সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ২

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১২ জুন, ২০১৭, ১২:৪০:৩০ রাত

জামাল গোধুলি বেলায় বাড়িতে পৌছল, টলতে টলতে গিয়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়াল। তার মা আসরের নামায পড়ে আর জায়নামায থেকে উঠেনি, বসে বসে তাসবিহ জপছে। কনিষ্ঠ মেয়েটা চৌকিতে বসে আছে, বাকি দুইটা ঘর নেই। মা ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে তুই একা এলি তোর বাপ কোথায়, মাদ্রাসায়? জামাল সহসা দু’হাতে মাথা চেপে ধরে অন্তহীন বেদনায় মুখটা হা করে উঠল, এক মিনিট পর্যন্ত দম ফেলল না। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে ‘আব্বা আর নেই’ বলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে চিৎকার শুরু করল ‘আব্বার বুকে গুলি লেগেছিল, আমি মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর দুই দিন পর্যন্ত সব জায়গায় খুঁজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না’ বলে সে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে বিলাপ করতে লাগল। মা শুধু ‘হায় আল্লাহ, আল্লাহ গো তুমি এভাবে আমার কপাল পোড়ে দিলে’ বলে চিৎকার করে জায়নামাযে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকলেন। ছোট মেয়েটা ‘ও আব্বা আব্বা গো’ বলে চিৎকার করে চৌকি থেকে মাটিতে পড়ে ধাফরাতে লাগল আর হাত পা ছুড়তে লাগল।

বস্তির মত বড় বাড়ি, চিৎকার শুনে পাশের বাড়ি থেকে বড় দুই মেয়ে দৌড়ে এল, অন্যান্য লোকজন এল। ছোট মেয়েটা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে আর মাতম করছে। বোনদের দেখেই সে লাফিয়ে উঠে গিয়ে বড় বোনের গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করল, ‘ও আপা আপা গো, আব্বা আর নাই, আব্বারে মাইর‍্যা ফালাইছে, আমরা ইয়াতিম অইয়্যা গেছি। বড় মেয়েটার মাথা ঘুরিয়ে গেল, পৃথিবিটা যেন লাঠিমের মত ঘুরছে। সে ধরাম করে মাটিতে পড়েই দাতে দাঁত লেগে গেল। পাগলাটে প্রকৃতির মেজো মেয়েটা বাবার খুব আদরের ছিল। তার দেহটা লাফিয়ে উঠে ধপাস করে মাটিতে পড়ে চার হাত পা মাটিতে মারতে লাগল আর মাতম শুরু করল, ‘আব্বা আব্বা গো তুমি কই গেলা, আমারে ছাইর‍্যা তুমি কই গেলা, তুমি না আমারে এত আদর করতা, এখন আমারে থুইয়্যা কই পালাইছ।

সে জবাই করা পশুর মত ধাপরাচ্ছে আর চিৎকার করছে। তার চিৎকার শুনে গায়ের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে এল। মহিলারা ধরাধরি করে বড় মেয়েটা ও তার মাকে বিছানায় নিয়ে মাথায় পানি দিতে লাগল। কিছুক্ষন পর তাদের হুস ফিরে এল, চেতন পেয়েই বড় মেয়েটা মাথার চুল ছিড়তে ছিড়তে ‘আব্বা আব্বা গো, তুমি কই গেলা, আমাদেরকে কই রাইখ্যা গেলা, এখন আমাদের কি হবে কে লালন পালন করবে’ বলে মাতম করতে করতে আবার মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

তারপর তিন বোন কখনো গলাগলি জড়াজড়ি করে কাদে, কখনো মাটিতে পড়ে হাত পা ছোড়ে, কখনো টেনে টেনে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে, নাকে মুখে মাথায় হাত মারে, অকস্মাৎ শোকের আতিশয্যে তারা মানবিক চেতনা হারিয়ে ফেলল। মাওঃ জালালুদ্দিনের পর্ণ কুটিরে কারবালার মাতম উঠে।

মেঝো মেয়েটা বসে বসে নিজের মাথার চুল ছিড়ছে আর চিৎকার করছে ‘আব্বা তুমি না আমারে এত আদর করতা, আমারে ছাড়া তুমি থাকতে পারতে না, খেতে বসতে না। তুমি না কইছিলা ক্লাসে এক রোল হতে পারলে ঘড়ি কিন্যা দিবা, স্বর্নের আংটি বানাইয়্যা দিবা, নতুন বোরখা বানায়া দিবা, আমারে ময়মনসিংহের বড় মাদরাসায় ভর্তি কইর‍্যা দিবা। তাইলে অহন পালাইছ ক্যা, এই কুত্তার বাচ্চা পালাইছস ক্যা, এখন আমার কি অইবো, কে আমারে আদর করব, কে আমার আবদার পূরণ করব। না তোরে আমি কোথাও যাইতে দিমু না, আমারে লইয়া যা, তুই পালাইতে পারবি না, আমারে লইয়া যা কুত্তার বাচ্চা আমারে লইয়া যা’ বলে বিকট চিৎকার করে মেয়েটা সহসা দাঁড়িয়ে বাইরের দরজা দিয়ে দৌড় দিল, সে তার বাবার কাছে যাবে। বাড়ির মহিলারা দৌড়ে গিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে আনতে চাচ্ছে কিন্তু সে পাগলের মত হাত পা ছোড়ছে, মহিলাদের কামড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে ‘আমারে যাইতে দে, যাইতে দে, আমি আব্বুর কাছে যামু’। এভাবে হাঙ্গামা করতে করতে সে বাইরেই বেহুশ হয়ে গেল। তারপর মহিলারা তাকে ধরাধরি করে ঘরে আনল।

বড় মেয়ে ও ছোট মেয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরের মেঝেতে কুকুর কুণ্ডলী মেরে পড়ে আছে, ফুলে ফুলে কাঁদছে। তাদের মা কাস্ট খণ্ডের মত চৌকিতে লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছে। তার কোন রা নেই, ভাষা নেই, কান্না নেই যেন একটা নিশ্চল পাথর পড়ে আছে। ড্যাব ড্যাব করে দু’টি চোখ তাকিয়ে আছে কিন্তু বুঝা মুশকিল এই চোখ কি জীবিত নাকি মৃত। এইভাবে মাওঃ জালালুদ্দিনের হাসি খুশি সুখি পরিবারটি সহসা কলকাকলি পুর্ণ জান্নাতের চত্বর থেকে জাহান্নামের উপত্যকায় ছিটকে পড়ল। একটি পরিবারের আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধ আহলাদের চির সমাধি রচিত হল। যুগে যুগে শাসক শ্রেণীর নিষ্ঠুরতা আর বিদ্রোহী দল ফেরকার স্বেচ্ছাচারিতায় কত মজলুমের রক্তাশ্রু ঝড়ে পড়েছে, কত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, কত স্বপ্নময় চোখের আলো নিভে গেছে - এর পরিসংখ্যান কারো জানা নেই।

এশার পর পাশের বাড়ি থেকে ডাল ভাত রান্না করে নিয়ে এল। বাড়ির মহিলারা সবাইকে টেনে তুলে জোর জার করে মুখে লোকমা তুলে দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু খাওয়াতে পারল না। শুধু ছোট মেয়েটা ও ছেলেটা কয়েক লোকমা খেল। মেজো মেয়েটা মুখে লোকমা নিল কিন্তু বমি করে দিল, খেতে পারল না। মা ও বড় মেয়ে এক ঢোক পানি পর্যন্ত খেল না। বাড়ির মহিলারা মা ও মেয়েদের শান্তনা দিতে লাগল, ‘কান্না কাটি করে আর কি হবে, আল্লাহর উপর তো কারো হাত নাই, আল্লাহর ইচ্ছা হইছে তার বান্দাকে নিয়া গেছে। কিন্তু যারা ডেকে নিল আর যারা এমন নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করল আল্লাহ কখনোই তাদের ক্ষমা করবেন না। অবশ্যি এর কঠোর বিচার করবেন, তোমরা সবাই ধৈর্য্য ধর, আল্লাহর হাতে এর বিচার ভার ন্যাস্ত কর, আমরাও আল্লাহর দরবারে এর বিচার চাই।

এভাবে তারা শান্তনা দিতে থাকল আর মেয়েগুলিকে মাটি থেকে বিছানায় তোলার চেষ্টা করল কিন্তু বড় মেয়ে ও ছোট মেয়ে উঠল না, মেজো মেয়েটা মরার মত পড়ে ছিল, তাকে ধরাধরি করে বিছানায় তুলে মহিলারা চলে গেল। নিম্নবিত্ত মাওঃ জালালুদ্দিনের বিশ হাত লম্বা একটা টিনের ঘর, বাশের চাটাইয়ের বেড়া। এক পাশে তাদের থাকার রুম, মাঝখানে মাচা, অপর পাশের রুমে মেয়েদের থাকার জন্য দুপাশে দুইটা চৌকি পাতা রয়েছে। আর ছেলের থাকার জন্য বারান্দায় আলাদা রুম। সদ্য ইয়াতিম হওয়া পরিবারটি মেয়েদের রুমে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কয়েক লোকমা খেয়েই জামাল আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। শীঘ্রই তার ক্লান্ত দু’টি চোখে ঘুম নেমে আসে। আসলে এটা ঘুম নয়, এটা দেহের উপর ক্লান্তির একটা অবসাদ।

মধ্যরাত। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুকটা চিন চিন করে ব্যথা করছে। মাথাটা খোলা শুন্য মনে হচ্ছে। রাজ্যির দুঃখ ব্যথা যন্ত্রণা হিমালয়ের মত তার দেহের উপর চেপে আছে, শরীরটা জাহাজের মত ভারি মনে হচ্ছে। ব্যাথা ও যন্ত্রনার বিষ সাপের বিষের মত দেহের প্রতিটা কোষে কোষে ঢোকে গিয়ে শরীরটা বিকল করে দিয়েছে। সে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে এখন তাদের কি হবে, মা, তিনটি বোনের ভবিষ্যৎ, তার নিজের ভবিষ্যৎ? কিন্তু না কোনই আশার আলো নাই, শুধুই অন্ধকার, তাদের জীবন অন্ধকার, জগত অন্ধকার। তারা আলোর ভুবন থেকে আধার সিন্ধুতে তলিয়ে গেছে এ জন্মের তরে। আর সে শুয়ে থাকতে পারল না অস্বস্তি লাগছে। তার ভারি শরীরটা টেনে তুলে উঠে বসে চারিদিকে তাকাল, বড় ও ছোট মেয়েটা কুকুর কুণ্ডলী মেরে মাটিতে পড়ে আছে, মেজো মেয়েটা মায়ের পায়ের কাছে জড়সড় হয়ে পড়ে আছে, মা শুয়ে আছে কিন্তু নাড়াচাড়া নেই। দৃশ্যটা দেখেই তার আত্মাটা হাহাকার করে উঠল, বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে চোরমার হয়ে গেল।

সে এক পাশের চৌকিতে মা আরেক পাশের চৌকিতে, সে আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াল। মা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। কোন পলক পড়ছে না। মরে গেছে কিনা চমকে উঠে সে চিৎকার করল ‘আম্মা’। মা ছেলের মুখের দিকে তাকালেন, তারপর ‘আহ, আমার সব শেষ, আমার সব শেষ হয়ে গেল, আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল.... বলে মা এই প্রথম বিলাপ শুরু করলেন। জামাল দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল, তারপর দ্রুত পায়ে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দক্ষিণমুখী বাড়ির সামনে প্রশস্ত উঠান, তারপর পুর্ব পশ্চিমা রাস্তা। রাস্তা দিয়ে তিনশ হাত পশ্চিমে গিয়ে আবার দুইশ হাত দক্ষিণে গেলেই একটা খোলা জায়গায় মসজিদ, আশ পাশে কোন বাড়ি ঘর নেই।

সে মসজিদের বারান্দায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সীমাহীন যন্ত্রনায় দুইহাতে মাথা চেপে ধরে উর্ধ্বে তাকিয়ে চিৎকার করল, ‘ইয়া আল্লাহ, আল্লাহরে, কেন আমাদেরকে এত বড় শাস্তি দিলে। কেন আমাদের এত বড় সর্বনাশ করলে, কেন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে, কেন আমাদের ধ্বংস করে দিলে। কেন আমাদের ইয়াতিম করে দিলে। কি অপরাধ ছিল আমাদের, আমরা কত বড় গুনাহগার, তোর দ্বীন রক্ষা করতে যাওয়াই কি আমাদের গুনাহ হয়েছে। যারা তোর দ্বীনের প্রদীপকে ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় তারা থাকে নিরাপদ শান্তিতে। যারা তোর দ্বীনের শত্রু তাদেরকে দিয়ে আমাদের ইয়াতিম বানিয়ে দিলে। তোর দ্বীনের কাজ করলে শাস্তি পেতে হয় আর তোর দ্বীনের শত্রুতা করলে শান্তি পাওয়া যায় এ তোর কোন ইনসাফ। তোর দ্বীনের কাজ করার পুরুস্কার স্বরুপ আজ আমরা ইয়াতিম হয়ে গেলাম।

এখন আমাদের কি হবে। কে আমাদেরকে লালন পালন করবে। আমার তিনটা বোনের কি হবে, কে তাদেরকে বিয়ে শাদি দিবে, তাদের জীবন কি নষ্ট হয়ে যাবে’ সে আর কথা বলতে পারল না, তীব্র কষ্টের দহন যন্ত্রণায় মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে, ভিতরের কষ্টের পাহাড় গলা ফেটে বের হতে চাচ্ছে, সে চিৎকার করছে, কলিজা ফাটা চিৎকার করছে কিন্তু চরম কষ্ট ও চিৎকারের তীব্রতায় গলা বুজে গিয়ে শুধু ক্ষিণ আওয়াজ বের হচ্ছে। সে মাথার চুল ছিঁড়ছে, নাকে মুখে মাথায় হাত মারছে, চিৎকার করছে আর মসজিদের বারান্দায় গড়াচ্ছে। ইমাম সাব থাকেন মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে এক বাড়িতে। মসজিদে কারো কান্নার আওয়াজ পেয়ে তিনি উঠলেন কিন্তু যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তিনি জানেন গভির রাতে জ্বিন ভুতেরা ইবাদত করে, কান্নাকাটি করে।

অবশেষে হারিকেন জ্বালিয়ে ভয়ে ভয়ে কম্পমান পায়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন। বারান্দায় এসে বুঝতে পারলেন, সদ্য ইয়াতিম হওয়া বালক জামালুদ্দিন চিৎকার করছে আর মাটিতে গড়াচ্ছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্তনা দিতে লাগলেন, ‘কেঁদো না বাপ কেঁদো না, আল্লাহ তোমাদেরকে এর উত্তম জাযা দান করবেন। আমাদের রাসূল (সাঃ) ইয়াতিম ছিলেন, কাজেই ইয়াতিমদের উপর সব সময় আল্লাহর খাস রহমত থাকে। যারা তোমাদেরকে ইয়াতিম বানাল আল্লাহই তাদের বিচার করবেন। উঠ বাবা উঠ’ বলে ছেলেটাকে তুলে ডান হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে চললেন। তারপর নিজের রুমে নিয়ে শান্তনা দিতে দিতে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। জামাল কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল।

মাওঃ জালালুদ্দিনের এক ছেলে তিন মেয়ে। জামালুদ্দিন সকলের বড়। তারপর দুই তিন বছরের ব্যবধানে পিঠাপিঠি তিন মেয়ে। বড় মেয়ে জয়নবের বয়স পনের বছর, মেজো মেয়ে রুকাইয়্যার বয়স তের বছর, ছোট মেয়ে ফাতেমার বয়স দশ বছর। মেজো মেয়েটা প্রচণ্ড রাগি, ডানপিটে ও পাগলাটে। ছোট বেলা থেকেই বাবার কাছে তার বায়নার অন্ত ছিল না। তার অভ্যাস ছিল বাবার কাছে কোন জিনিসের বায়না ধরলে সেটা না আনলে আর রক্ষে নেই। সে বাবার উপর হামলে পড়ত, ‘এই কুত্তার বাচ্চা আমার জিনিসটা আনলি না কেন, এক্ষুণি এনি দিবি’ বলতে থাকত, হাত পা ছোড়ে নাচতে থাকত আর বাবার চুলে ধরে টানত, বুকে পিঠে কিলাত। তখন বেচারা বাবা পরিমরি দৌড়ে গিয়ে সেটা এনে দিত আর বলত ‘আমার পাগলিটার জ্বালায় আর বাচলাম না, কবে যে তোর বুঝ হবে’।

বাবা বাহির থেকে এলে মেজো মেয়ের জন্য কাপড় চোপড় হউক, খাদ্য দ্রব্য হউক বা অন্য যে কোন একটা না একটা কিছু নিয়েই আসতেন, আর বাড়িতে পৌঁছেই ডাক দিতেন ‘আমার পাগলি মা কইরে। তখন সে যেখানেই থাকুক পোষা পাখির মত উড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরত। এসব দেখে বাকি দুই মেয়ে ভেংচি কাটত, ‘তুই একাই আব্বার মেয়ে আমরা হলাম তার পালক মেয়ে, এ জন্যই তোকে বেশি আদর করে। তখন সে দাঁত বিজলিয়ে বলত ‘হ আমি হলাম আসল মেয়ে আর তোরা নকল মেয়ে। জালালুদ্দিন তার সবগুলি সন্তানকে সমান ভালবাসত, যা উপার্জন করত মেয়েদের পিছনে ব্যয় করত কিন্তু মেজো মেয়েটার পাগলামির কারণে তাকে অধিক আদর করত। সেও ছোট কাল থেকে বাবার সাথে ছায়ার মত লেগে থাকত। বাবার কাপড় ধোয়া, পান সুপারি কেটে দেয়া ইত্যাদি কাজ সেই করত তার মাকে করতে দিত না। এক সময় মেয়ে বড় হয়ে গেলেও মেয়ে মনে করত সে এখনো কচি খুকি আর বাবা মনে করত তার কোলের বাচ্চা। এভাবেই সে বাবার রক্তের সাথে মিশে যায় এবং পিতা পুত্রির আধ্যাত্মিক সম্পর্ক নিবিড় হয়ে আসে। এজন্যই অন্যরা পিতৃ বিচ্ছেদের শোক কাটিয়ে উঠতে পারলেও সে পারল না।

পরদিন সবাই উঠল আনাগুনা করল কম বেশি খাওয়া দাওয়া করল কিন্তু সে উঠল না, বিছানায় লম্বালম্বি হয়ে পড়ে থাকল। সারাটা দিন সে বিছানায় পড়ে রইল। অন্যরা খাওয়াতে চেষ্টা করল কিন্তু কিছু খেল না। কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার দিয়ে উঠে ‘আব্বা আব্বা গো, তুমি কই গেলা, আমারে নিয়া যাও আব্বা। পরদিন তার অবস্থা আরো শোচনীয় হল। বাড়ির মহিলারা এসে জোর করে খাওয়াতে চাইল, মুখে লোকমা তুলে দিল কিন্তু সে খেতে পারল না। গলার নিচে ভাত নামে না, গিলতে চাইলেই বমি আসে। আধা চেতন অবস্থায় সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকল। একটু চেতন হলেই বাবাকে ডাকে আর কাঁদে। পরদিন অবস্থা আরো খারাপ হল, কোন চেতনা নেই, বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। কোন ভাবেই খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অগত্যা ডাক্তার এনে স্যালাইন পোশ করে রাখা হল। কিন্তু সেলাইন দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। সে কিছুক্ষণ পরপর চেতন পেয়ে হাত পা ছোড়ে সেলাইন খোলে ফেলে আর আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে, কাঁদে। ইয়াতিম পরিবারটির জন্য নেমে এল মরার উপর খরার ঘা।

বিষয়: রাজনীতি

৮৩১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383338
১২ জুন ২০১৭ রাত ০২:০৮
মনসুর আহামেদ লিখেছেন :
ভালো লাগলো , অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File