মনে হচ্ছে, আমি আর বাঁচবোনা.... (২)

লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৪ জুলাই, ২০১৩, ০৯:২৯:০০ সকাল

তৃতীয় পর্ব দেখুন

ফাহিম তাসনিয়া গাড়ির পেছনে নিশ্চুপ বসে আছে। কোন শব্দ নেই। অন্য দিনের মত ভাই বোনের মাঝে আজ ঝগড়া নেই। চিমটি কাটা কাটি নেই। অভিযোগের সুরে তাসনিয়া বলছেনা

- এ মাম্মি দ্যাখ। ভাইয়া আমাকে মুখ ভেংচী দিচ্ছে।

- এ ফাহীম.. ধমক দিতে, মাম্মি আমি কি করিছি। ও খালি খালি আমার রিবুদ্ধে অভিযোগ করছে।

- তাসু। ও তোমার বড় ভাইনা।

- তোমরা খালি আমাকে বকা দাও। রাগ করে তাসনিয়া চুপ মেরে গেছে।

.. আজ তাদের মাম্মি অসস্থূ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। দুষ্টমি ও নেই।

আগামী কাল সকালে তাদের স্কুলের ক্লাশ টেষ্ট। কিন্তু মায়ের অসুস্থতায় পরীক্ষার কথা ভূলে গেছে। গলা শুকিয়ে কাষ্ট। নিস্পাপ শিশু দুটি গাড়ীর জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিছে প্রকৃতি দেখার ভান করছে।

রাস্তায় চলতে চলতে হাজারো কথা মনে উকি দিলেও বার বার এড়িয়ে যাচ্ছি। নাজুকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছি। ও বলেই যাচ্চে, আমার কেন এমন হল। ওতো সব কিছুই কন্ট্রোল করে চলি। আবার বড় দির্ঘশ্বাস ফেলে কতুগুলো কস্টের কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসতেই আমি পাশ কাটার চেষ্টা করছি।

ও খুব নরম মনের। জীবনে কাউকে কস্ট দিয়েছে কিনা তার জানা নেই। তাই আজ তার নিজের কাছে প্রশ্ন, আমার এমনটি হবে কেন? আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। সব পরীক্ষা আমার জন্য হবে কেন?

...এতক্ষণে হাসপাতালে গেটে এসে পৌছে গেছি। রাত আনুমানিক পৌনে বারোটা। হাসপাতালের বাহীরে নিরব নিস্তব্ধ। গাড়ীটা পার্ক করে বের হতেই দুর থেকে দেখছি, ডাক্তার সিহাব উদ্দীন আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। তার এ আগ্রহ আর সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসার ঢং দেখে মনটা ভরে গেল।

আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে সোজা রিসিপশনে নিয়ে গেল। আমার পকেটের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন

- আপনার ইকামাটা দিন।

- নেই।

- মানে?

- এক বছর হল মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে গেছে। স্পন্সার সমস্যা।

- আরে...তাহলে এখন কি করা যায়। মাথায় চুল খোচাতে খোচাতে ডাক্তার সিহাব উদ্দীন উপায় খুজছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নিজের পকেট হতে মানি বেগটা বের করে বলল

- ভাবী, আপনি ভেতরে বসুন। ভাই, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আসছি - বলে সোজা ভেতরে চলে গেলেন।

অজানা ভয় নিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে আছি। স্ত্রীকে বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি খুব চিন্তিত। শুধ বলছি, দুত্তরি। এটা কোন রোগই নয়। হয়তবা মাসল ব্যথা। কোন বিষয়ে ফাইনাল জানা ছাড়া এত ভয় করা উচ্তি নয়। তাহলে মনের বাঘেই তোমাকে কাবু করে ফেলবে। কিন্তু মন যতই অভয় দিকনা কেন, রোগীর মন যে মানেনা।

এতক্ষণে ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে দ্রত গতিতে ভেতর থেকে আসতে দেখে মনে হল, কিছু একটা করে এসেছে। রিসিপশনের পেছনের গেট দিয়েই সোজা ভেতরে চলে গেলেন। কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে ফিস ফিস করে কি যেন বললেন্। তার পর একটা কাগজ নিয়ে বের হয়ে এসে বললেন

- চলুন। কাজ হয়ে গেছে।

- মানে?

- আমার ইকামা দিয়ে ইমারজেন্সী ডিপার্টমেন্ট এর হেডকে বলেছি, আমার বন্ধুর স্ত্রীর সমস্যা। ইকামা নবায়ন করতে দিয়েছে। ভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। এমতাবস্থায় আমার ইকামা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যীস ডাক্তার ভ্রু না কুচকিয়েই অনুমতিটা দিয়ে দিল। হাসপাতালের যে অবস্থা, সৌদীরাও এখন ট্রিটমেন্ট নিতে হিমশিম খেতে হয়।

ইমারজেন্সীতে গিয়েই দুতিনটা নার্সকে এক করে নাজুকে আপন লোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম, নার্সগুলো নাজুকে দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুহুর্তেই কয়েকটা টেষ্ট করে ফেলল। টেষ্ট গুলো ফলাফল আসতে যাতে বিলম্ব না হয়, তাই ডাঃ সিহাব উদ্দীন নিজেই সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে রিপোর্টের অনুমোদন নিয়ে কম্পিউটারাইজড করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, আমাকে ফলো করুন। বিশাল হাসপাতালের আকা বাকা গলি দিয়ে হেটে কখনো ডানে, কখনো বামে, আবার কখনো লিফট বেড়ে চার তলায় নিয়ে গেলেন। বললেন, এখন যার কাছে যাবো, তিনি এ হাসপাতালের সব চেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট। সব চেকআপ সেরে সিরিয়ালে তার কাছে আসতে তিন দিন লাগে। তাই আপনাদের সরাসরি নিয়ে আসলাম।

সালাম দিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিস্তারিত খুলে বলে ফাইল নাম্বারটা দিলেন কম্পিউটারে সব রিপোর্ট দেখার জন্য। ডাক্তার এক নজর দেখে চেয়ার থেকে উঠে আমাদের নিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসলেন। নার্সকে বললেন একটি সীট খালি করে দিতে। কিছুক্ষণ পর নাজুর প্রেসার মাপতে মাপতে জানতে চাইলেন

- আপনার ব্যথাটা কোন দিকে?

- বা দিকে।

- এটি কি প্রথম?

- জ্যী।

- অন্য কোন রোগ আছে?

- আছে। ডায়াবেটিকস।

- সুগার কি কন্ট্রোলে?

- জ্যী।

- সিড়ি বেড়ে উঠতে কি ব্যাথা করে?

- না।

- জোরে হাটলে?

- না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন, ইকো টেষ্ট করতে হবে। এটি ছাড়া হার্টের গতিবিধি হুবহু বুঝা যায়না। আর হার্ট বিষয়ে অনুমান নির্ভর কোন সিদ্ধান্ত দেয়া বিপদ জনক ও বটে।

ডাক্তার সিহাবউদ্দীন পাশেই ছিলেন। বললেন, ইকো টেষ্টের জন্য তুমি যদি একটা অনুমোদন দিয়ে দাও, তাহলে ভাল হয়।

ডাক্তার রিসিপশনের একটি কম্পিউটারে নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে অনুমুতিটা দিয়ে দিলেন। এ হাসপাতালে যত রুগী ইমারজেন্সীতে এসেছে, সবার রিপোর্ট গুলো রিসিপশনে ডিস্প্লেতে রাখা কম্পিউটার স্ক্রীনে স্ক্রলিং হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম ৯০% রোগীর হার্টের সমস্যা।

ডাঃ সিহাব উদ্দীন হতে বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। ধনবাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসায় গিয়ে খাবার তেমন কিছু নেই। চুলোয় রাখা আধা পাকা তরকারী গরম করে খাওয়াই একমাত্র পথ। নাজু সন্তান দুটোর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলছে

- ওমারে মা। আল্লায় এমন রোগ দিয়েছে যে, আমার বাচ্ছাগুলোকে পর্যন্ত কষ্ট করতে হয়েছে।

- ওকে মাম্মি। কিচ্ছু হবেনা, ওরা সমস্বরে জবাব দিল।

ব্যাবাচ্যাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, নাজুর বুকের ব্যথা এখনও কমেনি।

গত রাতে আমার ঘুমটা বেশী ভাল হয়নি। কোন এক অজানা কারণে বার বার জেগে উঠেছি। মানসিক অস্থিরতার কারণে নাকডেকে গভীর ঘুমে অভ্যস্ত আমার ঘুম যেন অনেক পাতলা হয়ে গেছে। রাতে জেগে উঠতেই দেখছি - নাজু ঠিক আছে কিনা। ওর কোন কিছু হয়নি, এমনটি নিশ্চিত করতেই খুব সতর্কতার সাথে ডান হাতের আঙ্গুলটা ওর নাকের ডগার সামনে ধরে অনুমান করছি - নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা?

- না। মন মানেনা। ভাবছি আর কি টেষ্ট করা যায়? হুম। পাইছি। ইশারায় নিজের হাতটা ওর হাতের শিরার উপর রেখে বোদ্ধা ডাক্তারের মত চোখ দুটো বন্ধ করে রক্তের গতিবিধি অনুভব করছি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারছি হার্ট থেকে ছূটে আসা রক্তগুলো টিক টিক করে প্রবাহিত হচ্ছে।

আশ্বস্ত হলাম, ও ঠিক আছ্। কিন্তু বুকের ব্যথাটার কি অবস্থা জানা হলনা। থাক। জেগে উঠলে জানা যাবে। এভাবেই বার বার উঠে প্রতি রাতে ওকে দেখছি।

ইকো টেস্টের আরও তিনদিন বাকী। ইস। এর ভেতর যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। দুত্তরী। আল্লা ভরসা। কিচ্ছু হবেনা। না। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে পড়ছে নিজের চোখের সামনে হার্ট এ্যাটার্ক করে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। দুশ্চিন্তা এড়ানোর জন্য নিজেকে বার বার অভয় দিচ্ছি।

যাক, সময় অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল টেষ্ট। প্রতিটি মিনিট আর ঘন্টা গুনে গুনে আগামীকাল আজ হয়ে গেল।

আজ ইকো টেস্টের দিন। দুপুর একটায় গিয়ে প্যৌছতে হবে। রাস্তায় জ্যাম জনিত অনাকাঙ্খিত সমস্যা এড়ানোর জন্য বারোটায় গিয়েই উপস্থিত। পার্কিং এ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তার পর নিদিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ইকো টেস্টের ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করলাম। ইকো টেষ্টে বেশী সময় লাগেনি। কিন্থু ইকো টেষ্টের পর ডাক্তারের বক্তব্য শূনে মনে হল, সামনে কোন এক অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে। ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন, চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়। আপনারা বাসায় চলে যান। ইকো টেষ্ট নিয়ে আমি বড় ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দেবো কি ভাবে কি করা যায়। (চলবে)

ফাহিম তাসনিয়া গাড়ির পেছনে নিশ্চুপ বসে আছে। কোন শব্দ নেই। অন্য দিনের মত ভাই বোনের মাঝে আজ ঝগড়া নেই। চিমটি কাটা কাটি নেই। অভিযোগের সুরে তাসনিয়া বলছেনা

- এ মাম্মি দ্যাখ। ভাইয়া আমাকে মুখ ভেংচী দিচ্ছে।

- এ ফাহীম.. ধমক দিতে, মাম্মি আমি কি করিছি। ও খালি খালি আমার রিবুদ্ধে অভিযোগ করছে।

- তাসু। ও তোমার বড় ভাইনা।

- তোমরা খালি আমাকে বকা দাও। রাগ করে তাসনিয়া চুপ মেরে গেছে।

.. আজ তাদের মাম্মি অসস্থূ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। দুষ্টমি ও নেই।

আগামী কাল সকালে তাদের স্কুলের ক্লাশ টেষ্ট। কিন্তু মায়ের অসুস্থতায় পরীক্ষার কথা ভূলে গেছে। গলা শুকিয়ে কাষ্ট। নিস্পাপ শিশু দুটি গাড়ীর জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিছে প্রকৃতি দেখার ভান করছে।

রাস্তায় চলতে চলতে হাজারো কথা মনে উকি দিলেও বার বার এড়িয়ে যাচ্ছি। নাজুকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছি। ও বলেই যাচ্চে, আমার কেন এমন হল। ওতো সব কিছুই কন্ট্রোল করে চলি। আবার বড় দির্ঘশ্বাস ফেলে কতুগুলো কস্টের কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসতেই আমি পাশ কাটার চেষ্টা করছি।

ও খুব নরম মনের। জীবনে কাউকে কস্ট দিয়েছে কিনা তার জানা নেই। তাই আজ তার নিজের কাছে প্রশ্ন, আমার এমনটি হবে কেন? আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। সব পরীক্ষা আমার জন্য হবে কেন?

...এতক্ষণে হাসপাতালে গেটে এসে পৌছে গেছি। রাত আনুমানিক পৌনে বারোটা। হাসপাতালের বাহীরে নিরব নিস্তব্ধ। গাড়ীটা পার্ক করে বের হতেই দুর থেকে দেখছি, ডাক্তার সিহাব উদ্দীন আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। তার এ আগ্রহ আর সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসার ঢং দেখে মনটা ভরে গেল।

আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে সোজা রিসিপশনে নিয়ে গেল। আমার পকেটের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন

- আপনার ইকামাটা দিন।

- নেই।

- মানে?

- এক বছর হল মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে গেছে। স্পন্সার সমস্যা।

- আরে...তাহলে এখন কি করা যায়। মাথায় চুল খোচাতে খোচাতে ডাক্তার সিহাব উদ্দীন উপায় খুজছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নিজের পকেট হতে মানি বেগটা বের করে বলল

- ভাবী, আপনি ভেতরে বসুন। ভাই, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আসছি - বলে সোজা ভেতরে চলে গেলেন।

অজানা ভয় নিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে আছি। স্ত্রীকে বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি খুব চিন্তিত। শুধ বলছি, দুত্তরি। এটা কোন রোগই নয়। হয়তবা মাসল ব্যথা। কোন বিষয়ে ফাইনাল জানা ছাড়া এত ভয় করা উচ্তি নয়। তাহলে মনের বাঘেই তোমাকে কাবু করে ফেলবে। কিন্তু মন যতই অভয় দিকনা কেন, রোগীর মন যে মানেনা।

এতক্ষণে ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে দ্রত গতিতে ভেতর থেকে আসতে দেখে মনে হল, কিছু একটা করে এসেছে। রিসিপশনের পেছনের গেট দিয়েই সোজা ভেতরে চলে গেলেন। কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে ফিস ফিস করে কি যেন বললেন্। তার পর একটা কাগজ নিয়ে বের হয়ে এসে বললেন

- চলুন। কাজ হয়ে গেছে।

- মানে?

- আমার ইকামা দিয়ে ইমারজেন্সী ডিপার্টমেন্ট এর হেডকে বলেছি, আমার বন্ধুর স্ত্রীর সমস্যা। ইকামা নবায়ন করতে দিয়েছে। ভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। এমতাবস্থায় আমার ইকামা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যীস ডাক্তার ভ্রু না কুচকিয়েই অনুমতিটা দিয়ে দিল। হাসপাতালের যে অবস্থা, সৌদীরাও এখন ট্রিটমেন্ট নিতে হিমশিম খেতে হয়।

ইমারজেন্সীতে গিয়েই দুতিনটা নার্সকে এক করে নাজুকে আপন লোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম, নার্সগুলো নাজুকে দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুহুর্তেই কয়েকটা টেষ্ট করে ফেলল। টেষ্ট গুলো ফলাফল আসতে যাতে বিলম্ব না হয়, তাই ডাঃ সিহাব উদ্দীন নিজেই সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে রিপোর্টের অনুমোদন নিয়ে কম্পিউটারাইজড করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, আমাকে ফলো করুন। বিশাল হাসপাতালের আকা বাকা গলি দিয়ে হেটে কখনো ডানে, কখনো বামে, আবার কখনো লিফট বেড়ে চার তলায় নিয়ে গেলেন। বললেন, এখন যার কাছে যাবো, তিনি এ হাসপাতালের সব চেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট। সব চেকআপ সেরে সিরিয়ালে তার কাছে আসতে তিন দিন লাগে। তাই আপনাদের সরাসরি নিয়ে আসলাম।

সালাম দিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিস্তারিত খুলে বলে ফাইল নাম্বারটা দিলেন কম্পিউটারে সব রিপোর্ট দেখার জন্য। ডাক্তার এক নজর দেখে চেয়ার থেকে উঠে আমাদের নিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসলেন। নার্সকে বললেন একটি সীট খালি করে দিতে। কিছুক্ষণ পর নাজুর প্রেসার মাপতে মাপতে জানতে চাইলেন

- আপনার ব্যথাটা কোন দিকে?

- বা দিকে।

- এটি কি প্রথম?

- জ্যী।

- অন্য কোন রোগ আছে?

- আছে। ডায়াবেটিকস।

- সুগার কি কন্ট্রোলে?

- জ্যী।

- সিড়ি বেড়ে উঠতে কি ব্যাথা করে?

- না।

- জোরে হাটলে?

- না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন, ইকো টেষ্ট করতে হবে। এটি ছাড়া হার্টের গতিবিধি হুবহু বুঝা যায়না। আর হার্ট বিষয়ে অনুমান নির্ভর কোন সিদ্ধান্ত দেয়া বিপদ জনক ও বটে।

ডাক্তার সিহাবউদ্দীন পাশেই ছিলেন। বললেন, ইকো টেষ্টের জন্য তুমি যদি একটা অনুমোদন দিয়ে দাও, তাহলে ভাল হয়।

ডাক্তার রিসিপশনের একটি কম্পিউটারে নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে অনুমুতিটা দিয়ে দিলেন। এ হাসপাতালে যত রুগী ইমারজেন্সীতে এসেছে, সবার রিপোর্ট গুলো রিসিপশনে ডিস্প্লেতে রাখা কম্পিউটার স্ক্রীনে স্ক্রলিং হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম ৯০% রোগীর হার্টের সমস্যা।

ডাঃ সিহাব উদ্দীন হতে বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। ধনবাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসায় গিয়ে খাবার তেমন কিছু নেই। চুলোয় রাখা আধা পাকা তরকারী গরম করে খাওয়াই একমাত্র পথ। নাজু সন্তান দুটোর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলছে

- ওমারে মা। আল্লায় এমন রোগ দিয়েছে যে, আমার বাচ্ছাগুলোকে পর্যন্ত কষ্ট করতে হয়েছে।

- ওকে মাম্মি। কিচ্ছু হবেনা, ওরা সমস্বরে জবাব দিল।

ব্যাবাচ্যাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, নাজুর বুকের ব্যথা এখনও কমেনি।

গত রাতে আমার ঘুমটা বেশী ভাল হয়নি। কোন এক অজানা কারণে বার বার জেগে উঠেছি। মানসিক অস্থিরতার কারণে নাকডেকে গভীর ঘুমে অভ্যস্ত আমার ঘুম যেন অনেক পাতলা হয়ে গেছে। রাতে জেগে উঠতেই দেখছি - নাজু ঠিক আছে কিনা। ওর কোন কিছু হয়নি, এমনটি নিশ্চিত করতেই খুব সতর্কতার সাথে ডান হাতের আঙ্গুলটা ওর নাকের ডগার সামনে ধরে অনুমান করছি - নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা?

- না। মন মানেনা। ভাবছি আর কি টেষ্ট করা যায়? হুম। পাইছি। ইশারায় নিজের হাতটা ওর হাতের শিরার উপর রেখে বোদ্ধা ডাক্তারের মত চোখ দুটো বন্ধ করে রক্তের গতিবিধি অনুভব করছি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারছি হার্ট থেকে ছূটে আসা রক্তগুলো টিক টিক করে প্রবাহিত হচ্ছে।

আশ্বস্ত হলাম, ও ঠিক আছ্। কিন্তু বুকের ব্যথাটার কি অবস্থা জানা হলনা। থাক। জেগে উঠলে জানা যাবে। এভাবেই বার বার উঠে প্রতি রাতে ওকে দেখছি।

ইকো টেস্টের আরও তিনদিন বাকী। ইস। এর ভেতর যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। দুত্তরী। আল্লা ভরসা। কিচ্ছু হবেনা। না। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে পড়ছে নিজের চোখের সামনে হার্ট এ্যাটার্ক করে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। দুশ্চিন্তা এড়ানোর জন্য নিজেকে বার বার অভয় দিচ্ছি।

যাক, সময় অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল টেষ্ট। প্রতিটি মিনিট আর ঘন্টা গুনে গুনে আগামীকাল আজ হয়ে গেল।

আজ ইকো টেস্টের দিন। দুপুর একটায় গিয়ে প্যৌছতে হবে। রাস্তায় জ্যাম জনিত অনাকাঙ্খিত সমস্যা এড়ানোর জন্য বারোটায় গিয়েই উপস্থিত। পার্কিং এ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তার পর নিদিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ইকো টেস্টের ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করলাম। ইকো টেষ্টে বেশী সময় লাগেনি। কিন্থু ইকো টেষ্টের পর ডাক্তারের বক্তব্য শূনে মনে হল, সামনে কোন এক অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে। ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন, চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়। আপনারা বাসায় চলে যান। ইকো টেষ্ট নিয়ে আমি বড় ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দেবো কি ভাবে কি করা যায়। (চলবে)

ফাহিম তাসনিয়া গাড়ির পেছনে নিশ্চুপ বসে আছে। কোন শব্দ নেই। অন্য দিনের মত ভাই বোনের মাঝে আজ ঝগড়া নেই। চিমটি কাটা কাটি নেই। অভিযোগের সুরে তাসনিয়া বলছেনা

- এ মাম্মি দ্যাখ। ভাইয়া আমাকে মুখ ভেংচী দিচ্ছে।

- এ ফাহীম.. ধমক দিতে, মাম্মি আমি কি করিছি। ও খালি খালি আমার রিবুদ্ধে অভিযোগ করছে।

- তাসু। ও তোমার বড় ভাইনা।

- তোমরা খালি আমাকে বকা দাও। রাগ করে তাসনিয়া চুপ মেরে গেছে।

.. আজ তাদের মাম্মি অসস্থূ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। দুষ্টমি ও নেই।

আগামী কাল সকালে তাদের স্কুলের ক্লাশ টেষ্ট। কিন্তু মায়ের অসুস্থতায় পরীক্ষার কথা ভূলে গেছে। গলা শুকিয়ে কাষ্ট। নিস্পাপ শিশু দুটি গাড়ীর জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিছে প্রকৃতি দেখার ভান করছে।

রাস্তায় চলতে চলতে হাজারো কথা মনে উকি দিলেও বার বার এড়িয়ে যাচ্ছি। নাজুকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছি। ও বলেই যাচ্চে, আমার কেন এমন হল। ওতো সব কিছুই কন্ট্রোল করে চলি। আবার বড় দির্ঘশ্বাস ফেলে কতুগুলো কস্টের কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসতেই আমি পাশ কাটার চেষ্টা করছি।

ও খুব নরম মনের। জীবনে কাউকে কস্ট দিয়েছে কিনা তার জানা নেই। তাই আজ তার নিজের কাছে প্রশ্ন, আমার এমনটি হবে কেন? আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। সব পরীক্ষা আমার জন্য হবে কেন?

...এতক্ষণে হাসপাতালে গেটে এসে পৌছে গেছি। রাত আনুমানিক পৌনে বারোটা। হাসপাতালের বাহীরে নিরব নিস্তব্ধ। গাড়ীটা পার্ক করে বের হতেই দুর থেকে দেখছি, ডাক্তার সিহাব উদ্দীন আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। তার এ আগ্রহ আর সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসার ঢং দেখে মনটা ভরে গেল।

আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে সোজা রিসিপশনে নিয়ে গেল। আমার পকেটের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন

- আপনার ইকামাটা দিন।

- নেই।

- মানে?

- এক বছর হল মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে গেছে। স্পন্সার সমস্যা।

- আরে...তাহলে এখন কি করা যায়। মাথায় চুল খোচাতে খোচাতে ডাক্তার সিহাব উদ্দীন উপায় খুজছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নিজের পকেট হতে মানি বেগটা বের করে বলল

- ভাবী, আপনি ভেতরে বসুন। ভাই, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আসছি - বলে সোজা ভেতরে চলে গেলেন।

অজানা ভয় নিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে আছি। স্ত্রীকে বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি খুব চিন্তিত। শুধ বলছি, দুত্তরি। এটা কোন রোগই নয়। হয়তবা মাসল ব্যথা। কোন বিষয়ে ফাইনাল জানা ছাড়া এত ভয় করা উচ্তি নয়। তাহলে মনের বাঘেই তোমাকে কাবু করে ফেলবে। কিন্তু মন যতই অভয় দিকনা কেন, রোগীর মন যে মানেনা।

এতক্ষণে ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে দ্রত গতিতে ভেতর থেকে আসতে দেখে মনে হল, কিছু একটা করে এসেছে। রিসিপশনের পেছনের গেট দিয়েই সোজা ভেতরে চলে গেলেন। কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে ফিস ফিস করে কি যেন বললেন্। তার পর একটা কাগজ নিয়ে বের হয়ে এসে বললেন

- চলুন। কাজ হয়ে গেছে।

- মানে?

- আমার ইকামা দিয়ে ইমারজেন্সী ডিপার্টমেন্ট এর হেডকে বলেছি, আমার বন্ধুর স্ত্রীর সমস্যা। ইকামা নবায়ন করতে দিয়েছে। ভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। এমতাবস্থায় আমার ইকামা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যীস ডাক্তার ভ্রু না কুচকিয়েই অনুমতিটা দিয়ে দিল। হাসপাতালের যে অবস্থা, সৌদীরাও এখন ট্রিটমেন্ট নিতে হিমশিম খেতে হয়।

ইমারজেন্সীতে গিয়েই দুতিনটা নার্সকে এক করে নাজুকে আপন লোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম, নার্সগুলো নাজুকে দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুহুর্তেই কয়েকটা টেষ্ট করে ফেলল। টেষ্ট গুলো ফলাফল আসতে যাতে বিলম্ব না হয়, তাই ডাঃ সিহাব উদ্দীন নিজেই সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে রিপোর্টের অনুমোদন নিয়ে কম্পিউটারাইজড করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, আমাকে ফলো করুন। বিশাল হাসপাতালের আকা বাকা গলি দিয়ে হেটে কখনো ডানে, কখনো বামে, আবার কখনো লিফট বেড়ে চার তলায় নিয়ে গেলেন। বললেন, এখন যার কাছে যাবো, তিনি এ হাসপাতালের সব চেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট। সব চেকআপ সেরে সিরিয়ালে তার কাছে আসতে তিন দিন লাগে। তাই আপনাদের সরাসরি নিয়ে আসলাম।

সালাম দিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিস্তারিত খুলে বলে ফাইল নাম্বারটা দিলেন কম্পিউটারে সব রিপোর্ট দেখার জন্য। ডাক্তার এক নজর দেখে চেয়ার থেকে উঠে আমাদের নিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসলেন। নার্সকে বললেন একটি সীট খালি করে দিতে। কিছুক্ষণ পর নাজুর প্রেসার মাপতে মাপতে জানতে চাইলেন

- আপনার ব্যথাটা কোন দিকে?

- বা দিকে।

- এটি কি প্রথম?

- জ্যী।

- অন্য কোন রোগ আছে?

- আছে। ডায়াবেটিকস।

- সুগার কি কন্ট্রোলে?

- জ্যী।

- সিড়ি বেড়ে উঠতে কি ব্যাথা করে?

- না।

- জোরে হাটলে?

- না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন, ইকো টেষ্ট করতে হবে। এটি ছাড়া হার্টের গতিবিধি হুবহু বুঝা যায়না। আর হার্ট বিষয়ে অনুমান নির্ভর কোন সিদ্ধান্ত দেয়া বিপদ জনক ও বটে।

ডাক্তার সিহাবউদ্দীন পাশেই ছিলেন। বললেন, ইকো টেষ্টের জন্য তুমি যদি একটা অনুমোদন দিয়ে দাও, তাহলে ভাল হয়।

ডাক্তার রিসিপশনের একটি কম্পিউটারে নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে অনুমুতিটা দিয়ে দিলেন। এ হাসপাতালে যত রুগী ইমারজেন্সীতে এসেছে, সবার রিপোর্ট গুলো রিসিপশনে ডিস্প্লেতে রাখা কম্পিউটার স্ক্রীনে স্ক্রলিং হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম ৯০% রোগীর হার্টের সমস্যা।

ডাঃ সিহাব উদ্দীন হতে বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। ধনবাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসায় গিয়ে খাবার তেমন কিছু নেই। চুলোয় রাখা আধা পাকা তরকারী গরম করে খাওয়াই একমাত্র পথ। নাজু সন্তান দুটোর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলছে

- ওমারে মা। আল্লায় এমন রোগ দিয়েছে যে, আমার বাচ্ছাগুলোকে পর্যন্ত কষ্ট করতে হয়েছে।

- ওকে মাম্মি। কিচ্ছু হবেনা, ওরা সমস্বরে জবাব দিল।

ব্যাবাচ্যাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, নাজুর বুকের ব্যথা এখনও কমেনি।

গত রাতে আমার ঘুমটা বেশী ভাল হয়নি। কোন এক অজানা কারণে বার বার জেগে উঠেছি। মানসিক অস্থিরতার কারণে নাকডেকে গভীর ঘুমে অভ্যস্ত আমার ঘুম যেন অনেক পাতলা হয়ে গেছে। রাতে জেগে উঠতেই দেখছি - নাজু ঠিক আছে কিনা। ওর কোন কিছু হয়নি, এমনটি নিশ্চিত করতেই খুব সতর্কতার সাথে ডান হাতের আঙ্গুলটা ওর নাকের ডগার সামনে ধরে অনুমান করছি - নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা?

- না। মন মানেনা। ভাবছি আর কি টেষ্ট করা যায়? হুম। পাইছি। ইশারায় নিজের হাতটা ওর হাতের শিরার উপর রেখে বোদ্ধা ডাক্তারের মত চোখ দুটো বন্ধ করে রক্তের গতিবিধি অনুভব করছি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারছি হার্ট থেকে ছূটে আসা রক্তগুলো টিক টিক করে প্রবাহিত হচ্ছে।

আশ্বস্ত হলাম, ও ঠিক আছ্। কিন্তু বুকের ব্যথাটার কি অবস্থা জানা হলনা। থাক। জেগে উঠলে জানা যাবে। এভাবেই বার বার উঠে প্রতি রাতে ওকে দেখছি।

ইকো টেস্টের আরও তিনদিন বাকী। ইস। এর ভেতর যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। দুত্তরী। আল্লা ভরসা। কিচ্ছু হবেনা। না। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে পড়ছে নিজের চোখের সামনে হার্ট এ্যাটার্ক করে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। দুশ্চিন্তা এড়ানোর জন্য নিজেকে বার বার অভয় দিচ্ছি।

যাক, সময় অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল টেষ্ট। প্রতিটি মিনিট আর ঘন্টা গুনে গুনে আগামীকাল আজ হয়ে গেল।

আজ ইকো টেস্টের দিন। দুপুর একটায় গিয়ে প্যৌছতে হবে। রাস্তায় জ্যাম জনিত অনাকাঙ্খিত সমস্যা এড়ানোর জন্য বারোটায় গিয়েই উপস্থিত। পার্কিং এ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তার পর নিদিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ইকো টেস্টের ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করলাম। ইকো টেষ্টে বেশী সময় লাগেনি। কিন্থু ইকো টেষ্টের পর ডাক্তারের বক্তব্য শূনে মনে হল, সামনে কোন এক অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে। ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন, চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়। আপনারা বাসায় চলে যান। ইকো টেষ্ট নিয়ে আমি বড় ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দেবো কি ভাবে কি করা যায়। (চলবে)

ফাহিম তাসনিয়া গাড়ির পেছনে নিশ্চুপ বসে আছে। কোন শব্দ নেই। অন্য দিনের মত ভাই বোনের মাঝে আজ ঝগড়া নেই। চিমটি কাটা কাটি নেই। অভিযোগের সুরে তাসনিয়া বলছেনা

- এ মাম্মি দ্যাখ। ভাইয়া আমাকে মুখ ভেংচী দিচ্ছে।

- এ ফাহীম.. ধমক দিতে, মাম্মি আমি কি করিছি। ও খালি খালি আমার রিবুদ্ধে অভিযোগ করছে।

- তাসু। ও তোমার বড় ভাইনা।

- তোমরা খালি আমাকে বকা দাও। রাগ করে তাসনিয়া চুপ মেরে গেছে।

.. আজ তাদের মাম্মি অসস্থূ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। দুষ্টমি ও নেই।

আগামী কাল সকালে তাদের স্কুলের ক্লাশ টেষ্ট। কিন্তু মায়ের অসুস্থতায় পরীক্ষার কথা ভূলে গেছে। গলা শুকিয়ে কাষ্ট। নিস্পাপ শিশু দুটি গাড়ীর জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিছে প্রকৃতি দেখার ভান করছে।

রাস্তায় চলতে চলতে হাজারো কথা মনে উকি দিলেও বার বার এড়িয়ে যাচ্ছি। নাজুকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছি। ও বলেই যাচ্চে, আমার কেন এমন হল। ওতো সব কিছুই কন্ট্রোল করে চলি। আবার বড় দির্ঘশ্বাস ফেলে কতুগুলো কস্টের কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসতেই আমি পাশ কাটার চেষ্টা করছি।

ও খুব নরম মনের। জীবনে কাউকে কস্ট দিয়েছে কিনা তার জানা নেই। তাই আজ তার নিজের কাছে প্রশ্ন, আমার এমনটি হবে কেন? আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। সব পরীক্ষা আমার জন্য হবে কেন?

...এতক্ষণে হাসপাতালে গেটে এসে পৌছে গেছি। রাত আনুমানিক পৌনে বারোটা। হাসপাতালের বাহীরে নিরব নিস্তব্ধ। গাড়ীটা পার্ক করে বের হতেই দুর থেকে দেখছি, ডাক্তার সিহাব উদ্দীন আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। তার এ আগ্রহ আর সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসার ঢং দেখে মনটা ভরে গেল।

আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে সোজা রিসিপশনে নিয়ে গেল। আমার পকেটের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন

- আপনার ইকামাটা দিন।

- নেই।

- মানে?

- এক বছর হল মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে গেছে। স্পন্সার সমস্যা।

- আরে...তাহলে এখন কি করা যায়। মাথায় চুল খোচাতে খোচাতে ডাক্তার সিহাব উদ্দীন উপায় খুজছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নিজের পকেট হতে মানি বেগটা বের করে বলল

- ভাবী, আপনি ভেতরে বসুন। ভাই, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আসছি - বলে সোজা ভেতরে চলে গেলেন।

অজানা ভয় নিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে আছি। স্ত্রীকে বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি খুব চিন্তিত। শুধ বলছি, দুত্তরি। এটা কোন রোগই নয়। হয়তবা মাসল ব্যথা। কোন বিষয়ে ফাইনাল জানা ছাড়া এত ভয় করা উচ্তি নয়। তাহলে মনের বাঘেই তোমাকে কাবু করে ফেলবে। কিন্তু মন যতই অভয় দিকনা কেন, রোগীর মন যে মানেনা।

এতক্ষণে ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে দ্রত গতিতে ভেতর থেকে আসতে দেখে মনে হল, কিছু একটা করে এসেছে। রিসিপশনের পেছনের গেট দিয়েই সোজা ভেতরে চলে গেলেন। কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে ফিস ফিস করে কি যেন বললেন্। তার পর একটা কাগজ নিয়ে বের হয়ে এসে বললেন

- চলুন। কাজ হয়ে গেছে।

- মানে?

- আমার ইকামা দিয়ে ইমারজেন্সী ডিপার্টমেন্ট এর হেডকে বলেছি, আমার বন্ধুর স্ত্রীর সমস্যা। ইকামা নবায়ন করতে দিয়েছে। ভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। এমতাবস্থায় আমার ইকামা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যীস ডাক্তার ভ্রু না কুচকিয়েই অনুমতিটা দিয়ে দিল। হাসপাতালের যে অবস্থা, সৌদীরাও এখন ট্রিটমেন্ট নিতে হিমশিম খেতে হয়।

ইমারজেন্সীতে গিয়েই দুতিনটা নার্সকে এক করে নাজুকে আপন লোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম, নার্সগুলো নাজুকে দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুহুর্তেই কয়েকটা টেষ্ট করে ফেলল। টেষ্ট গুলো ফলাফল আসতে যাতে বিলম্ব না হয়, তাই ডাঃ সিহাব উদ্দীন নিজেই সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে রিপোর্টের অনুমোদন নিয়ে কম্পিউটারাইজড করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, আমাকে ফলো করুন। বিশাল হাসপাতালের আকা বাকা গলি দিয়ে হেটে কখনো ডানে, কখনো বামে, আবার কখনো লিফট বেড়ে চার তলায় নিয়ে গেলেন। বললেন, এখন যার কাছে যাবো, তিনি এ হাসপাতালের সব চেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট। সব চেকআপ সেরে সিরিয়ালে তার কাছে আসতে তিন দিন লাগে। তাই আপনাদের সরাসরি নিয়ে আসলাম।

সালাম দিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিস্তারিত খুলে বলে ফাইল নাম্বারটা দিলেন কম্পিউটারে সব রিপোর্ট দেখার জন্য। ডাক্তার এক নজর দেখে চেয়ার থেকে উঠে আমাদের নিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসলেন। নার্সকে বললেন একটি সীট খালি করে দিতে। কিছুক্ষণ পর নাজুর প্রেসার মাপতে মাপতে জানতে চাইলেন

- আপনার ব্যথাটা কোন দিকে?

- বা দিকে।

- এটি কি প্রথম?

- জ্যী।

- অন্য কোন রোগ আছে?

- আছে। ডায়াবেটিকস।

- সুগার কি কন্ট্রোলে?

- জ্যী।

- সিড়ি বেড়ে উঠতে কি ব্যাথা করে?

- না।

- জোরে হাটলে?

- না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন, ইকো টেষ্ট করতে হবে। এটি ছাড়া হার্টের গতিবিধি হুবহু বুঝা যায়না। আর হার্ট বিষয়ে অনুমান নির্ভর কোন সিদ্ধান্ত দেয়া বিপদ জনক ও বটে।

ডাক্তার সিহাবউদ্দীন পাশেই ছিলেন। বললেন, ইকো টেষ্টের জন্য তুমি যদি একটা অনুমোদন দিয়ে দাও, তাহলে ভাল হয়।

ডাক্তার রিসিপশনের একটি কম্পিউটারে নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে অনুমুতিটা দিয়ে দিলেন। এ হাসপাতালে যত রুগী ইমারজেন্সীতে এসেছে, সবার রিপোর্ট গুলো রিসিপশনে ডিস্প্লেতে রাখা কম্পিউটার স্ক্রীনে স্ক্রলিং হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম ৯০% রোগীর হার্টের সমস্যা।

ডাঃ সিহাব উদ্দীন হতে বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। ধনবাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসায় গিয়ে খাবার তেমন কিছু নেই। চুলোয় রাখা আধা পাকা তরকারী গরম করে খাওয়াই একমাত্র পথ। নাজু সন্তান দুটোর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলছে

- ওমারে মা। আল্লায় এমন রোগ দিয়েছে যে, আমার বাচ্ছাগুলোকে পর্যন্ত কষ্ট করতে হয়েছে।

- ওকে মাম্মি। কিচ্ছু হবেনা, ওরা সমস্বরে জবাব দিল।

ব্যাবাচ্যাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, নাজুর বুকের ব্যথা এখনও কমেনি।

গত রাতে আমার ঘুমটা বেশী ভাল হয়নি। কোন এক অজানা কারণে বার বার জেগে উঠেছি। মানসিক অস্থিরতার কারণে নাকডেকে গভীর ঘুমে অভ্যস্ত আমার ঘুম যেন অনেক পাতলা হয়ে গেছে। রাতে জেগে উঠতেই দেখছি - নাজু ঠিক আছে কিনা। ওর কোন কিছু হয়নি, এমনটি নিশ্চিত করতেই খুব সতর্কতার সাথে ডান হাতের আঙ্গুলটা ওর নাকের ডগার সামনে ধরে অনুমান করছি - নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা?

- না। মন মানেনা। ভাবছি আর কি টেষ্ট করা যায়? হুম। পাইছি। ইশারায় নিজের হাতটা ওর হাতের শিরার উপর রেখে বোদ্ধা ডাক্তারের মত চোখ দুটো বন্ধ করে রক্তের গতিবিধি অনুভব করছি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারছি হার্ট থেকে ছূটে আসা রক্তগুলো টিক টিক করে প্রবাহিত হচ্ছে।

আশ্বস্ত হলাম, ও ঠিক আছ্। কিন্তু বুকের ব্যথাটার কি অবস্থা জানা হলনা। থাক। জেগে উঠলে জানা যাবে। এভাবেই বার বার উঠে প্রতি রাতে ওকে দেখছি।

ইকো টেস্টের আরও তিনদিন বাকী। ইস। এর ভেতর যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। দুত্তরী। আল্লা ভরসা। কিচ্ছু হবেনা। না। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে পড়ছে নিজের চোখের সামনে হার্ট এ্যাটার্ক করে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। দুশ্চিন্তা এড়ানোর জন্য নিজেকে বার বার অভয় দিচ্ছি।

যাক, সময় অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল টেষ্ট। প্রতিটি মিনিট আর ঘন্টা গুনে গুনে আগামীকাল আজ হয়ে গেল।

আজ ইকো টেস্টের দিন। দুপুর একটায় গিয়ে প্যৌছতে হবে। রাস্তায় জ্যাম জনিত অনাকাঙ্খিত সমস্যা এড়ানোর জন্য বারোটায় গিয়েই উপস্থিত। পার্কিং এ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তার পর নিদিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ইকো টেস্টের ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করলাম। ইকো টেষ্টে বেশী সময় লাগেনি। কিন্থু ইকো টেষ্টের পর ডাক্তারের বক্তব্য শূনে মনে হল, সামনে কোন এক অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে। ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন, চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়। আপনারা বাসায় চলে যান। ইকো টেষ্ট নিয়ে আমি বড় ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দেবো কি ভাবে কি করা যায়। (চলবে)

বিষয়: বিবিধ

২১৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File