এশিয়ার বদ্ধভূমিতে সাড়ে ৪ বছরে ২৬৮টি লাশ! ১ যুগে ১০৫৭ : ওরা মানুষ নয়, ওরা ট্রিগার বাহিনী

লিখেছেন লিখেছেন হাসান ১৩ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:৩১:২০ দুপুর



জাতীয় দিবসগুলোতেও লাশ উপহার : আসামির আদালতে ফেলানীর বিচার শুরু হচ্ছে আজ : তরুণ প্রজন্মের নিরবতায় দুঃখ পাই!

আওয়ামী লীগ সরকারের ৪ বছরে সীমান্তে বিএসএফ হত্যা করেছে ২৬৮ জন বাংলাদেশিকে। ছয়টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ভারত। ২০০০ সালের পর গত একযুগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ১০৫৭ নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এ সময় ভারতের সঙ্গে অন্য পাঁচটি সীমান্তে একটি হত্যার ঘটনাও ঘটেনি। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। ভারতের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান সীমান্তেও গত ১০ বছরে কোনো বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।

মহাজোট সরকারের ৪ বছরে ২৬৮ জন নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারত

চলতি ২০১৩ সালে ১৮ জন

২০১২ সালে ৪২ জন

২০১১ সালে ৩৪ জন,

২০১০ সালে ৭৪ জন,

২০০৯ সালে ৯৬ জন,


………………………………

মহাজোট সরকারের ৪ বছরে ২৬৮ জন

২০০৮ সালে ৬২ জন,

২০০৭ সালে ১২০ জন,

২০০৬ সালে ১৪৬ জন,

২০০৫ সালে ১০৪ জন,

২০০৪ সালে ৭৬ জন,

২০০৩ সালে ৪৩ জন,

২০০২ সালে ১০৫ জন,

২০০১ সালে ৯৪ জন এবং


২০০০ সালে ৩৯ জন নিরীহ বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে।

…………………………………..

গত ১ যুগে সর্বমোট- ১০৫৭ জন



জাতীয় দিবসগুলোতেও লাশ উপহার


বাংলাদেশের জাতীয় দিবস ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোতে হত্যার ঘটনা কি কাকতালীয় নাকি পরিকল্পিত বর্বরতা?

২০১১ বাংলা নববর্ষে ২ বাংলাদেশিকে হত্যা

১৪ এপ্রিল ২০১১ ভোরে বাংলা নববর্ষে যশোর জেলার বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় মুন্না (১৮) নামে এক বাংলাদেশি যুবক ও আহত হয় মামুন (২৩)।

একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর সীমান্তবর্তী নীতপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের গুলি করে হত্যা করে সানাউল্লাহ (৩২) নামের এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীকে।

২০১২ বাংলা নববর্ষে ১ বাংলাদেশিকে হত্যা

১৪ এপ্রিল ২০১২ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ফারুক হোসেন (২৫) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়।

মে দিবসে ১ বাংলাদেশিকে হত্যা

৩০ মে রাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে রহমত আলী (৩৫) নামের বাংলাদেশী এক রাখাল নিহত হয়েছে।

বিজয় দিবসে ৪ বাংলাদেশিকে হত্যা

১৬ ডিসেম্বর ২০১১ বিজয়ের ৪০ বছর উদযাপনের সময় বিএসএফের গুলিতে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহেববাড়িয়া সীমান্তে নিহত হন নাহারুল (৪০) নামে এক বাংলাদেশী।

একই দিন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সীমান্তে বিএসএফ’র বোমার আঘাতে আনোয়ার হোসেন (২৭) নামে এক বাংলাদেশী নিহত হন। এ সময় আহত হন মোহর আলী (২৫) নামে আরো একজন।

একই দিন দিনাজপুর জেলার বিরামপুর সীমান্তে গভীর রাতে মতিয়ার (২০) ও তাইজুদ্দিন (৩০) নামে দুই বাংলাদেশীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে।

পবিত্র ঈদের দিনও বাংলাদেশি যুবককে পিটিয়ে হত্যা

২০ আগস্ট ২০১২ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার জগতবেড় ইউনিয়নের ভোট হাটখাতা সীমান্তে দুপুরে ভারতীয় চেনাকাটা ক্যাম্পের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) জাহাঙ্গীর আলম বাবলু (২৫) নামে এক বাংলাদেশীকে পিটিয়ে হত্যা করে।

ইংরেজি নববর্ষে ৪ বাংলাদেশিকে হত্যা

১ জানুয়ারী ২০১৩ ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে মুক্তার আলম (২৮) ও তরিকুল ইসলাম ওরফে নূর ইসলাম (২৮) নামে ২ বাংলাদেশি যুবককে। তাদের গুলিতে আহত হয়েছেন আরো তিনজন। । এ ঘটনায় আহতরা হলেন আমজাদ (২৫), সামাদ (২৯) ও রাজু (২৩)। এদের মধ্যে রাজু মোলানী সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হন।

বুধবার ভোর রাত ৩টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে মাসুদ (২৩) এবং শহীদুল ইসলাম(২৮) দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।

সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে বিএসএফের মানতাবিরোধী গণহত্যার শেষ কোথায়? বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফের কাছে ফেলানীদের মৃত্যু কিংবা হাবিবদের উপর বর্বরতা কোনো বিষয় নয়। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম.খা. আলমগীর বললেন, “আত্মরক্ষার জন্য বিএসএফ গুলি চালাতে পারে।”

ভারতের বিশেষ আদালতে আজ ফেলানী হত্যার বিচার শুরু

দীর্ঘ আড়াই বছর পর আজ কুড়িগ্রাম সীমান্তে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হচ্ছে ভারতের বিশেষ আদালতে। বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী কিশোরীর ঝুলন্ত মরদেহ কাঁটাতারের বেড়ায় দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা ঝুলে থাকার ছবি ভারত-বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত সরকার। ভারত-বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবির মুখে অবশেষে আজ মঙ্গলবার এ বিচার কাজ শুরু হচ্ছে কোচবিহার ১৮১ বিএসএফ সদর দফতরে বিশেষ আদালতে।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার পথে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তরক্ষী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়। ভোরবেলা দালালের মাধ্যমে মই বেয়ে বাবার সঙ্গে কাঁটাতারের বেড়ার উপরে উঠে ফেলানী। এ সময় বিএসএফের ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের টহলরত সদস্যদের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারায় ফেলানী। ফেলানীর বাবা বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের বেড়ায়। ঝুলন্ত লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ৪ ঘণ্টা ঝুলে থাকার ছবিটি বাংলাদেশ-ভারতসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমালোচনার ঝড় উঠে গোটা বিশ্বে। ঘটনার একদিন পর দু’দেশের সীমান্তরক্ষীর পতাকা বৈঠকের

পর লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ। আর এ হত্যাকাণ্ডে বিএসএফ সদস্য শ্রী অমিও ঘোষকে প্রধান অভিযুক্ত করে ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা পুলিশ স্টেশনে একটি হত্যা মামলা হয়।

চলতি বছরের মার্চে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফের বৈঠকে ভারত সরকার বিচারের আশ্বাস দেয়। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের চাপের মুখে অবশেষে ফেলানী হত্যার বিচার পেতে যাচ্ছে তার পরিবারসহ বাংলাদেশ সরকার।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিচারপ্রত্যাশী ফেলানীর মা-বাবার ক্ষোভের অবসান হতে যাচ্ছে। এই বিচারের মাধ্যমে দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলে ফেলানীকে হারানোর বেদনা ভুলে কিছুটা সান্ত্বনা মিলবে তাদের। সেই সঙ্গে সীমান্তে আর কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটানোর প্রত্যাশা ফেলানীর বাবার।

ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম জানান, ফেলানীকে হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যসহ দোষীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, সীমান্ত হত্যায় আর যেন কোনো বাবার বুক খালি না হয়, সে আশায় ন্যায়বিচার পেতে ভারতের কোচবিহারে বিএসএফের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে যাবেন তিনি।

ফেলানী হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করে এখনও আবেগতাড়িত হয়ে ফেলানীর মা জাহানারা বেগম সান্ত্বনা খোঁজেন সুষ্ঠু বিচারের। প্রত্যাশা করে সীমান্তে এমন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। কোনো মাকেই যেন বয়ে বেড়াতে না হয় এমন বেদনাদায়ক কষ্ট।

ফেলানীর মামা আবদুল হানিফ বলেন, কোনো স্বজনের এমন মৃত্যুর খবর যেন শুনতে না হয়, লাশ বহনের মর্মবেদনা যেন আর কাউকে স্পর্শ করতে না পারে, এরই প্রতিবাদে সাক্ষী দেয়ার সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন তিনি।

দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর ফেলানী হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যদের বিচার শুরুর খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছে পরিবারের সদস্যসহ সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশীরা।

কুড়িগ্রাম ৪৫ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ জানান, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যাকাণ্ডে এই প্রথম বিএসএফের বিশেষ আদালতে অনুষ্ঠিতব্য বিচার কাজে সাক্ষ্য দিতে যাবেন নিহত ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম, মামা আবদুল হানিফ ও তিনি নিজেই। আইনি সহয়াতা দিতে তাদের সঙ্গে যাবেন কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন। এই বিচার সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মত প্রকাশ করেন বিজিবি অধিনায়ক।

ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন সীমান্ত হত্যা বন্ধে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিএসএফের গুলিতে আর যেন কোনো বাংলাদেশী নাগরিক প্রাণ না হারায়, এমন নিষ্ঠুর মানবাধিকার যেন আর লঙ্ঘিত না হয়—এমন প্রত্যাশায় এই বিচারের দিকে দৃষ্টি এখন সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার সব পরিবারসহ দেশবাসীর।

ওরা মানুষ নয়, ওরা ট্রিগার বাহিনী

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ওদের নাম দিয়েছে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বাহিনী, কানাডার ভাষায় ‘anti-human, violent unit that is engaged with systematic attacks on civilian’ (অর্থাৎ, অমানুষদের এক জঙ্গলে বাহিনী যারা পদ্ধতিগতভাবে সাধারণ মানুষদের ওপর হামলা করে বেড়ায়)। কানাডিয়ান হাইকমিশনার বিএসএফ নামক এই বর্বর বাহিনীর এক জওয়ানের ইমিগ্রেশন আবেদন বাতিলও করে দিয়েছিল ওই অভিযোগে। ভিজিট ভিসা পর্যন্ত ইস্যু করেনি। শেষমেশ লবিং করে ইন্ডিয়া। পরাজিত হয় মানবতা। এক দঙ্গল ইন্ডিয়ান কাম কানাডিয়ান এমপি এগিয়ে আসে। কানাডিয়ান পার্লামেন্টে উপর্যুপরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই আইন আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। আর রাখবেই বা না কেন? যার ঘোড়া তার ঘোড়া নয়, চেরাগ দাদার ঘোড়া! যে দেশের মানুষদের পাইকারি হারে হত্যা করা হয়, সে দেশের অভিভাবকদের কী চমত্কার ভূমিকা? গলায় গলায় দাসত্বের বন্ধুত্ব! শুধু কি তাই? আজ পর্যন্ত এমন একটা সাইটও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী জনতা করতে পারেনি, যেখানে এই বর্বরতার কাহিনীগুলো জমা আছে। যা দেখালে আন্তর্জাতিক বিবেক কেঁপে উঠবে। আমাদের এমন দেশপ্রেম সত্যি পৃথিবীতে বিরল!

যে ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সীমান্ত’ কিলিং জোন নামে দুনিয়াজোড়া খ্যাত, সেখানেও এত মানুষ হত্যা হয় না। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তো সারাক্ষণ যুদ্ধাবস্থা লেগেই থাকে। গেল বছর ২৪ নভেম্বর উত্তর কোরিয়ার এক শেল আঘাত হানে প্রতিপক্ষের দেশে। ফলে দুজন দক্ষিণ কোরিয়ান নিহত হয়। সারা দুনিয়ায় হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে উন্নত দেশগুলোর কড়া প্রতিবাদের বন্যা বয়ে যায়।

এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সীমান্ত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। অবৈধ অনুপ্রবেশ কোনো সীমান্তে নেই, এমন নজির কেউ দেখাতে পারবে না। ভাগ্যের অন্বেষণে মানুষজন বৈধ-অবৈধ পথে প্রতিবেশী দেশে পাড়ি জমায়, এটাই নির্মম বাস্তবতা। এজন্য প্রায় প্রতিটি দেশেরই সীমান্ত ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। এর জন্য সীমান্ত আইন রয়েছে। স্মাগলিং বন্ধে অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিধানও আছে। কিন্তু এভাবে নির্বিচারে সাধারণ নাগরিকদের লাশের পর লাশ ফেলা হবে, আর কোনো দেশের নপুংশক সরকার চুপ করে বসে থাকবে এটা কল্পনারও অতীত! বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

সীমান্ত রয়েছে কানাডা-আমেরিকার, আমেরিকা-মেক্সিকোর, চীন-ভারতের, আবার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে তার অজাতশত্রু পাকিস্তান ও কাশ্মীরের। কিন্তু ট্রিগার হ্যাপিদের হাত ওদিকে ওঠে না। কারণ? হাত টেনে ছিঁড়ে দেয়ার ক্ষমতা সেসব দেশের রয়েছে।

৭ জুন ২০১০ আমেরিকান এক ‘বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট’র গুলিতে এক মেক্সিকান কিশোর নিহত হয়। কিশোরটির বয়স ঠিক ফেলানীর সমান—মাত্র পনেরো। মেক্সিকান প্রান্তে মাথায় গুলি লেগে জোয়ারেয নামের ছেলেটির করুণ মৃত্যু হয়। এক মৃত্যুতেই ইউএস-মেক্সিকো সম্পর্কে মারাত্মক টান পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকার এক গরিব দেশ হলো মেক্সিকো। কিন্তু আত্মসম্মানবোধে তারা আমাদের চেয়ে হাজার গুণ এগিয়ে। মেক্সিকোর ক্ষিপ্ততায় আমেরিকা ভড়কে যায়। অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার ঘটনার দ্রুত সিভিল ইনভেস্টিগেশনের ঘোষণা দেন। বলেন, ঘটনাটি ‘এক্সট্রিমলি রিগ্রেটেবল’, অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হবে ইত্যাদি। ওদিকে নিহত জোয়ারেযের পরিবার আমেরিকান গভর্নমেন্ট, সংশ্লিষ্ট সব ফেডারেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে। খোদ আমেরিকারই এক ল’ ফার্ম পরিবারটির পক্ষে মামলা দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েছে।

এক ফেলানীর মৃত্যু সারা বাংলাদেশকে কাঁদিয়েছে। অথচ গত দু’দশক ধরে শত শত ফেলানীর মৃত্যু হয়েছে ওই অসুর বাহিনীর হাতে। বিচার তো দূরের কথা, অন্তত একটি ঘটনার শক্ত প্রতিবাদও হয়নি।

এই সুযোগে আমাদের ভিসি ভারতীয় হাইকমিশনারকে নিশ্চয়ই দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। কেননা তিনি না শোনালে আমাদের হয়ে আর কে শোনাবেন? তিনি নিশ্চয়ই বলেছিলেন, ‘এভাবে ফেলানীকে তোমরা মারলা কেন? শাহজাহানেরই বা কী অপরাধ ছিল?’ তিনি হয়তো আরও বলেছিলেন, এই দেখ আমরা হিন্দি দিবস পালন করি, সারা বাংলাদেশে হিন্দি ফিল্ম ছড়িয়ে দিয়েছি, শাহরুখ খানসহ অর্ধশতাধিক ভারতীয় শিল্পীর উন্মত্ত নৃত্যের সঙ্গে হিন্দির জয়গান গেয়েছি, কিন্তু তোমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও আমাদের ভাষা নিয়ে দিল্লিতে একটা অনুষ্ঠানও কর না কেন?

হায়রে বাংলাদেশ, খুঁজে খুঁজে দিবস পালন করতে জান। কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার শপথ নিতে একটি দিবসও পালন করতে জান না? ৭ জানুয়ারি অসংখ্য নাম না জানা ফেলানীদের জন্য একটি ‘ফেলানী দিবস’ করতে পারে না কি বাংলাদেশ?

জীবন্ত ফেলানী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাঁটাতারে ঝুলে চার ঘণ্টা গোঙিয়েছে। ওর গোঙরানোর শব্দ যেন স্বাধীন বাংলাদেশের লাল পতাকার পত পত করে উড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে। ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিত্কার করেছে ফেলানী। আর ছ’ঘণ্টা পরই ও মেহেদি রাঙ্গা হাত নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। অনাগত জীবনের স্বাপ্নিক মেহেদি যেন খুন হয়ে কাঁটাতারের ইথারে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে ফেলানী। স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে পরাধীন নূর হোসেন তার মেয়েকে কাছ থেকে এক বিন্দু পানি দিতেও পারেনি।

বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আর কী কী লাগবে ভারতের? মুক্তিযুদ্ধের ঋণ শোধ করতে আর কী করতে হবে বাংলাদেশকে? উচ্চসূদে ঋণ, অসম বাণিজ্য চুক্তি, ট্রানজিট দিতে সরকারের শক্ত অবস্থান, পানি বণ্টনে উদাসীনতা সব মেনে নিয়েছি। এমনকি বিডিআর ধ্বংস করে বিজিবি করেছি। সে বিডিআর তো আর নেই যে বিডিআর সীমান্তে জমি দখলের সময় অনুপ্রবেশকারী ১৮ বিএসএফকে হত্যা করে সীমান্ত অটুট রেখেছিল। ৩ বিডিআর হত্যার উপযুক্ত বদলা নেয়ার সেই বাহিনী তো এখন বিএসএফের সঙ্গে একত্রে টহল দেয়। সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার হত্যা নিয়েও তো আমরা কথা বলছি না, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সব স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের আইটি সেক্টরগুলো ইন্ডিয়ানদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। দাসত্বের প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়তে আর কী কী করতে হবে? আর কত চুক্তি করলে মানুষ হত্যা বন্ধ করবে বিএসএফ?

দুঃখ পাই যখন দেখি এদেশের তরুণসমাজ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। যখন তিতাস নদীর ওপর ২৭ টি বাঁধ দেয়া হয়, ফেলানীকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়, হাবিবকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয় তখন তরুণ সমাজ জেগে ওঠে না।

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তথা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তরুণ প্রজন্মকে জেগে ওঠা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে তো বিভিন্ন উপায়ে ঘুমের ঘোরে রাখা হয়েছে। তাদেরকে ঘুম থেকে জাগাবে কে?

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা দেখে জনৈক ব্যক্তি সেদিন আক্ষেপ করে বলছিলেন- দেশটা বিক্রি হয়ে গেলেও সম্ভবত আমাদের তরুণদের ঘুম ভাঙ্গবে না এবং তিনিই বলছিলেন, ঘুম ভাঙ্গবে কি করে, তাদেরকে তো ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য কোনো দলের বাংলাদেশ দেখতে চাই না, আমরা চাই সবার বাংলাদেশ।

মালয়েশিয়া যখন বলে ‘এক মালয়েশিয়া’, তখন স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও আমরা জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দু’ভাগে বিভক্ত করা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি! আজকে বিচারপতি, আইনজীবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবি, শ্রমিক, কৃষক সব জায়গাতেই ২ দলে বিভক্ত। বিদেশী শকুনদের হাত থেকে দেশের সম্পদকে রক্ষা করে সামনে এগুতে একটি শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য সময়ের দাবী। তবে তার দর্শন হতে হবে ন্যায় ও দেশপ্রেম।

তরুণ প্রজন্মের সত্যিকার প্রয়োজন ও চাওয়া-পাওয়ার দিকে কোন নজর দিন। একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসরমান বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে অযৌক্তিক আবেগ পরিহার করে বাস্তবমুখী হওয়া দরকার।



তথ্যসূত্র

- অধিকার

- এমআরটি

- ওরা মানুষ নয়, ওরা ট্রিগার বাহিনী : শা হী ন সি দ্দি কী

বিষয়: বিবিধ

২০৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File