অরণ্যে সাথী

লিখেছেন লিখেছেন মহাকালের অসুখী ২৯ আগস্ট, ২০১৬, ০৯:৩২:৫৩ রাত



আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর

জায়গা হচ্ছে বিয়ে বাড়ী বা বিয়ের

অনুষ্ঠান। এক গাদা আটা ময়দার স্তুপ যেন

জীবন্ত হয়ে ঘুরা ফিরা করছে আর আরেক দল ক্যাবলা কান্ত মুগ্ধ হয়ে সেই আটা আর

ময়দার স্তুপের সৌন্দর্য অবলোকনে ব্যস্ত।

তার উপর হই হট্টগোলতো আছেই। প্রায় ৪-৫

বছর পর আজ আমি একটা বিয়ে বাড়ীতে এসেছি, এসেছি বলার সাথে যোগ করা দরকার যে, অনেকটা বাধ্য হয়ে এসেছি। বিয়ে খাওয়া বাদই দিয়ে ফেলেছিলাম আমি। সাথীর জন্য আসতে হলো আজ। সাথী আমার খালাতো বোন। ওরই বিয়ে আজ। আমার চাইতে বছর চারেকের ছোট হবে। আজ ওর কারণে বিয়ে বাড়ীতে অসহায় ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। এত অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি কোনদিন আর হইনি।

গত পরশু দিন হঠাৎ আমাকে সাথী ফোন করে। আমি তখন একটা বিশেষ কাজে চিটাগাং ছিলাম। সে ফোন করেই

বললো "অরণ্য ভাইয়া তুমি আমার বিয়েতে

আসবেনা?" আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম "নারেহ আমার আসা হবেনা। আর তাছাড়া আমিতো বিয়েতে যাইনা। তুই জানিস না?"

-জানি। কিন্তু কাল আমার গায়ে হলুদ আর

পরশু আমার বিয়ে। এই দুদিন তোমাকে

থাকতেই হবে। না থাকলে খুব খারাপ হবে

বলে দিলাম।

সাথীর কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম।

-কিরে ক্ষেপলি কেন? কি হলো আজ তোর?

দুদিন পর বিয়ে হঠাৎ আমাকে নিয়ে পড়লি

যে!

-আমি কিছু জানিনা। তোমাকে আসতে হবে

নয়তো এ বিয়ে, গায়ে হলুদ কিচ্ছুই হবেনা।

-দেখ সাথী কাল কাজ সেরে বাসায় আসতে

আসতে আমার রাত ১২ টা বাজতে পারে।

বুঝতেই পারছিস চিটাগাং টু সিলেট দূরত্ব

কতটুকু?এতো লং জার্নি করে গায়ে হলুদে

আসা হবেনা আমার নিশ্চিত। ঠিক আছে

বিয়েতে আসার চেষ্টা করবো।

-আচ্ছা বিয়েতে তাহলে আসতেই হবে। না

হলে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাবে।

সাথীর কথা শুনে আমার ভয় ধরে গেল।

-কি ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে!

-তুমি না আসলে আমি সবাইকে বলবো "আমি

এ বিয়ে করবোনা। আমি অরণ্য ভাইয়াকে

ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালবাসে।

আমিতো হতবাক ফোনের অপাশ থেকে এসব কথা শুনে। বলে কি এই মেয়ে! জীবনে কোনদিন একটানা ১০ মিনিট ওর সাথে কথা বলেছি বলেওতো মনে হয়না।

-এসব কি ফাজলামো করছিস সাথী?

-একদম ফাজলামো না। তোমাকে আসতেই

হবে। না আসলে দেখে নিও কি করি আমি।

আমি কিছু বলার আগেই সাথী কল কেটে

দিয়েছিলো। সারারাত আমার ঘুম আসলোনা। সাথীর কথাগুলো মাথায় কিলবিল করলো শুধু। পরদিন বেশ রাতে বাসায় এসেই খাওয়া

দাওয়া সেরে দিলাম ঘুম। আব্বু আম্মু সেদিন

দুপুরেই চলে গিয়েছিলেন মেজ খালার বাসায় সাথীর বিয়ে উপলক্ষ্যে। সকাল ছয়টায় ফোন বাজলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সাথী।

-ভাইয়া তুমি আসছতো?

-এখনতো ভোর ছয়টা বাজে!

-তাতে কি? তুমি উঠো। না উঠলে ঘুমিয়ে

গেলেতো আর সারাদিনেও উঠবেনা।

-আচ্ছা সাথী বিষয়টা কি বলতো?তুইতো

আমাকে বিরাট চিন্তায় ফেলে দিয়েছিস।

-এলেইতো সব শুনবে ভাইয়া। প্লীজ আসবে

কিন্তু।

আমি আর ঘুমালামনা। আসলেই আমি ঘুমের বাদশাহ। ঠিকঠাক ঘুম লেগে গেলে সহজে ভাঙেনা। তাই বিছানা থেকে নেমে গোসল টোসল সেরে ফেললাম। সম্পুর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবে সকাল সাড়ে দশটার দিকে হাজির হলাম

বিয়ে বাড়ীতে। আমাকে দেখে সবাই অবাক। কারণ বিয়ে সাদীর অনুষ্ঠানে আমাকে দেখা যায়না বললেই চলে। আব্বু আর

আম্মু বেশী অবাক হলেন আমাকে দেখে। আব্বুতো জিজ্ঞেস করেই বসলেন -কিরে তুইও যে চলে এলি!

কোনরকম আব্বুকে বললাম -বাসায় একা একা ভাল্লাগছিলোনা তাই চলে এলাম আরকি।

খুব রাগ হচ্ছিলো সাথীর উপর। ওর জন্যেই এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লাম। ঠিক তখনি সাথী বাসার করিডোরে আমাকে

একা পেয়ে হাতের মাঝে একটা চিঠি ধরিয়ে

দিয়ে বললো "অরণ্য ভাইয়া এটা নিয়ে

সোজা ছাদে যাও।

ইচ্ছে করেই মনে হলো হাতটা ধরে রাখলো

সাথী কয়েক সেকেন্ড। তারপর আমাকে কিছু

বলতে না দিয়েই চলে গেল। ছাদে গিয়ে একটা সিগ্রেট ধরালাম আগে। যেকোন বাসার ছাদে গেলেই কেন জানি সিগ্রেটের খুব বেশী তেষ্টা পায় আমার।

চিঠিটা বেশ বড়। সম্বোধন দেখেই অবাক আমি! তারপর শুরু করলাম পড়া।

অরণ্য‚

হিহিহি। উপরে ভাইয়া না লিখে শুধু

তোমার নাম লিখেছি বলে অবাক হয়ে ভ্রু

কুঁচকে ফেলেছো, তাইনা? পড়তে পড়তে

চিটির শেষ পর্যায়ে যখন যাবে এর চাইতে

ঢের বেশী অবাক হবে। খবরদার এখনই শেষটা পড়তে যেওনা।

আচ্ছা অরণ্য মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের বাসায় এসেছিলে তুমি। সেদিন কেন জানি আমার মনটা খুব খারাপ ছিল। আমি মুখ গোমড়া করে বসেছিলাম।

তুমি এসে বললে- কিরে কি হয়েছে?

আমি বললাম- মন খারাপ‚কিছু ভাল্লাগছেনা।

তখন তুমি বললে-অহ এই ব্যাপার?আমি কিন্তু মন ভালো করার অনেক উপায় জানি।

আমি বললাম -তাহলে ভাইয়া জলদি আমাকে

একটা উপায় বলো।

তুমি তখন জিজ্ঞেস করলে-মন বেশী খারাপ না অল্প?

-খুব বেশী।

-হুম চিন্তার বিষয়। অল্প হলে সহজ পদ্ধতি।

মোম জ্বালিয়ে কিংবা চুলায় গিয়ে নিজে

নিজে আগুনের ছ্যাঁকা নেয়া। কিন্তু তোর মন

বেশী খারাপ। ব্লেড সিস্টেম এপ্লাই করতে

হবে।

- ব্লেড সিস্টেম মানে?

আমি তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছিলাম।

তুমি তখন বললে একটা ব্লেড নিয়ে হাত পা

কিংবা শরীরের যে কোন জায়গায় একটা

পোচ দে। দেখবি মনযে খারাপ ছিল সে কথা

মনেই পড়বেনা।

কথাগুলো বলেই তুমি হাসতে হাসতে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে।সম্ভবত সিগারেট খেতে। জান অরণ্য এই সিগ্রেট জিনিসটা আমার দুই চোখের দুশমন। কিন্তু তুমি যখন আমাদের বাসায় ছাদে উঠে লুকিয়ে সিগ্রেট টানতে আমি অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি। আমার ভালো লাগতো। তোমার মুখের ভেতর থেকে বের করা ধুয়া দেখে আমার মনে হত মেঘ। আর আমি সেই মেঘের মাঝে তোমার হাত ধরে ভাসছি। অথচ একবার বাসে একটা ছেলেকে থাপ্পড় পর্যন্ত দিয়েছিলাম সিগ্রেট নিয়ে ঝগড়া করে। কারণ ঐ ছেলের সিগ্রেটের ধূয়া আমার নাকে এসে লাগছিলো আর তোমার কথা আমার খুব বেশী মনে পড়ে হচ্ছিলো। জানো অরণ্য ঐ ছেলের সিগ্রেট টানার স্টাইল মোটেও তোমার মতো ছিলনা।সে যাই হোক প্রায় দশ মিনিট পরে তুমি আবার বাসায় আসলে। এসে দেখলে আমাকে

সবাই ঘিরে বসে আছে। ছোট আপুকে তুমি

তখন জিজ্ঞেস করলে কি হয়েছে সাথীর?

আপু বললো ব্লেড দিয়ে কিভাবে জানি

আঙ্গুল কেটে ফেলেছে। সে কথা শুনে তুমি

আমার দিকে এত অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিলে

যে, আমি আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সেই চাহনী। ঐ কয়েকটা সেকেন্ড অপরাধীর দৃষ্টি দিয়ে তুমি আমার দিকে

তাকিয়েছিলে। সেদিন তুমি কি একটা

কাজের অজুহাতে পালিয়ে গিয়েছিলে হঠাৎ

আমাদের বাসা থেকে। তুমি চলে যাবার পরই

আমি আবিষ্কার করলাম আমি প্রচন্ড ভাবে

তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। তোমার সেই

অদ্ভুত চাহনীর জন্য নাকি অন্য কোন কারণে

তা আমি বুঝিনি।শুধু ভালবাসাটাই উপলব্ধি

করেছিলাম। সেদিন বাথরুমে গিয়ে অনেক্ষন

কেঁদেছিলাম তোমার কথা ভেবে ভেবে।

কাটা আঙ্গুল নিয়ে সারা রাত জেগে একটা

চিটি লিখলাম তোমাকে উদ্দেশ্য করে।

মনের যত আবেগ ছিল সব ঢেলে দিয়েছিলাম সে চিঠিতে। লেখা শেষ করে দেখি হাতের

লেখাটা বিশ্রী দেখাচ্ছে। ছিড়ে কুটিকুটি

করে ফেললাম তাই। আমার জীবনের প্রথম

প্রেমের চিঠিটা আর দেয়া হলোনা। এরপর

তুমি আমাদের বাসায় বহুবার এসেছো। আমি

কখনো কলেজে, কখনো ভার্সিটিতে থাকতাম। তোমাদের বাসায়ও গিয়েছিলাম কয়েক বার। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই কিছু বলতে পারিনি। আমি জানতাম আব্বু আম্মু কখনো আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেনা। কারণ আজীবন তুমি ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরেছো পড়ালেখা বাদ দিয়ে। তাছাড়া আব্বু কেন জানি তোমাকে সহ্য করতে পারেন না। সবকিছু ভেবে আমি আমার

ভালবাসাটাকে আমার মাঝেই মাটি চাপা

দিয়ে রেখেছি। কাউকে বুঝতে দেইনি। কিন্তু আজ তোমাকে এত বিশাল চিঠি দিচ্ছি কেন জানো? প্রতিশোধ নিতে! একটু

হলেও তোমাকে পোড়াতে আমার যন্ত্রণার

আগুনে। কিভাবে যন্ত্রণা পাবে জানো? তুমি এই চিঠি পড়ে, একটা মেয়ে তোমাকে এতো ভালবেসে ভেবে আত্মতৃপ্তিতে মশগুল হবার সময়ই পাবেনা। কারণ আমি তোমার চোখের

সামনে দিয়ে তখন আমার বরের হাত ধরে

চলে যাবো। আমি জানি তোমাকে তখন অসীম

শুণ্যতা গ্রাস করে নেবে। এটাই আমার প্রতিশোধ। যদিও তোমার কোন দোষ নেই।

আমিতো তোমাকে কোনদিন বলিনি

ভালোবাসি। কিন্তু তবুও যাকে আমি মনে মনে

এতদিন ধরে পাগলের মত ভালোবাসলাম সে

তার কিছুই উপলব্ধি করবেনা‚ এটাতো হয়না।

হিহিহি। পৃথিবীতে এটাই হয়তো একমাত্র

ঘটনা অরণ্য। তুমি যেদিন জানলে তোমাকে

কেউ একজন ভালোবাসে সেদিনই তার বিয়ে।

আবার তুমি সেই বিয়েতেও উপস্থিত। আর যে

তোমাকে ভালবাসে সে তার বিয়ের দিন

তোমাকে ভালবাসার কথা বললো। তোমারতো লেখালেখি করার একটা অভ্যাস আছে। বেশ ভালো একটা প্লট দিলাম তোমাকে গল্প লেখার। তাইনা? যাই হোক শুনো অরণ্য

চিঠিটা পড়ে পালিয়ে যাবে এটা ভাবলে

কিন্তু খুব খারাপ হবে। আমার বিদায় পর্যন্ত

তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে। আমি

চাই তোমার সাথে আমার চোখাচোখি

হোক। আমি তোমার অদ্ভুত সুন্দর চোখের

মাঝে হতবিহবল ভাবটা বার বার দেখতে চাই

আজ। পালিয়ে গেলে আমি সত্যি কিন্তু ভরা

বিয়ে বাড়ীতে চিৎকার দিয়ে বলবো "আমি

অরণ্যকে ভালোবাসি। এই বিয়ে আমি

করবোনা, অরণ্যকে এনে দাও"। আচ্ছা বিয়ের আসর থেকে উঠে হঠাৎ যদি আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে সবার সামনে বলে উঠি অরণ্য

আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে নিয়ে

যেতে দিওনা প্লীজ। কেমন হবে তখন?আমার

বিয়ে ভেঙ্গে যাবে তাইনা? হিহিহি। ভয়

পেলে? এবার নেমে এসো ছাদ থেকে। তোমার ডিউটি শুরু। ডিউটি টু স্ট্যান্ড ফ্রন্ট অফ দ্য ব্রাইড।

সত্যি সত্যি আমি এখন বেকুবের মত ডিউটি

করছি বিয়ে বাড়ীতে। সাথীর চোখে চোখে থাকার ডিউটি। আমার সত্যি খুব অসহায় লাগছে। সাথীর প্লান একদম সাক্সেসফুলি কাজ করছে। আমার এখনই কেমন

সবকিছু শূণ্য মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে বাথরুমে

বা আড়ালে গিয়ে একটু কাদি। কিন্তু সেটা করতেও গেলামনা। পাগলীটার সামনে থেকে যেতে ইচ্ছে করছেনা। এত মানুষ বিয়ে বাড়ীতে

কিন্তু আমার চিন্তা চেতনা কিংবা দৃষ্টি

সবকিছু ঐ সাথীকে ঘিরেই। কোনদিন টেরই

পেলামনা কেউ একজন আমাকে এতো

ভালোবাসে। ভীষণ রাগ হচ্ছে সাথীর উপর।

আমাকে এই কষ্ট দিয়ে তার কি লাভটা হলো?

একবার ভেবেছিলাম পালিয়েই যাবো। বিয়ে

ভেঙ্গে দিলে ভেঙ্গে দিক সাথী। দেখি ওর

সাহস। কিন্তু কেন জানি পালাতে পারলামনা। ক্যাবলাকান্তদের মতো আমি

আজ নিজেই হা করে বার বার তাকাচ্ছি

সাথীর দিকে চোখাচোখি হবার আশায়। এ

নিয়ে দুবার হয়েছেও। আচ্ছা আমি কি চাচ্ছি

সাথীর বিয়েটা ভেঙ্গে যাক? সাথী কোন উদ্ভট কান্ড করে বিয়ে ভেঙ্গে দিক এটার

আশাই কি করছি আমি? সত্যি সত্যি যদি এখন সাথী দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে-

" অরণ্য ভাইয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আমাকে নিয়ে যেতে দিওনা প্লীজ।"

দৃশ্যটা কেমন দেখাবে তাহলে?

বিষয়: বিবিধ

১৩১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File