শিরোনামহীন( অণু গল্প)একটি সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা আবলম্বনে

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৮ এপ্রিল, ২০১৮, ০৯:৪৬:৪৯ সকাল



বাইরে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে অন্ধকারের নেকাব। ব্যস্তঘন দিন পেরিয়ে এখন যে সময় মৌনতার। ডাঃ তাবিথ হালকা মিটমিটে আলোয় পেছনের বারান্দায় বসে আছেন বেশ অনেকক্ষন। বাইরে চেহারায় চুপচার শান্ত অবয়বের ছায়া। কিন্তু মনের ঘরে চলছে স্মৃতির নষ্টালজিয়া। ক্লিনিক হতে ফিরে ও মনটা যেন ওখানের সফেদ মৃত্যুর ঘোর লাগা পরিবেশেই আটকে আছে।বার বার মনে পড়ছে ১৭নং বেডের যুবকটিকে।আই.সি ইউতে পেসেন্টটির আজ ৩ দিন পেরিয়ে গেল। অথচ একই রকম স্থির অবস্থা। নেই কোন পরিবর্তন। নেই সামান্যতম জীবনের স্পন্দন। যেন ঝিম মেরে গেছে তার জীবনের চলার গতি। যেন কোন এক প্রশান্তির স্নিগ্ধ ছায়ায় লম্বা ঘুমে ডুবে গেছে ওর সমগ্র সত্বা। যেন ওর উপর কারো কোন দাবী নেই। পৃথিবীর কাছে ওর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু ঝরাপাতার দীর্ঘশ্বাস হয়ে কিংবা শিশিরের কান্না হয়ে মৃত্যুর কালো মৌনী পাথরের বুকে জীবনের সব কষ্ট গুলোকে নিয়ে আছড়ে পড়া । নিঃসন্তান তাবিথের চোখে ভাসছে সুদর্শন যুববটির মায়াভরা অথচ গভীরস্তব্ধতা আর গাম্ভীর্যে মুড়ে দেয়া করুণ মুখখানি। ওর ঘন চোখের পাপড়ি কি এক গভীর অভিমানে যেন অনিবারনীয় ভাবে মুঁদে আছে।

–কেন এত অল্প বয়সী তরুণের চেহারায় অশেষ যন্ত্রনার সাথে নিজকে নিঃশেষ করে ফেলার এই নীরব অপেক্ষা?ডাঃ তাবিথ শত ভেবে ও এর জবাব খুঁজে পাননি।

দেখতেই বুঝা যায় বেশ সম্ভান্ত পরিবারের। ওয়েটিং এ ভিড় করা আত্নীয় স্বজনদের দেখে ও তাই মনে হয়েছে। ক্রমাগত ওরা ডাক্তার তাবিথের কাছ হতে অগননবার এই প্রশ্নই করেছে- ডাক্তার ও বাঁচবে তো? প্রয়োজনে আমরা পৃথিবীর যে কোন স্থানে ওকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে তৈরী। ডাঃ তাবিথ ও আড়ালহীন ভাবে বারে বারে এই জবাবই দিয়েছেন- দেখুন, পেসেন্টের অবস্থা মোটে ও ভালো নয়। আর কোথাও ছুটাছুটি করে কোন লাভ নেই। ও আর সারভাইব হবেনা।আপনারা চাইলে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।নিঃশেষ একজন মানুষকে শুধু শুধু লাইফ সাপোর্ট দিয়ে এখানে ফেলে রেখে কেন মিথ্যে সান্তনা খুঁজছেন? কিন্তু নাছোড় আত্নীয় স্বজনের দাবী মেটাতে মৃতপ্রায় যুবকটিকে বেঁচে থাকার মিথ্যে অভিনয় করাতে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ডাঃ তাবিথের চোখের পাতা ভিজে আসে- কেন এত সুন্দর একটি তরুণ এমনি করে ঝরে গেল?

-এই তুমি বারান্দায় বসে আছো? আর আমি তোমাকে খুঁজে মরছি। জানো কে এসেছে? আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী।...শায়লা। কানাড়া থাকে। গত ১৫/২০ দিন হল দেশে এসেছে। কি করে যেন আমাদের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। চল তো দেখা করবে।

স্ত্রী নীলার তাগাদায় তাবিথ পা চালায়। এই অসময়ের অতিথিকে অনিচ্ছা স্বত্তে ও স্বাগত জানাতে।

তাবিথকে দেখে ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ান- এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করছি। আই এ্যম এক্সট্রিমলি সরি। নীলা কপট অভিমানে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে-সেকি শায়লা তুই এমন ভাব করছিস যেন আমরা তোর পর। সেই যে আব্বার বদলি….এটা সেটা ব্যস্ততা মিলিয়ে তোর সাথে তো যোগাযোগের সুতাটি একেবারেই ছিঁড়ে গিয়েছিলো। বলতো, কি করে আমার ঠিকানা খুঁজে পেলি?এত দিন পর আমাকে মনে পড়লো?

শায়লা বলে- আসলে তোর বর ডাক্তার তাবিথের ক্লিনিক হতেই তোর বাসার ঠিকানা পেয়েছি। আর বলতে পারিস নিজের স্বার্থেই তোকে খুঁজে নিয়েছি। আমি তো ইনফ্যক্ট জানতামই না ডাঃ তাবিথ তোর হ্যজব্যন্ড। ওই যে আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু শিপলু ওই আমাকে এই তথ্য দিলো। আমি আসলে খুব বিপদে পড়েই তোদের কাছে এসেছি।

নীলা কিছু বলার আগেই ডাঃ তাবিথ কথা বলে উঠেন-এত রাতে ডাক্তারের কাছে কেউ তো আর এমনিতেই আসেন না। আপনি নিসংকোচে বলুন- কেন এসেছেন?

শায়লা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে- নীলা ,তোর মনে আছে আমার রেবা আপুকে?

- হ্যা তোর বড় আপা তাইনা? মনে থাকবেনা। আপার খুব সুন্দর ফুটফুটে একটি ছেলে ছিলো। আমাকে খুব পছন্দ করতো।

শায়লা সম্মতি দেয়- বাহ তোর তো বেশ মনে আছে। আমি আসলে কানাডা হতে দেশে এসেছি ওরই বিয়ে উপলক্ষে। জানিস তো আপার পর পর ৩টি বাচ্চার মৃত্যুর পর ওর জন্ম হয়। আমাদের কত যে আদরের। লিখাপড়া শেষ করে দুলাভাইর অসুস্থতার পর বাবার বিজনেস একাই ও বেশ দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছিলো। বেশ দেখে শুনেই আপা ওর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। মেয়েদের ফ্যামেলি ও বেশ ভালো।কিন্ত সব কিছু যে এমনি করে শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে……….কান্নার ঢেউ এসে শায়লার বাকি কথা গুলোর গতি রুদ্ধ করে দেয়। নীলা অবাক হয়ে ওর পিঠে হাত রাখে। ডাঃ তাবিথ সাহস যোগান –জ্বি আপনি বলুন।

শায়লা নিজকে সামলে নেয়- মাত্র এক সপ্তাহ আগে ওর বিয়ে হয়। সে কি আনন্দ হৈ চৈ। বিয়ের এক সপ্তাহ পর হানিমুনে ওরা সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা।কিন্তু……আসলে বিয়ের পর হতেই ওর নতুন বউ শ্রেয়াকে কেমন যেন আনমনা লাগতো। আমরা সেটাকে নতুন বউয়ের লাজুকতা হিসেবেই ধরে নিয়েছিলাম স্বাভাবিক ভাবেই। আর ছেলেটা ও আমাদের কিছুই বুঝতে দেয়নি। হয়তোবা ও নিজেই নিজেদের মধ্য বুঝা পড়ার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু হলনা। বিয়ের ৪ দিনের মাথায় শ্রেয়া পালিয়ে গেল। ওর অনেক আগ হতে এক যুবকের সাথে সম্পর্ক ছিলো। তার সাথেই। বুঝতেই পারছিস এত বড় লজ্জার ঘটনা। আমরা পুরোপুরি শকড। কায়েস এ যুগের ছেলে হয়ে ও অনেক বেশী কোমল,সংবেদনশীল আর সুক্ষ রুচির ছেলে ছিলে।তাই যতখানি আঘাত ওর বইতে পারার ক্ষমতা ছিলো তার চাইতে বেশী বইতে ও পারেনি।আমি ওকে খুব বুঝি। হয়তো নিজের লজ্জিত,বঞ্চিত আর পরাজিত মুখটাকে আমাদেরকে আর দেখাতে চাইছিলো না। হয়তো ভেবেছে, ওর জীবনের সব প্রতিষ্ঠা, নিজকে একটু একটু করে দীর্ঘদিনের চেষ্টা আর মননশীলতায় যে ভাবে গড়ে তুলেছিলো যা কিছু ছিলো আমাদের কাছে গর্বের তার সবকিছুই যে আজ মূল্যহীন হয় গেল।তাই অপ্রত্যাশিত এঘটনার ধাক্কা কাটাতে পারলতা। স্ট্রোক করে বসলো সাথে সাথে। এরপর হতেই……….

ডাঃ তাবিথের ভেতরটা কেঁপে উঠে। তাই শায়লার কথার মাঝখানেই মরীয়া হয়ে প্রশ্ন করেন- আপনি আই সি ইউর ১৭ নং বেড়ের পেসেন্ট কায়েসের কথা বলছেন নাতো?

শায়লা ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয় – হ্যাঁ ওই। জানেন,আমার আপার কিডনি স্বাভাবিক ভাবে কাজ করছে না বেশ কিছু দিন হতে। উনাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। আবার দুলাভাইর ও হার্টের সমস্যা আছে। আপা-দুলাভাইকে এখনো কায়েসের প্রকৃত অবস্থা আমরা জানাইনি। কি যে করবো? ১টি মানুষের ভুলের জন্য আরো ৩টি মানুষও মৃত্যুর মুখোমুখি।একটা কিছু করুন প্লিজ। একটা কিছু করুন। এজন্যই আমি এত রাতে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।ও যে আমাদের অস্তিত্বে এমন ভাবে মিশে আছে ওকে ছাড়া আমরা বাঁচবো কি করে? শায়লা নিজকে আর সংযত করতে পারে না। ওর উদগত অশ্রুরা কান্না হয়ে ঝরে পড়ে স্বশব্দে।

তাবিথ তার ডাক্তারী জীবনের চরম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি নিজকে দাঁড় করাতে কিছুটা সময় নেন।এরপর ধীরে ধীরে বলেন- দেখুন, জীবন মৃত্যুর মালিক তো উপরওয়ালা। আমরা তো নিমিত্তি মাত্র। আপনাকে বলতে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই সত্যি। হি ইজ নো মোর। আপনাদের অহেতুক রিকোয়েস্টের কারণেই ওকে আই সি ইউতে শুধু শুধু ফেলে রাখা হয়েছে।

আশাভঙ্গের বেদনার শায়লা আরো জোরে কেঁদে উঠেন।…………….

একসময় বিদায় নিয়ে নীশিথে পাওয়া মানুষের মত টলটলে পায়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান।

ঘটনার আকস্মিকতায় পাথর হয়ে পড়া নীলা জলভরা চোখে বলে- জানো, তাবিথ আমি কলেজে পড়ার দিনগুলোতে রেবা আপুদের বাসায় যখনই গিয়েছি এই বাচ্চাটি আমার এত ন্যওটা ছিলো । রেবা আপু প্রায়ই দুষ্টমি করে বলতেন- নীলা ,তোকে আমি কায়েসের শ্বাশুড়ি বানাবো। তোর মেয়ে হলে ওর সাথে বিয়ে দেব। নীল স্বশব্দে কেঁদে উঠে- তাবিথ, বল নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন?

তাবিথ নীলার ঘাড়ে হাত রেখে ধীরে ধীরে বলেন- না, নীলা। নিয়তির উপর আমরা অযথা দোষ চাপিয়ে দিয়ে জীবনের সত্যতাকে এড়াতে পারিনা। এ জীবন তো রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কোন জিনিস নয়।সবার প্রতি সবার দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। ওই মেয়ের পরিবার যদি আগে হতেই মেয়েকে এই রিলেশন তৈরীতে বাধা দিতেন। কিংবা সব জানার পর সত্যকে আড়াল করে মেয়েকে ওভাবে অনিচ্ছায় বিয়ে না দিতেন তবে আজকে হয়তো কায়েসের এত সুন্দর একটি জীবন ,একটি পরিবার এভাবে ঝড়ের মুখে পড়তো না। নিজের চিত্ত বৃত্তিকে প্রাধান্য দিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে তো পশুর সাথে নিজের তফাতটা আর রইলো না অসময়ের জন্ম না দিয়ে সময় থাকতেই আমাদের মূল্যবোধের শিক্ষা নিতে হবে।

নূর আয়েশা সিদ্দিকা(বিউটি)

জেদ্দা

বিষয়: বিবিধ

৮৮৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385087
০৮ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১০:৫৭
বাকপ্রবাস লিখেছেন : গল্পটা পড়লাম ফেবুতে, কমেন্ট করতে গিয়ে ভাবলাল ব্লগে গিয়ে করি।
১) খুব সুন্দর গল্প, জড়তাহীন গতিময়
২) অণুগল্প শিরোনামে একটু বলতে চাইছিলাম : সব ছোট গল্প অণুগল্প নয়, কিছু কিছু ছোট গল্প অণুগল্প। অণুগল্পের নির্দিষ্ট কোন সংঞ্জা না থাকলে কিছু বৈশিষ্ট আছে যেমন : (আামর ভাবনায়)
ক) গল্পের শেষটা যেন শুরু, যেখানে শেষ হবে সেখান থেকে মানুষের মনে নতুন একটা ভাবনা বা আকাংখ্যা তৈরী হবে
খ) অণুগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যেটা অণুগল্পকে অণুগল্পের মানে পৌঁছে দেয় সেটা হলো টুইস্ট। সবাইসে সাথে নিয়ে এসে এবং সবাই যখন বুঝে যাবে গন্তব্য এটাই হয় তার উল্টো। পাঠক যখন ধরে নেয় এমনটাই হতে যাচ্ছে কিন্তু শেষ লাইনে গিয়ে দেখা যায় যেটা কল্পানাও করেনি সেটাই হয়েছে
গ) অনেকেই ছোট আকারে গল্প লিখে মনে করে অণুগল্প, কিন্তু সেগুলো ছোট গল্পই
ঘ) ধরুণ আপনি ছাদে উঠলেন, রেলিং এ একটা কাক বসে আছে, কাক আপনার ভাল লাগেনা, আপনি দেখা মাত্রই হাত নাড়িয়ে তাড়িয়ে দিলেন, সেটা উড়ে যেতে লাগল, আপনি দেখতে পেলেন একটা কুকিল উড়ে যাচ্ছে। ভাবানায় পড়ে গেলেন, রেলিংএ কুকিল বসে? কেন তাড়িয়ে দিলাম, কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যটা কেন হারালাম.....
385088
০৮ এপ্রিল ২০১৮ রাত ১১:১৩
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : সুন্দর ও বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইলো।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File