ঢাবির আবাসিক হলে ‘গেস্টরুম’ নামক আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা!!

লিখেছেন লিখেছেন নীলসালু ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০১:০৪:১১ দুপুর



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ওঠা প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে এক বিশাল আতঙ্কের নাম ‘গেস্টরুম’!!

সম্প্রতি প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ‘গেস্টরুম নিপীড়ন’ আলোচনায় আসে। শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে শুরু করে এই বিষয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটকে পুঁজি করে সাধারণত ছাত্রলীগের কর্মীদের পরিচালিত একটি কার্যক্রম হলো এই গেস্টরুম। ঢাবির ছাত্র এবং ছাত্রীদের হলে ছাত্রলীগের নেতা-নেত্রী-কর্মীরা এই ‘গেস্টরুম কার্যক্রম’ চালাচ্ছেন।

প্রথম বর্ষের ছাত্র/ছাত্রীদের হলে রাখার বিনিময়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যবহার করার দীক্ষার নাম ‘গেস্টরুম’। এই ছাত্র/ছাত্রীদের সাধারণত হলের গণরুমে অথবা একই রুমে ৩০-৩৫ জনকে রাখা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ টি হলে ১২৮টি গণরুম, ছাদ, বারান্দা মিলে এখন প্রায় ৩,৫০০ শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকে।

‘গেস্টরুম’ নিয়ে হলে থাকা নতুন/পুরাতন শিক্ষার্থীরা এককথায় ‘গেস্টরুম’কে আতঙ্কজনক, ভীতিকর, লোমহর্ষক, টর্চারসেল—এভাবে চিত্রিত করেছেন।

একজন ছাত্র বলেন, ‘গেস্টরুম’ বললে সাধারণ মানুষ ভাবতে পারেন, এখানে বাইরের লোকজন এলে চা-নাশতা খাওয়ানো হয়। কিন্তু এই ‘গেস্টরুম’ হলো রাজনৈতিক বড় ভাই/আপুদের নির্ধারিত আচরণ শেখানোর নামে মানসিক নির্যাতন কর্মসূচি। সাধারণত হলের অতিথিকক্ষে ঘটে বলে এটা ‘গেস্টরুম’ নামে পরিচিত। তবে এটা কখনো নেতাদের কক্ষ অথবা খোলা মাঠেও হয়ে থাকে। প্রথম বর্ষের ছাত্র/ছাত্রীদের সপ্তাহে তিন-চার দিন গেস্টরুমের বিভীষিকা পার করতে হয়। প্রতি রাতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা এ কর্মসূচি চলে। শুধু ছেলেদের ক্ষেত্রে নয়, মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে মেয়েদের হল গুলোতে।’

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব শ্যামপুর গ্রামের অটোরিকশাচালক বাবার মেধাবী ছেলে হাফিজুর মোল্লা গত জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। অসুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে ডাক্তারি পরীক্ষায় তাঁর নিউমোনিয়া ও টাইফয়েড ধরা পড়ে। অবস্থার অবনতি হলে ২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ঢাকায় নিয়ে রওনা দেন স্বজনেরা। কিন্তু দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে হাফিজুর মারা যায়। পরে জানা যায়, শীতের মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের বারান্দায় থাকা এবং প্রায় রাতে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজুর ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কলে ঢলে পড়েছিলো।

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আবাসিক হলে থাকতে হলে গেস্টরুমে শেখানো নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। নেতা-নেত্রী-কর্মীরা যখন যেখানে ডাকেন, সেখানে যেতে হয়। কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাদের ‘প্রটোকল’ দিতে যেতে হয় যেকোনো জায়গায়। সরকার দলীয় কর্মসূচি তো আছেই। এসব কাজ করতে গিয়ে কোথাও কেউ ‘অপরাধ বা বেয়াদবি’ করলে শাস্তিও পেতে হয়।’

গেস্টরুমে কী শেখানো হয়—জানতে চাইলে মুহসীন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মূলত হলের রাজনৈতিক বড় ভাইকে সালাম দিয়ে হাত মেলানো, হ্যান্ডশেক করার সময় বড় ভাইয়ের হাতে চাপ না দেওয়া, হ্যান্ডশেকের সময় বাঁ হাত পেছনের দিকে রাখা, বড় ভাইদের সামনে না হাসা ইত্যাদি।’

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘গেস্টরুমের নিয়মানুযায়ী ক্যাম্পাসে কেউ ‘অপরাধ’ করলে রাতে তাঁকে জরুরিভাবে ডাকা হয়। সেখানে ঝাড়ি-ধমক দেওয়া হয়। অপরাধ বলতে কাউকে সালাম না দেওয়া, কর্মসূচিতে না যাওয়া, ডাক দেওয়ার পরও না শুনতে পাওয়া, কর্মসূচির আগে অসুস্থতার অজুহাত দেওয়া, ক্যানটিন ও পাঠকক্ষে জ্যেষ্ঠদের আসনে বসা ইত্যাদিকে বোঝায়। আবার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাড়া প্রথম বর্ষের কেউ অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে সেটাও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা বেশিরভাগ করা হয় রাজনৈতিকভাবে হলে উঠা মেয়েদের ক্ষেত্রে। তাদেরকে মানসিক অত্যাচার থেকে শুরু করে শ্লীলতাহানি পর্যন্তও করে হলের 'বড় আপু' নামক নেতারা।’

একজন শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেন, ‘এত কষ্ট করে পড়তে এসেছি। কিন্তু আমাদের এত ছোট করা হয়, যা বলার মতো না। আমরা কিছুই না—এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ঝাড়ির চোটে সবাই কেঁপে ওঠে। ঝাড়ি দেওয়ার সময় নেতারা এমন জোরে চিল্লায়, খুব অসহায় লাগে। সোজা হয়ে দাঁড়ায়া থাকতে হয়, নড়াচড়া করা যাবে না, মাথা নাড়ানো যাবে না। মনে হয় যেন কোর্ট মার্শাল চলছে।’

আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘একদিন ভাইদের সঙ্গে কথা বলার সময় হাত আর মাথা নড়েছিল। এ জন্য আমাকে প্রচণ্ড ধমক দেওয়া হয়। ওই দিনই আমার মনে হয়েছিল হল ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু বাইরে থাকার সামর্থ্য নেই।’

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ভাবছিলাম, ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে অনেক স্বাধীনতা পাব। কিন্তু এখন বাসায় যাইতেও ভাইদের বলে যেতে হয়। একটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয়।’

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘বড় আপুদের কথা না শুনলে তারা গায়ে হাত তুলতেও ভাবেনা একবার। তাদের কথামত রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করার কারণে ক্লাস করতে পারিনি আর তাই ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।’

বেগম রোকেয়া হলের আরেক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি হলে উঠেছি ১ মাস হলো, প্রথমে বড় আপুদের ব্যবহার খুব মধুর থাকলেও এখন আর তা নেই। আমাকে বইমেলায় স্টলে থাকতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আমি তা পারিনি। রুমে ডেকে নিয়ে খুব বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করে আমাকে। এক পর্যায়ে তাদের সকল রাজনৈতিক প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকবো এই মর্মে একটি কাগজে আমার সাইন নেয়।’

এসএম হলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘হয়তো ক্যাম্পাসে হেঁটে যাচ্ছি, কোনো বড় ভাইকে খেয়াল করিনি। রাতে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে বলবে, আমি যে ওই দিক দিয়ে গেছিলাম চোখে পড়ছে? সালাম দিলি না ক্যান? এই বলে বাবা, মা, বোনকে নিয়ে গালিগালাজ করে।’

আরেক ছাত্র বলে, ‘কখনো কখনো দুই পাশ থেকে বা চারদিক থেকে কয়েকজন বড় ভাই একসঙ্গে চিৎকার করে গালাগাল দিয়ে ওঠেন।’

আরেকজনের অভিজ্ঞতা এ রকম, ‘কালকে প্রোগ্রামে যাইতে পারিনি। গেস্টরুমে আমাকে ডাকায়। তখন ২০-৩০ জন বড় ভাই ছিল। আমাকে বলে সবার নাম বলতে। আমি ১০-১২ জনের নাম বলতে পারি। তখন আমার মা-বাপ তুলে গালি দিয়ে বলা হয়, “ওগো নাম জানস না ক্যান? আমরা ভাই, ওরা ভাই না?”’

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের একজন বলেন, ‘সারা দিন দুইটা-তিনটা প্রোগ্রাম করতে হয়। রাতে আবার গেস্টরুম। রিডিং রুমে গিয়ে যে পড়ব, সে সময়টাই পাই না।’

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহেই তাঁদের যেকোনো এক রাত বাধ্যতামূলকভাবে ক্যাম্পাসে ‘ঘোরাঘুরি’ করতে হয়। বলা হয়, ‘তোরা তো নতুন, ভার্সিটি ক্যাম্পাস চেনা উচিত। যা ঘুরে আয়। রাত চারটার আগে কেউ হলে ফিরবি না।’

এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমার খুব ঠান্ডা লাগছিল। আমি অন্যদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে ঢাকা মেডিকেলের ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসে ছিলাম। চারটার পর ফিরে আসি।’

কালের বিবর্তনে প্রাচ্যর অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন দাসপ্রথার ভিন্নরূপ!!

তবুও যেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাবিতে পড়তে না পারার আফসোস কাটেই না! এই প্রসঙ্গে ২ দিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট করি আমি৷ যেখানে ঢাবির কিছু শিক্ষার্থী খুবই অশালীন আচরণ করে৷ ব্যাপারটি নজরে আসে বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকার এবং তারা বিস্তারিত প্রতিবেদন করে৷

বিশ্ববিদ্যালয়য়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রথম বর্ষের একটা ছাত্র/ছাত্রীর প্রায় পুরো জীবনী শক্তি নষ্ট করে দেয়। যে স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয় সেটা দুর্বল করে দেয় এই সিস্টেম। পরে এদের বেশির ভাগই রেজাল্ট খারাপ করে অথবা পুনঃভর্তি হয়। ক্লাশ বাদ দিয়ে মিছিল করা, রাতে পড়া বাদ দিয়ে গেস্টরুম করা, আর সারাদিন বড় ভাই(!)দের সালাম দেয়া।

জাতির উন্নয়ন কল্পে এই সিস্টেম পরিহার করা উচিত। যার যা কাজ তাকে তা করতে দেয়া উচিৎ। গেস্টরুম এ কি আচরণ শিখায়?

ঢাবির হলগুলোতে কোন দিন বলা হয় না যে,- হলে চিল্লা-পাল্লা করা যাবে না, বলা হয় না উচ্চ শব্দে গান বাজানো যাবে না, কারো পড়াশুনায় ডিস্টার্ব করা যাবে না।

শিখিয়েছে শুধু মিছিল, সালাম আর গেস্টরুম।

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৭৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

359942
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০২:১৭
হতভাগা লিখেছেন : ঢাবিতে কি এখন আর পড়াশোনা হয় ? আমার তো মনে হয় না ।

ঢাবিকে গাজীপুর/রাজেন্দ্রপুরে সরিয়ে দিয়ে সে জায়গায় আবাসিক এলাকা বানানো হোক ।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০২:৩৬
298341
নীলসালু লিখেছেন : মন্দ বলেননি
359945
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০২:৩৫
বিবর্ন সন্ধা লিখেছেন : মাদ্রাসা বন্ধের মত ,
ঢাবি ও বন্ধের আবেদন করা হোক Rolling on the Floor Rolling on the Floor
359956
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বিকাল ০৪:৫৯
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : নিউজটা কি আপনি করেছেন, এখানে আসার আগে অন্য একটা পত্রিকায় অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, সেখানে রিপোর্টারের নাম ছিলনা। আর আমিও কিন্তু ঢাবির গেস্টরুমের বর্বর অভিজ্ঞতার শিকার।
359970
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:২৯
চেতনাবিলাস লিখেছেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন শয়তানের কারখানা | যেমন তার অধিকাংশ শিক্ষক তেমনই তার অধিকাংশ ছাত্র | আপনাকে অ নে ক দিন পর টুডে ব্লগে পেলাম | ধন্যবাদ |

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File