে। এখন কী ভুমিকা নেবে তা দেখবার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে, বলা যায় দুইটা অপশন সামনে আছে, এক.হাসিনাকে যে কোন মূল্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এবং বিএনপি-জামায়াত জোটকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। ২. শেখ হাসিনা যদি নির্মূলের পথ থেকে সরে না আসে তাহলে যে ইসলামী জাগরণের সৃষ্টি হবে তার সুযোগে ওয়ার আন টেররের প্রকল্পের আদলে বাংলাদেশে মার্কিন খবরদারি বৈধ করা। প্রথম সমাধানের দিকে এখনও পশ্চিমা দেশগুলো বেশি মনযোগী।

আর দ্বিতীয় ধাপটি চূড়ান্ত অ্যাকশন হিসেবে বিবেচনায় আসবে। কিন্তু কোনোভাবেই ভারতের হাতে দক্ষিণ এশিয়ার খবরদারি দেয়া যাবে না। ভারতের ব্যাপারে কঠোর মার্কিন মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেবযানীকে উলঙ্গ (স্টিভ সার্চ) করা নিয়ে ভারতের প্রতিবাদের প্রতি ভ্রক্ষেপ করেনি আমেরিকা। ভারতের সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিনীদের এই কঠোর অবস্থান অনেককে অবাক করেছে। কিন্তু তাঁদের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে বিষয়টাকে আর অস্বাভাবিক মনে হবে না। বিখ্যাত মার্কিন পররাষ্ট্র ব্যাক্তিত্ব হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর সুবিদিত ডিপ্লোমেসি বইতে বলেন, “Almost as if according to some natural law, in every centuty there seems to emerge a country with the power, the will, and the intellectual and moral impetus to shape the entire international sestem in accordance with its own values.”

[The New world Order, DIPLOMACY; Henry Kissinger: SIMON&SCHUSTER PAPERBACKS, NEWYORK edition]

এই শতাব্দী মার্কিন আধিপত্যের শতাব্দী এটা তাঁরা প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই মনে করে। বলাই বাহুল্য এই শিক্ষা ইউরোসেন্ট্রিক শিক্ষা। পরে কিসিঞ্জার ইউরোপের অন্য দেশগুলোর আধিপত্যের ফিরিস্তি হাজির করে এখনকার মার্কিন আধিপত্য যে গোটা বিশ্বব্যবস্থার জন্য খুব স্বাভাবিক -এই আলোচনা করেন। এই সাম্রাজ্যিক বাসনার দিকে যদি আমরা খেয়াল রাখি তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব আগামী দিনে আমাদের সামনে যে লড়াই হাজির হচ্ছে তাতে মার্কিন হস্তক্ষেপ অবধারিত। এই লড়াইয়ে আমরা কী করব তাই দেখবার বিষয়। আরামপ্রিয় দ্বি-দলীয় ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে এই প্রথম বাংলাদেশে নয়া বাস্তবতা বড়ই অসময়ে হাজির হচ্ছে।

ফলে এই জাতীয় প্রতিরোধ ইসলামের চেহারা যেমন নিবে, এর সাথে দুনিয়ার অন্য ইসলামী লড়াকু শক্তিও শামিল হবে। এটাকে থামাতে এবার পরাশক্তির হস্তক্ষেপের পথে আর কোনো বাঁধা থাকবে না। ফলে যতই মনে হোক জামায়াতের পক্ষে আমেরিকা আছে, বিএনপির পক্ষেও আছে। খোলা চোখে যতই মনে হোক এক ভারত ছাড়া আর সবাই তাদের পক্ষে আছে, ব্যাপারটা তেমন সরল না। মার্কিন আধিপত্য কোনো সুযোগকে হাতছাড়া করবে -এমনটা মনে করার কোন কারণ নাই। এটা আমি বলছি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে। বাংলাদেশে হুবহু একই ঘটনা ঘটবে তা বলছি না। প্রত্যেক ঘটনার কিছু সৃষ্টিশীল ডাইমেনশান থাকে, যা আগাম বলে দেবার কিছু নাই।(সংগৃহীত)

বিষয়: রাজনীতি

১৩১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File