আজ সেই ভয়াল ২৯শে এপ্রিল!

লিখেছেন লিখেছেন Ruman ২৯ এপ্রিল, ২০১৭, ০৭:২৫:৩১ সন্ধ্যা

১৯৯১ সালের এইদিনে চট্রগ্রাম সন্দ্বীপ সহ উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া শতাব্দীর ভয়াবহতম প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়।

২৬ বছর আগে আজকের এই দিনে সন্দ্বীপের একটি সত্য ঘটনা!

আমি তখন যুবক ছিলাম। একদিন দেখি আকাশে খুব মেঘ। ভাবলাম ঝড় হ’তে পারে। পরিবারের সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিলাম। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি সাগরের দিক থেকে বিরাট জলোচ্ছ্বাস ৯-১০ ফুটের বেশী উঁচু হয়ে ছুটে আসছে। তখন ভাবলাম বাঁচার আর কোন উপায় নেই। সবাইকে জোরে অাঁকড়ে ধরেছিলাম। ৭-৮ বছরের এক ছেলে আমার কাঁধে ছিল।

পানি এতো জোরে এসে ধাক্কা দিল যে, ছেলেটা ছাড়া আর সবাই হারিয়ে গেল। তখন আমরা অনেক পানির নিচে। পানি আমাদেরকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। যখন পানির উপরে উঠলাম তখন কোথাও কোন ঠাই নেই। কোথাও কোন গাছ বা উঁচু কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ছেলেটা তখন কাঁধে। গলা ধরে আছে। ওকে বললাম, আববা! তুমি, দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধর, ছেড় না যেন! তাহলে ডুবে যাবে। ছেলেটি কাঁদছে আর বলছে, আববা তুমি আমাকে ফেলে দিও না। তাহ’লে আমি কিন্তু ডুবে যাব।

তখন আবার ঢেউ চলছে ২-৩ ফুট উঁচু হয়ে। আমরা সেই ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছি। পানি খেয়ে আবার উপরে উঠছি। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে আধা ঘণ্টার মত খুব কষ্টে সাঁতার কেটে বেঁচে আছি। কোথাও কোন ঠাই দেখা যায় না। তখন ভাবছি আর বোধ হয় বাঁচতে পারব না। জীবন যায় যায় অবস্থা। মনে মনে ভাবছিলাম ছেলেটা যদি গলা ছেড়ে ডুবে যেত তাহ’লে হয়তো নিজে বাঁচতাম। পরে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলে দিলাম, তুই আমার গলা ছেড়ে দে। ছেলে তখন কেঁদে ফেলল। আর কাঁদতে কাঁদতেই বলছে আববা! তুমি আমাকে ছেড়ে দিও না, আমি ডুবে যাব। বার বার বলার পরেও যখন ছেলেটি গলা ছাড়ছে না। তখন আমি হাত ধরে টান দিই। ছেলে আরো জোরে কাঁদে এবং জোরে গলা জড়িয়ে ধরে। আমরা দু’জনের কেউ মরতে চাই না, আবার কেউ বাঁচতেও পারছি না। (এমন পরিস্থিতিতে আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে একটু কল্পনা করুন তো, কেমন লাগে!)।

এটা ছিল মৃত্যুর পূর্বের ভয়াবহ অবস্থা। ছেলের কান্নাতে আমার আর মায়া হ’ল না। আমি ওর হাত টেনে কামড়িয়ে ধরলে, সে আমার গলা ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে ছেলেটি ডুবে যায়। পানির অনেক নীচে চলে যায়। তখন মনে মনে বললাম, বেঁচে গেছি।

এর মাত্র ৫ মিনিট পর আমার পায়ে উঁচু গাছের ডাল লাগল। আমি তার উপরে দাঁড়ালাম। সাথে সাথে ছেলেটির হৃদয় বিদীর্ণকারী কান্না জড়িত কথা কানে ভেসে আসল। চোখে বাঁধ ভাঙ্গা অশ্রু নেমে এলো। তখন ভাবছি এই তো ঠাই পেলাম, তবে কেন আমার ছেলেটাকে পানিতে ফেলে দিলাম! একি করলাম আমি? এইটুকু সময় আমি তাকে ধরে রাখতে পারলাম না! কত বড় ভুল হয়ে গেল! আমি সেখানে দাঁড়িয়ে জায়গাটাও বুঝতে পারছি। পানি সরে গেলে ওখানে লাশ পাওয়া যাবে। দেড়দিন পর পানি সরে গেল, আমি গাছে ছিলাম। একটু ক্ষুধাও লাগেনি, ঘুমও আসেনি। তারপর ছেলের লাশ সেখানে পেয়ে আরো কষ্ট হ’ল। যে কষ্ট আমি আজও ভুলতে পারছি না। আমার এখন কয়েকটা ছেলে-মেয়ে। বয়স ৫০ বছর। তবুও ঐ স্মৃতি আমাকে পাগল করে দেয়। তাই মাঝে মাঝে ভাবি, দুনিয়ায় এ অবস্থা হ’লে ক্বিয়ামতের দিন কি অবস্থা হবে? যেখানে কোন দিন মরণ হবে না। কেউ কাউকে সাহায্য করবে না।

আমার কথা!

দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে যদি কলিজার টুকরা প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে ছুড়ে দিতে পারে, তাহ’লে ক্বিয়ামতের ভয়াবহতায় মানুষ কি করবে সেটা চিন্তার বিষয়। যে দিবসের বিবরণ দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন ঐ বিকট ধ্বনি আসবে, সেদিন মানুষ পলায়ণ করবে তার নিজের ভাই হ’তে, তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান হ’তে। সেদিন তাদের প্রত্যেকেরই একই চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে’ (আবাসা ৩৩-৩৭)। অতএব সচেতন মানুষ মাত্রেরই ঐ জীবনের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক। পার্থিব জীবনে সঠিক প্রস্ত্ততি তথা সৎ আমল করতে না পারলে পরকালীন জীবনে কোন আপনজন কাজে আসবে না। বরং সেদিন সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। একান্ত আপনজনও পরিচয় দিবে না। ক্বিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!

বিষয়: বিবিধ

৮০৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

382828
২৯ এপ্রিল ২০১৭ রাত ০৮:১১
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ১৯৯০ সনের অক্টোবরে শেষের দিকে কুয়েত থেকে জরদানে স্বরনাত্রি হয়ে মাওলানা আমিন খাঁন রেজভী সাহেবকে নিয়ে দেশে পৌছি তখন এই ভয়াবহ দৃশ্যটি হাটহাজারিতে নিজ বাড়িতে থেকেই দেখেছিলাম এইটি কিয়ামতেরই একটি আলামত অাপনার লেখাটি অত্যান্ত বেধনা দায়ক আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দান করুন আপনাকে ধন্যবাদ
382847
০১ মে ২০১৭ দুপুর ১২:০০
হতভাগা লিখেছেন : ঐ সময়ে এস.এস.সি. পরীক্ষা দিচ্ছিলাম । ২৭ তারিখ বাংলা ১ম ও ২য় পত্র ( এক দিনে দুই সাবজেক্ট)পরীক্ষা দিয়ে সারা দেশে শুরু হয়েছিল ( বোর্ডগুলো আলাদা ছিল) । ২৯ তারিখ ছিল ইংরেজী পরীক্ষা (১ম ও ২য়)।

ঘুর্নিঝড়ের এলাকাগুলো কুমিল্লা বোর্ডের অধীন ছিল বিধায় সেখানে ২ মাস পরে আবার পরীক্ষা শুরু হয়েছিল । রেজাল্ট দিয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে।
382923
০৭ মে ২০১৭ দুপুর ০৩:২৫
Ruman লিখেছেন : আমিন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File