শিলালিপি

লিখেছেন লিখেছেন জলখাসি ১৯ জুলাই, ২০১৭, ১১:০৪:০৪ সকাল

শিলালিপি -৩

***********

কলেজে আমি ও আমার চার বন্ধু মোটামুটি একটা উপদ্রব হিসেবেই আত্ম প্রকাশ করলাম। আমাদের সাথে কেউ মেশে না, আমরাও কারো সাথে মিশি না। আমাদের দিন শুরু হয় ইউনেক্টিন ১০ নামক ( নাইট্রাজিপাম ) ঘুমের বড়িতে। সকাল, দুপুর, বিকেল মিলে ১৫ টা ট্যাবলেট প্রতিদিন খাই। দুপুরে নাদেরের মদ। সকাল থেকে রাত অবধি মাদক আর মাদক। আমার পকেট পয়সার সরবরাহ বেড়েছে। ভাইয়া রোজ ২০ টাকা দেয় । চুরি চামারি করি, আব্বারে নজরে রাখি। বিভিন্ন চিপায় চাপায় বসে টিকটিকির লেজ থেকে শুরু করে বাংলা মদ সবই খাই । ক্লাসের অন্য কোন ছাত্র ছাত্রী কিংবা কলেজের কোন টিচার কে কখনো কোন রকম বিরক্ত করিনি এটা হলফ করে বলতে পারি । একান্তই নিজেরদের জগতে বুদ হয়ে থাকতাম । মাঝে মাঝে আমি খেয়াল করতাম আমাদের কোন বন্ধু নেই । এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ আমার কোন দিনই ছিল না । বন্ধু আমার এখনো নেই । এই সময় খেয়াল করলাম, আমার না ফেরাতক বড় ভাইয়া অপেক্ষা করতে থাকে। আমি এসেই ঘুমিয়ে পড়ছে চাই আর সে জোর করে এক দুই নলা ভাত খাইয়ে দেয়। কোন কোন সময় এমনও হয়েছে যে টানা ৯৬ ঘন্টা ঘুমিয়ে উঠে বিশ্বাসই করতে পারিনি আমি টানা চারদিন চাররাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। বড় ভাইয়া কিছু বলত না। একদিন মেঝো নালিশ করল-আমি তার কথা শুনি না। ভাইয়া বিষয়টাকে ইগনোর করার কিছুক্ষন পরেই মেঝোকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে পালিয়ে গেলাম। এবার সে বিচার পেল না।

এভাবে দিনে দিনে বড় ভাইয়ার প্রতি আমার দুর্বলতা বাড়তে থাকল । লোকটা প্রতি বেলাতেই না খেয়ে বসে থাকে । আর আমি কিনা অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে থাকি সর্বক্ষণ । ঘরের প্রতি একটু একটু মমতা বাড়তে থাকল কিন্তু ভয়ঙ্কর যে বিষয়টা খেয়াল করলাম তা হল আব্বাকে সহ্য করতে পারছিনা । মনে হচ্ছিল আব্বা, মেঝো ভাই এবং চির অসুস্থ মাও আমাকে আমাকে ঘৃণা করেন । এর কারন কি ? মুখের উপর সত্য কথা বলা ? ভাইয়া বিষয় টা আচ করে তাঁর ঐশ্বরিক দু হাত বাড়িয়ে দিলেন । ক্ষুদে অনাথ শিশুর মত প্রবল আবেগে তাঁর বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম, কেপে কেপে উঠছি বার বার। মাতৃ স্নেহ, পিতার আদর বঞ্চিত আমি শক্ত বাধনে জড়িয়ে পড়ছিলাম তাঁর বাহু ডোরে । দুপুরে বাসায় ফেরার জন্য তাড়াহুড়া করি । একদিকে ভাই না খেয়ে অপেক্ষা করে আছে অন্যদিকে শৈশবের বন্ধুরা বিরক্ত হচ্ছে । কমপ্লিকেশন শুরু হল । আমি বাসায় ফেরার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিলাম ।

ঘরে দুটো ধারা তৈরি হতে থাকল । একদিকে আমি( আমার সকল সিদ্ধান্তে ভাইয়া সরাসরি বিরোধিতা করে না। আমি কঠিন জাতীয়তাবাদী। সংসার যদি কখনো কারো সাথে বিবাদে জড়ায়, বাসার সিদ্ধান্তকে সম্মিলিত ভাবে মেনে নিতে হবে। একা একা, চুপি চুপি কিচ্ছু করা যাবে না। এতে পারিবারিক সম্মান নষ্ট হয়। আগেই বলেছি, এই ব্যাপারে আমি ভীষন টনটনে ) আর অন্যদিকে বাবা মা ও মেঝো ভাই । তারা সারাক্ষন বড় ভাইয়ার কান ভারি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে । আমি খেয়াল করতে থাকলাম কারন থাকুক আর নাই থাকুক তারা প্রায় প্রতিদিনই আমাকে নিয়ে নানান অভাব অভিযোগ করে অথচ বাইরের কেউ কখনো আমাকে নিয়ে এমনটা করেনি । আমার মেজাজ খারাপ থেকে খারাপতর হতে শুরু করল । স্কুলে পড়াকালীন সময়ে একদিন হেড স্যার বাবাকে জিজ্ঞেস করল আমি কোন ক্লাসে পড়ি । উনি ভেবে চিন্তে উত্তর দিলেন –জানিনা । আমি তার সাথেই দাঁড়ানো ছিলাম এবং আমি জানতাম কি হতে যাচ্ছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হল বাবা কোন দেশের কোন প্রেসিডেন্ট যে, উনি তাঁর ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে তা জানেন না । অতীতে এক সময় বাবার বেতন বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। তখন ঘরে দুই জাতের ভাত রান্না হত । রেশনের চাল ও চিকন চালের ভাত । শুধু মেঝো ভাই খাবে চিকন চালের ভাত বাকি সব রেশনের । যারা জানেন না রেশন চাল কি জিনিস তাদের বিনীত ভাবে বলি, ঐ চাল গুলো ছিল ৫০% মোটা চাল, ২০% পচা, ২০% পোকা ( সাদা সাদা বাথরুমের পোকা ) আর বাকি সব পচে শুকিয়ে যাওয়া যাওয়া কাল চাল । যে ঘরে এমন চাল সেদ্ধ হত সে ঘরের আশে পাশে কেউ ভিড়তে পারত না গুয়ের গন্ধে । চাল বেছে ও শুকিয়ে পোকা পরিস্কার করতে হত । তারপরও রান্নার পর দেখা যেত প্লেট ভরতি সাদা সাদা পোকা যাদের সামান্য খয়েরি রঙের মাথা । এই প্লেট কাছে আনা যেত না এমন গন্ধ । আমি না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলাম । একসময় খেয়াল করলাম স্কুল থেকে ফেরার পর খেলতে পারিনা । সারাক্ষন মাথা ঘুরে । মাঠ রাস্তা ঘাট সব মনে হয় উল্টে গেছে । আমি উল্টো হয়ে হাঁটাহাঁটি করি । কিছুদিন পর তাও বন্ধ ওয়ে গেল। এবার ওয়ালে ধরে ধরে হাঁটি । কেউ ফিরেও তাকাল না । তারপর ঘর থেকে বের হওয়া ছেড়ে দিলাম । মনে মনে ভাবতাম আমার বুঝি বড় কোন রোগ হয়েছে । আমি আর বাঁচব না । যেহেতু চিকিৎসার সামর্থ্য নেই তাই কাউকে কিছু বলতাম না । শুধু শুধু যন্ত্রনা বাড়িয়ে লাভ কি ?

সেসময় আমার বড় আপা আমার একটা আবদার মিটিয়েছিল। বিরাট আবদার। অথচ সে আমার তুলনায় কিছু পরিমানে কৃপন কিন্তু তার আদর ভালোবাসা আর বোকামি গিনিজ বুকে স্থান পাওয়ার মত। চল্লিশ টাকা দর কেজি সীম, সে চার টাকার সীম কিনে শুটকি দিয়ে রান্না করে সুগন্ধি চালের ভাত চুরি করে খাইয়েছিল। এক জনমে এ ঋন পরিশোধ করা যাবেনা, আবার তার কাছে ঋন মুক্ত হতেও চাই না। তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার ঋন শোধ করতে হবে কেন? আজীবন ভালোবেসলে কি ভালোবাসা কমে যায় ?

১৬ ই অক্টোবর ২০১৩ ইং বেলা ১ টা ১৫ মি

বিষয়: বিবিধ

৬৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File