ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব-০২

লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৭ অক্টোবর, ২০১৪, ০৯:৫৫:১৫ সকাল

বিগত দু’শত বছরের ইসলামী ইতিহাসে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অথচ ইতিহাসে এ আন্দোলন যেমন একটি ইতিবাচক সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসাবে নন্দিত হয়েছে, তেমনি শুরু থেকে অদ্যাবধি এ আন্দোলন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে একটি বড় অংশের তীব্র বিরোধিতা ও শত্রুতার শিকার হয়েছে। একদিকে একদল নামধারী মাযহাবী, পীরপন্থী আলেম-ওলামা এ আন্দোলনকে ইসলাম বহির্ভূত প্রমাণ করার জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে; অন্যদিকে পশ্চিমারা ও তাদের খুদ-কুড়ো খাওয়া এক শ্রেণীর মুসলমান তাদের ‘মুক্তবুদ্ধি’ দর্শনের জন্য বিপজ্জনক চিহ্নিত করে। এ আন্দোলনকে পশ্চাদমুখী, চরমপন্থী, মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে এর প্রভাবমুক্ত রাখার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। অধুনা পশ্চিমা বিশ্বের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যু্দ্ধে’র প্রধান টার্গেট হ’ল এই আন্দোলনের ভাবানুকূল বিশ্বের বিভিন্ন আদর্শিক আন্দোলনসমূহ। যাকে তারা ‘ওয়াহ্হাবীজম’ ও ‘সালাফীজম’ বলে আখ্যায়িত করে। এসকল প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আলোচ্য নিবন্ধে এ আন্দোলনের পরিচিতি ও মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, একে মানুষের চোখে হীনকরভাবে দেখানোর জন্য বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে এ আন্দোলনকে ‘ওয়াহ্হাবী’১০

আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা পরে ইউরোপীয়দের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায় (একই উদ্দেশ্যে এ নামটি পাক-ভারত উপমহাদেশের ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের সাথেও জুড়ে দেয়া হয়েছিল)। এতদসত্ত্বেও সমধিক প্রসিদ্ধির কারণে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে প্রচলিত এই নামটিই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

ওয়াহহাবী আন্দোলনের পরিচয় :

নামকরণ :

আগেই বলা হয়েছে, ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ নামকরণটি এ আন্দোলনের উদ্গাতা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বা তাঁর অনুগামীদের প্রবর্তিত নয়। পরবর্তী ঐতিহাসিকরা ভুলক্রমে হোক কিংবা বিদ্বেষবশতঃ হোক এ আন্দোলনকে এই নামে পরিচিত করে তুলেছেন। এটা মূলতঃ এ আন্দোলনের বিরোধীদের পক্ষ থেকে গালি স্বরূপ ব্যবহার করা হয়। হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ এ সম্পর্কে বলেন, ‘ওয়াহ্হাবিয়্যাহ বিশেষণটি এ আন্দোলনের অনুগামীরা সৃষ্টি করেনি। বরং তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পৃথক করার জন্য এটা ব্যবহার করে যেন মানুষ তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে এবং শ্রোতারা মনে করে যে, এ আন্দোলন প্রচলিত বড় বড় চারটি মাযহাবের বিপরীতে পঞ্চম একটি মাযহাব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এ আন্দোলনের কর্মীরা নিজেদেরকে ‘সালাফী’ এবং তাদের দাওয়াতকে ‘সালাফী দাওয়াত’ বলে আখ্যায়িত করাকেই অধিক পসন্দ করতেন।’’১১

এই ঐতিহাসিক ‘ভুল’ অথবা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ অভিধাটি সারাবিশ্বে আজও পাকাপোক্তভাবে বিদ্যমান। ফলে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বের যে দেশেই ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলন তথা নিখাদ তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবানকারী আন্দোলন পরিদৃষ্ট হয়, সেখানেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিচ্ছিন্ন দল হিসাবে দেখানোর জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ ট্যাগ লাগিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়।

বর্তমান ওবামা প্রশাসনের কাউন্টার টেরোরিজম উপদেষ্টা Quintan Wiktorowicz তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা পেপার Anatomy of the Salafi Movement-এ লিখেছেন, ‘সালাফী মতবাদের বিরোধীরা প্রায়ই এ মতবাদকে বহিরাগত প্রভাবজাত মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে সম্বোধন করে। তাদের উদ্দেশ্য এই মতাবলম্বীদেরকে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের অনুসারী’ হিসাবে পরিগণিত করা। সাধারণতঃ যেসব দেশে সালাফীগণ সংখ্যায় স্বল্প এবং স্থানীয় অধিবাসীরা ধীরে ধীরে তাদের মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, সেসব দেশে তাদেরকে ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।১২

অনুরূপভাবে A. J. Arberry, George Rentz প্রমুখ প্রাচ্যবিদের গবেষণায় এবং স্বীকৃত কয়েকটি বিশ্বকোষে এই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করা হয়েছে।১৩

প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের বিশেষ কোন নাম ছিল না। তবে সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আহবানকারী হিসাবে এটি পরবর্তীতে ‘সালাফী আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে।

১০. এটি একটি অপপ্রয়োগ (misnomer)। কেননা আন্দোলনের উদ্গাতা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের নামেই যদি এই নামকরণ করা হয়ে থাকে, সে হিসাবে বড় জোর একে ‘মুহাম্মাদী আন্দোলন’ বলা যেত। কিন্তু অযৌক্তিকভাবে তাঁর পিতার নামানুসারে ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ নামকরণ করা হয়েছে। মাসউদ আলম নাদভীর মতে, প্রথম এ ভুলটি করেন John Lewis Burkhardt (১৭৮৪-১৮১৭ খৃঃ) নামক এক ইউরোপীয় পর্যটক। এরপর তা বিভিন্ন লেখকদের মাধ্যমে জনসমাজে প্রচার পায় (দ্রঃ মাসঊদ আলম নাদভী, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব : মুছলিহুন মাযলূমূন ও মুফতারা আলাইহ, উর্দূ থেকে আরবী অনুবাদ: আব্দুল আলীম আল-বাসতুভী (রিয়াদ : ১৪২০ হিঃ) পৃঃ ১৯৪; এ.জেড.এম শামসুল আলম, প্রবন্ধ : ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ও ওয়াহ্হাবী মতবাদ’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ঢাকা : ৪৪ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ২০০৫, পৃঃ ২১০।

১১. হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়েখ, প্রবন্ধ : আল-ওয়াহ্হাবিয়াহ ওয়া যাঈমুহা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, গৃহীত : ফরীদ ওয়াজদী, দায়েরাতু মা‘আরিফিল ক্বারনিল ইশরীন (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ৩য় প্রকাশ), পৃঃ ৮/৮২১।

১২. Quintan Wiktorowicz, "Anatomy of the Salafi Movement" in "Studies in Conflict & Terrorism" USA, Vol. 29, Issue. 3 (2006), P. 235.

১৩. Encyclopedia of Islam and the Muslim World, Editor in Chief Richard C. Martin, V-2 (New York : Macmillan Referance, 2004), P. 727.

(আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব)

সূত্র- আতত্বাহরীক

বিষয়: বিবিধ

১০৯৩ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

278575
২৭ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১০:৪০
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চালিয়ে যান। গোমরাহীতে লিপ্ত মুসলমানদের সচেতন করার জন্য এমন লেখার প্রয়োজন রয়েছে।
278607
২৭ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০১:৫৪
আনিসুর রহমান লিখেছেন : Very rich post specially putting supporting evidence with Ref.
Excellent
278701
২৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৮:০২
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাইজান, বড় অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন৷নিয়মিত লিখুন৷ ধন্যবাদ৷
278757
২৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:২৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
ওয়াহাবি শব্দটি সবদিক থেকেই ভুল।
279324
২৯ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:০০
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : একমত। ওয়াহাবী শব্দটা প্রথম দিয়েছে বিলাতিরা। আর আমার দেশের সম্মানীত কাওমী ও মাজার পন্থী মানুষগুলো এটাকে গ্রহণ করেছে।
ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File