কবি ফররুখঃ সাত সাগরের মাঝি

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:০২:১০ দুপুর

বৃষ্টি এল কাশবনে,

জাগল সাড়া ঘাসবনে।

বকের সারি কোথায়রে?

লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।

গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,

বৃষ্টি বাদল দেয় দোলা।


....................

.....................

-হৃদয়ের তন্ত্রীতে সুর তোলা এই অসাধারণ ছড়াটি যার সৃষ্টি তিনি হলেন কবি ফররুখ আহমদ।



অমিত প্রতিভাবান কবি ফররুখ আহমদ এর ৪০ মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
মহিয়সী এই কবির লেখনী আজো মুসলিম সমাজে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

[/b]

জন্ম, শিক্ষা, জীবিকা -

ফররুখ আহমেদের জন্ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে (তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার।

তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ-এর দশকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।

১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ 'উপহার' নামে একটি কবিতা লেখেন যা 'সওগাত' পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।

ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তাঁরা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান [আহমদ আখতার], সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।

কর্মজীবন ও মৃত্যু-

ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কোলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক 'মোহাম্মদী'-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে আমৃত্যু কর্মরত ছিলেন। ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায়।

রচনাশৈলীঃ



সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় 'কবি'। ফররুখ আহমদ কিছু সনেট রচনারও করেছেন। তাঁর রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যা মাসিক সওগাত-এ পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন : "গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"

সাহিত্য কর্মঃ

কাব্যগ্রন্থ

সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪)

সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২)

নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১)

মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩)

ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি, ১৯৬৩)

হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬)

নতুন লেখা (১৯৬৯)

কাফেলা (অগাস্ট, ১৯৮০)

হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)

সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩)

দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪)[১০]

শিশুতোষ গ্রন্থ

পাখির বাসা (১৯৬৫)

হরফের ছড়া (১৯৭০)

চাঁদের আসর (১৯৭০)

ছড়ার আসর (১৯৭০)[১১]

ফুলের জলসা (ডিসেম্বর, ১৯৮৫)

পুরস্কারঃ

ইসলামী রেনেসাঁর এই কবি ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক "প্রাইড অব পারফরমেন্স" এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাঁকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। সাত সাগরের মাঝি তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি কর্ম আর সেই সৃষ্টিকর্মের অনবদ্য সৃষ্টি পাঞ্জেরী । তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে পাঞ্জেরী কবিতাটি তুলে ধরা হলো পাঠকদের উদ্দেশ্যে।



রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?

সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে?

তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;


অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে

কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?

এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব

তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব

অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।

তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,

বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,

বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।

আহা, পেরেশান মুসাফির দল।

দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে

নিরাশায় ছবি এঁকে!

পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে

চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?

তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

একাকী রাতের গান জুলমাত হেরি!

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,

দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,

আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি

দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।

মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।

কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।

সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,

ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।

ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি

রোনাজারি ক্ষুধিতের!

ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!

ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।

পাঞ্জেরি!

[b]

জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,

জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!

দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!

বিষয়: সাহিত্য

১৩৬৩ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

275955
১৯ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০১:১৬
ফেরারী মন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ। কেমন যেন আমি অন্য কবিদের থেকে ফররুখের কবিতা পড়ে মজা পাই কারণ তার কবিতায় আমি তেজোদীপ্ত হতে পারি।
১৯ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০২:৩২
219894
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ফররুখ এর কবিতার অন্য রকম একটি স্বাদ আছে। ছড়াগুলিও অসাধারণ।
275971
১৯ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০২:০৯
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..


জন্ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে
৪০ তম জন্মবার্ষিকী (?) আজ।
Surprised Surprised Loser

আল্লাহতায়ালা তাঁকে জান্নাতে উচ্চমর্যাদায় রাখুন

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
১৯ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০২:৩১
219893
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ওয়ালাইকুম সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ...।
অনেক ধন্যবাদ ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য। আসলে মৃত্যুবার্ষিকী হবে। ঠিক করে দিয়েছি।
276088
১৯ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২১
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাল লাগল, আপনাকে ধন্যবাদ৷
276114
১৯ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৮:৩৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
ফররুখ কে নিয়ে কোথাও কোন অনুষ্ঠান হচ্ছেনা।অনেকে বলেছেন আমাকে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা আছে। স্বাধিনতার পর পর যখন তিনি সরকারের চক্ষুশুল তখনও তাকে কেউ ব্যাক্তিগত ভাবে অসন্মান করেনি। সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার যিনি তখন রাষ্ট্রপতি সচিবালয় এর কর্মকর্তা ছিলেন লিখেছেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চেীধুরি নিজে তাকে পাঠিয়ে ফররুখ আহমদ এর খোজখবর নিয়েছিলেন।
অথচ গত শুক্রবার এক ষাঁড় চট্টগ্রামে একটি বইয়োর দোকানে আসা উপলক্ষে সারা শহরে পুলিশের কঠোর পাহারায় নাগরিক দুর্ভোগ চরমে উঠেছিল।
277443
২৩ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৬
ইক্লিপ্স লিখেছেন : পিলাচ পিলাচ পিলাচ Applause Applause Applause Applause Applause Applause Applause Applause Applause Applause Applause
288067
২৫ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৩১
ইশতিয়াক আহমেদ লিখেছেন : খুব সুন্দর লিখা ,পড়ে ভালো লাগলো
292016
০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৩৬
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : শিক্ষণীয় একটি পোস্ট। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File