‘জা’আল হাক্ব ওয়া যাহাক্বাল বাতিল- সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ১

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১১ জুন, ২০১৭, ১২:১২:১৮ রাত

প্রথম অধ্যায়

রোজ ক্বিয়ামতের বিভীষিকা, বরং এরচেয়েও খতরনাক। ময়দানে মাহশারে আলো থাকবে কিন্তু সেখানে কোন আলো ছিল না। হঠাৎ বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হল, চারিদিকে আধার নেমে এল। তারপর কিছুক্ষণ গোরস্থানের নীরবতা। এরপর গাড়ির আলো ও শব্দে চারিদিক মুখর হয়ে উঠল, তারপর ভারি বুটের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, আর এরপরই শুরু হল নারকীয় তাণ্ডব, এক পৈশাচিক বীভৎসতা। পেটোয়া বাহিনীর লাঠিপেটা, গুলির শব্দ, মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার, আহতের আর্তরব, ডাক চিৎকার, মৃতের মরণ গোঙ্গানি। অসহায় মানুষ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে, আপন জনদের ডাকছে, ভাইকে বাবাকে বন্ধুকে খুঁজছে, উচ্চস্বরে ডাকছে, দৌড়ছে, উর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে, অগণিত মানুষের ভীরে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, ভিত সন্ত্রস্ত মানুষের জীবন নিয়ে পালানোর নিরন্তর প্রয়াস। কেউ মাটিতে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু উঠার সুযোগ নাই, উদভ্রান্ত মানুষের পদতলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুরু হয় নিরস্ত্র নিরাপরাধ মানুষের উপর ধ্বংস আর প্রলয়ের উদ্দাম নৃত্য। অগণিত মানুষের মৃত্যু কারাগার, রক্ত সরোবর, সেখানে কারবালার মাতম উঠে।

মাওঃ জালালুদ্দিন রাত বারটার দিকে ছেলেকে নিয়ে হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করে এসে আবার বসলেন। সতের বছরের ছেলে জামালকে নিজের উরুর উপর শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঘুম পাড়ালেন। সবাই আমল ইবাদত করছে, কেউ তাহাজ্জুদ পড়ছে, কেউ কোরান তেলাওয়াত করছে কেউ তসবীহ টিপছে। তিনি ছেলের মাথার নিচে রুমাল গুজে দিয়ে নামাযের জন্য উঠে দাঁড়ালেন কিন্তু তখনি বিদ্যুৎ চলে গেল। কারেন্ট আসার অপেক্ষায় তিনি আবার বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবাক হয়ে লক্ষ করলেন অসংখ্য গাড়ি এসে তাদের ঘিরে ফেলেছে। মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। তিনি ছেলের গায়ে ধাক্বা দিতে দিতে ডাকতে লাগলেন, ‘জামাল জামাল, বাজান উঠ মনে হচ্ছে গণ্ডগোল হবে’।

গাড়ির আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠেছে, সেনাবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলেছে। ইতিমধ্যে গুলির শব্দ শুনা গেল আর সাথে সাথে মানুষ প্রাণ ভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগল। অগণিত মানুষের ছোটাছোটি, সূচিরও অভেদ্য ভিড়। মানুষ জড়াজড়ি করে চিড়া চ্যাপ্টা হয়ে প্রাণপনে ছুটছে। মাওঃ জালালুদ্দিন ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ছুটছেন। তিনি ছেলেকে গুলি থেকে বাচানোর জন্য নিজের আড়ালে রাখছেন আর বারবার পার্শ্ব পরিবর্তন করছেন। ডান পার্শ্ব থেকে গুলির সম্ভাবনা দেখলে বাম হাতে বাম পার্শ্বে জড়িয়ে ধরছেন, বাম দিক থেকে গুলির সম্ভাবনা থাকলে ডান পার্শ্বে জড়িয়ে রাখছেন। প্রচন্ড ভিড়ে কেউ কেউ নিচে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু উঠতে পারছে না পদদলিত হয়ে যাচ্ছে, সবাই অকুস্থল থেকে বেরুনোর জন্য ভিড়াভিড়ি করে একদিকে ছোটে যাচ্ছে। কেউ কেউ ডানে বায়ে যেদিক দিয়ে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। মানুষের হৈচৈ ডাকাডাকি, গুলির শব্দ আর আর্তচিৎকারে সেখানে নারকিয় দৃশ্যের অবতারনা হল।

হঠাৎ মাওঃ জালালুদ্দিন ‘ইয়া আল্লাহ আল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে বুক চেপে ধরলেন। ফিনকি দিয়ে বুক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। বাবার রক্ত ছেলের নাকে মুখে টুপিতে ও জামায় পড়ছে, বাবার রক্তে ছেলে রঙ্গিন হয়ে গেল। জামাল ‘আব্বা’ বলে চিৎকার দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু বাবা ছেলেকে ছাড়িয়ে জোরে ধাক্বা দিয়ে বললেন, ‘বাজান পালাও পালাও, আমার পরিবারের জন্য তুমি ছাড়া আর কোন সম্বল থাকল না’। জামাল আবার বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল কিন্তু মানুষের এক দঙ্গল ধাক্বায় সে বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার বাবা মাটিতে পড়ে গেল আর মানুষের পদতলে পিষ্ট হতে থাকল। জামাল ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করতে করতে পিছনে তার বাবার কাছে আসতে চাইছে কিন্তু মানুষের স্রোত নদীর স্রোতের মত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে যেন একদল দৈত্য তাকে পিষে পিষে শুন্যে উড়িয়ে কোন অচিনপুরে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির কোন বাহ্যিক অনুভুতি নেই, সে শুধু আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে আর হাত পা ছোড়ছে, কিন্তু বানের ঢলের ন্যায় মানুষের স্রোতে সে ভেসে যাচ্ছে।

একসময় সে নিজেকে আবিস্কার করল একদল মানুষের মধ্যে- যারা সবাই কান ধরে আছে আর সেনাবাহিনী বন্ধুক তাক করে ভেড়ার পালের মত তাদেরকে একদিকে হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষিপ্ত লাশ পড়ে আছে। কেউ মরণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কেউ হাত পা ছোড়ছে গোঙ্গাচ্ছে, কেউ রক্তের মধ্যে গড়াগড়ি যাচ্ছে, কারো কারো আহত দেহ বাহিনীর লোকেরা সাপের মত পিটাচ্ছে। কেউ খিঁচছে, কারো মরা দেহ রক্তে ডুবে গেছে, কেউ কেউ নিথর হয়ে পড়ে আছে। সর্বত্র রক্ত, দলা দলা রক্ত, চুপ চুপ রক্ত, মানুষের রক্ত। অনেক দূর যাওয়ার পর ঘাতকরা চিৎকার করল, ‘যা ভাগ শুয়ুরের বাচ্চারা, পিছন ফিরে তাকালে কুত্তার মত গুলি করে মারব। সবাই প্রাণ ভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে, আহত দেহ, মুমূর্ষু দেহ মৃত দেহ দুপায়ে পাড়িয়ে মাড়িয়ে ছুটছে, কেউ পড়ে যাচ্ছে কিন্তু উঠতে পারছে না, ধাবমান মানুষের পদতলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

অন্যদের সাথে জামালও দৌড় দিল, কোন দিকে যাবে সে জানে না, শুধু দৌড়াল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর তার ক্লান্ত দুটি পা অবশ হয়ে গেল, সে পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে দৌড়তে লাগল। একবার রাস্তার পাশে কোয়ার পাড়ের মত একটা জায়গায় হোচট খেয়ে পড়ে গেল, আর তার দেহটা গড়িয়ে নিচে পড়ল। কিন্তু রক্ষা যে এটা ছিল একটা হাউজ সে ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল। তার অবসন্ন দেহটি হাউজের কিনারে ঢেস দিয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। হঠাৎ কারো হুংকার শুনে সে উপরের দিকে ফিরে তাকাল। সেনাবাহিনীর এক লোক আজরাইলের মত তার দিকে বন্ধুক তাক করে ডাকছে, এই কুত্তার বাচ্চা উঠে আয়। আর তখনি বাহিনীর আরেক জন লোক তার বন্ধুকের নল ধরে বলল, ‘আর কত রক্ত চাও, কোরবানি তো অনেক হল আর কত। তুমি ওদিকে যাও এই পিচ্ছিটাকে আমি দেখছি’ বলে সে জামালকে ডাকল, ‘উঠে এসো তোমার ভয় নাই।

জামাল সিড়ি বেয়ে উঠে তার কাছে গেল আর লোকটা তার দিকে ক্ষনিক তাকিয়ে দেখল তারপর কেঁদে ফেলল, ‘তোর মত আমার একটা ভাই মাদরাসায় পড়ে, শুনেছি সেও এখানে এসেছে আমি তাকে খুজছি, জানি না আল্লায় কি করছে’ বলে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠল। তারপর জামালকে বলল ‘তুই পেছন থেকে আমাকে ধরে রাখ, আমার সাথে লেগে থাক যাতে কেউ দেখতে না পারে, তোকে এই কসাইখানা থেকে বাইরে দিয়ে আসি। জামাল পেছন থেকে বাহিনীর লোকটাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল, চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ, রক্ত আর রক্ত, পোটিনের মত রক্ত, আলেম নামক সস্থা পশুর রক্ত, কোরবানির রক্ত, মানুষের মরণ গোঙ্গানি, আর্তনাদ, অন্তিম কাতরতা। অনেক্ষণ হাটার পর লোকটা একটা চিপাগলি দেখিয়ে বলল, ‘এদিক দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যা এদিকটা মোটামোটি নিরাপদ। জামাল উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল কিন্তু তার দেহে একফোটা শক্তি নাই, কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে রাস্তার পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এবং বেহুশ হয়ে গেল।

আকাশে বাতাসে তখনো গুলির শব্দ, গাড়ির শব্দ, মানুষের আর্ত চিৎকার, মরণ গোঙ্গানি। কিছুক্ষণ পর জামালের চেতনা ফিরল, সে স্মৃতি ভ্রষ্টের ন্যায় কতক্ষণ জড়বৎ পড়ে থাকল। তার মনে হচ্ছে যেন কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেও ধ্বংস হতে যাচ্ছে। হঠাৎ তার বাবার কথা মনে হল, বুকটা ধক করে উঠল। সে লাফিয়ে উঠে দ্রুত পায়ে পিছন দিকে ছুটল, বধ্য ভুমিতে গিয়ে তার বাবার সন্ধান করবে। কিছুক্ষণ হাটার পর পৌছল কারবালা প্রান্তরে, একটু আড়াল থেকে সে সামনে দৃষ্টি বুলাল আর সাথে সাথে এই অনভিক্ষ বালকটির ব্রক্ষরন্দ্র কেঁপে উঠল। বিশাল স্ট্রিটের সর্বত্র লাশ, আহত মানুষ আর রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মৃতদেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে, আহত মানুষ কাতরাচ্ছে, গোঙ্গাচ্ছে, পানির মত রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। সে স্ট্রিটের কিনার ধরে বাহিনীর লোকদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে তার বাবার লাশ খোঁজে খোঁজে অগ্রসর হচ্ছে।

সর্বত্র লাশ, রক্ত আর আহত মানুষের গোঙানি। মানুষের উপর মানুষের পৈশাচিকতার বীভৎস দৃশ্য দেখে দেখে সে এগিয়ে যাচ্ছে। একজন প্যান্ট শার্ট পরা একটা আহত যুবককে কাধে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত মুখে গুলি লেগেছে, নাক মুখ চোখ ফুলে একাকার হয়ে গেছে, চোখ বন্ধ। কয়েকটা লাশ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে আছে, নিচ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। আরো সামনে পাঞ্জাবি পাজামা পরা অনেকগুলি লোক পড়ে আছে, সবাই নিথর হয়ে গেছে তবে দুয়েক জন জবাই করা পশুর মত হাত পা ছুড়ছে কাতরাচ্ছে গোঙ্গাচ্ছে। একটা ছেলে কাতরাচ্ছে আর তার মাকে ডাকছে। প্যান্ট শার্ট পরা মুখে দাড়ি একটা লোক চিত হয়ে পড়ে উর্ধ্বশ্বাস টানছে, নাক মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। একটা লোক মুমূর্ষু কণ্ঠে বাবাকে ডাকছে। সাদা গেঞ্জি ও প্যান্ট পরনে একটা লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার পাশ দিয়ে বাহিনীর লোকেরা যাচ্ছে আর প্রচণ্ড জোরে একটা করে লাঠির বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির চোটে লোকটার নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। তার দেহটা খিঁচছে, ভীষণভাবে কাঁপছে। রক্ত বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে তবুও তাকে পিটিয়েই যাচ্ছে, হায়রে মানুষের নিষ্ঠুরতা পিশাচের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানায়। মুমূর্ষু ও আহতরাও তাদের লাঠি পেটা থেকে রেহাই পায় না।

একটা সুদর্শন মাদরাসার ছাত্র চিৎ হয়ে পড়ে আছে, মনে হয় যেন ঘুমিয়ে আছে, পাশেই কোরবানির পশুর মত রক্ত, বাহিনীর ঘাতক তার পাশেই দাঁড়ানো। আরো সামনে কিছু আসবাব পত্র ব্যাগ কাপড় চোপড়, জুতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আর তার উপর কয়েকটা লাশ নিথর হয়ে পড়ে আছে, মনে হয় যেন তারা ঘুমিয়ে আছে। আরো সামনে কয়েকটা লাশ পড়ে আছে, কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আরো সামনে একজন আলেম একটা দোকানের শাটারে ধেস দিয়ে পড়ে আছে দেখে মনে হয় বড় মাপের আলেম হবে। তার মাথা ও নাক মুখ রক্তে জবজবা হয়ে আছে। একজন আলেম মুখে পাকা দাড়ি চিৎ হয়ে পড়ে খিঁচছে, ঘন ঘন নিশ্বাসের তালে তালে তার মুখ হা করছে ও বন্ধ হচ্ছে। আরো সামনে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা অনেকগুলি লাশ জড়াজড়ি হয়ে পড়ে আছে। একটা দোকানের সামনে পড়ে থাকা সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা একটা ছাত্রকে একটা পুলিশ সর্বশক্তি দিয়ে পিটাচ্ছে, ছাত্রটার মাথা লাল হয়ে গেছে।

অনেকগুলি লাশ পাশাপাশি পড়ে আছে, একজন আলেম কিছুক্ষণ পরপর মাথা উচু করে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে কিন্তু উঠতে পারছে না। আরো সামনে একটা মাদরাসা ছাত্র একটা বাহিনীর লোকের পা ধরে কাকুতি মনতি করছে আর সে দেদারছে পিটিয়ে যাচ্ছে। পাঞ্জাবি পরা দাড়ি ছাড়া একটা লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তার নাক মুখের জায়গায় রক্ত পুটিনের মত জমাট বেধে গেছে, নিশ্বাস নিতে পারছে না, তার দেহটা খিঁচছে এবং ভীষণভাবে নড়ছে। কয়েকটা পুলিশ একটা আলেমকে ধরে মেরে রাস্তার উপর ছোরে মারল, তার গলায় রুমাল পেছানো, সে অনেক আগেই মরে গেছে। এরপরেও পুলিশ বীর বাহাদুরেরা মরা লাশটাকে পাঁচ ছয়জনে বেধরক পিটিয়ে যাচ্ছে। একটা আলেমকে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়া হল, সে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে লাগল।

একটা আলেম মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে। মুখ থেকে রক্ত বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। দোকানের সামনে পড়ে থাকা একটা আলেমের পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে লাশটায় লাথি মেরে চলে গেল একটা বাহিনীর লোক। কয়েকটা লাশ কাপড় দিয়ে ঢাকা। কয়েকটা বালকের লাশ পড়ে আছে। একটা সংকির্ণ জায়গায় আসবাব পত্র ও কতগুলি লাশ বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে আছে। একটা ছাত্র মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আর তার মাথার নিচ দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। এভাবে দেখতে দেখতে জামাল এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার বাবাকে পাচ্ছে না। আরো সামনে স্ট্রিটের সর্বত্র আসবাব পত্র, বাশের লাঠি পানির বোতল, পলিথিন, জুতা, ব্যাগ, কাপড় চোপড় ইত্যাদি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে আছে, আর মানুষের লাশ কোথাও জড়াজড়ি করে, কোথাও স্তূপীকৃত, কোথাও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে আছে। কোরবানির মাঠের ন্যায় সর্বত্র রক্ত বেয়ে বেয়ে যাচ্ছে।

এক জায়গায় অনেকগুলি লাশ সারিবদ্ধ করে রাখা। আরো সামনে অসংখ্য লাশ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এর কিছুটা সামনেই আরো অনেক লাশ পলিথিনে ঢাকা। এক জায়গায় চারটে লাশ পলিথিনে মোড়ান। সরিয়ে নেয়ার জন্য সম্ভবত এসব লাশ একত্র করে রাখা হয়েছে। কারবালার এই বীভৎস দৃশ্য দেখে জামালের মস্তিস্ক অকেজো হয়ে গেছে, কিছুই ভাবতে পারছে না। বুঝতে পারছে না সে কি কিয়ামতের ময়দানে আছে নাকি কারবালার প্রান্তরে, নাকি অন্য কোন রণক্ষেত্রে। তার অবসন্ন দেহটা আর চলে না, এক জায়গায় দেয়ালে ঢেস দিয়ে অবচেতন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আর তখনি দেখতে পেল বাহিনীর লোকগুলি দল বেধে কারবালা ময়দান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল অপারেশন শেষ, আলেকজান্ডারের বংশধর এ নির্লজ্ব মহাবীরেরা নিঃসহায় নিরাপরাধ নিরস্ত্র আলেম সমাজের উপর বীরত্ব যাহির করে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় বিজয় গর্বে গর্বিত হয়ে হেলে দুলে শির উন্নত করে অকুস্থল ত্যাগ করছে। কিছুক্ষণ পর অসংখ্য গাড়ীর আলো তার চোখ ধাধিয়ে দিল। ভয় পাওয়ার অনুভূতি তার হারিয়ে গেছে, সে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল, অসংখ্য গাড়ি আসছে, ট্রাক, পিকাপ, ভ্যান, ময়লার গাড়ি, এ গুলোতে লাশ ভরে ভরে নিয়ে যাচ্ছে। কোন গাড়ীতে বাহিনীর লোকেরা লাশ তুলছে, কোন গাড়ীতে গাড়ি ও বাহিনীর লোকেরা যৌথভাবে লাশ তুলছে। এর কিছুক্ষণ পর এল দমকল বাহিনি, তারা কোরবানির রক্ত ধুয়ে মুছে স্ট্রিট পরিস্কার করে দিয়ে গেল। ( বিভিন্ন ভিডিও এবং স্থির চিত্র দেখে বিবরণ গুলি দেয়া হয়েছে)।

অভিশপ্ত শাপলা পরিণত হল পুরাকাহিনীতে। শাপলা ইতিহাস হয়ে গেল। শাপলার উপত্যাকা ইতিহাসের উপত্যাকায় ঠাই করে নিল। নিস্পাপ মানুষের রক্তে শাপলার রঙ সবুজ থেকে লোহিত বর্ণে রুপান্তরিত হয়ে গেল। শাপলা হয়ে গেল কারবালার সমার্থক। দুনিয়ার ইতিহাসে যুদ্ধ বিগ্রহ ও গণহত্যা অনেক সংগঠিত হয়েছে। ক্ষমতা ও রাজ্য জয়ের জন্য যুদ্ধ হয়েছে, গণহত্যা হয়েছে। ধর্মের জন্য যুদ্ধ হয়েছে, একে অন্যেকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। এমনকি ধর্মগুরুরা স্বধর্মের অনুসারিদের উপর চালিয়েছে অত্যাচার, গণহত্যা। ইউরোপে গীর্জার পোরুহিতরা ইনকুইজিশন কোর্ট গঠন করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল, আগুনে পোড়িয়ে মেরেছিল। কিন্তু নিজ ধর্মের ধর্মগুরুদের বিনা অন্যায়ে অত্যাচার করা হয়েছে, গণহত্যা করা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। কিন্তু বাই অব বেঙ্গলের উপকুলে সেই দৃষ্টান্তই স্থাপিত হল।

শাপলার উপত্যাকায় নিরীহ, নিস্পাপ, নিরাপরাধ, অসহায়, নিঃস্ব, দরিদ্র, নিস্পাপ মাসুম আলেম সমাজকে কুরবানি দেয়া হল। ধর্মগুরুদের রক্তে তাদেরই শিষ্য অনুসারিদের হাত রঙ্গিন হল, নিস্পাপ আলেমের রক্তে শাপলা প্লাবিত হল, দাগদার হয়ে গেল মুজিব জিয়ার সাধের মানচিত্র। এসবই হল ফিরকাবাজির পরিনতি। আলেম রুপি আযাযিলরা একক উম্মাহকে ভেঙ্গে হাজারটা ভাগে বিভক্ত করে খোদার উপর যে খোদকারি করেছে তারই পরিনাম ফল ভোগ করল তারা, এভাবেই তাদের উপর নেমে এল খোদার গজব। ফিরকা নামক যে বিষ বৃক্ষটি তারা রুপন করেছিল- যুগে যুগে এভাবেই তারা এর বিষফল ভক্ষন করে চলল। দুনিয়ার মানুষ হয়ত কারবালার নৃশংসতা দেখেনি কিন্তু এক বিংশ শতাব্দিতে শাপলার উপত্যাকায় সেই নারকীয় দৃশ্য তারা অবলোকন করল।

সতের বছরের ছেলে জামাল নরকের এই দৃশ্য দেখে কাস্ট পুত্তলিকাবৎ স্থবির হয়ে গেছে। সে যা দেখেছে তা বিশ্বাস করতে পারছে না, মানুষ মানুষের উপর এমন নৃশংস যুলুম করতে পারে এটা তার চিন্তা ও বোধ বিশ্বাসের বাইরে। সে দেয়ালে ঢেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে ‘কারবালা আর কুরুক্ষেত্র কি এর চেয়েও বীভৎস ছিল? মানুষ স্বজাতি মানুষের উপর কি করে এত যুলুম করতে পারে। সে আবার সচেতন হল, তার বাবার লাশ খুজতে রাস্তায় নামল। কিন্তু শাপলার অভিশপ্ত চত্বর তো খালি। একেবারে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দেয়া হয়েছে। দুয়েকটা কুকুর ছাড়া সেখান আর কোন জীবিত বা মৃত প্রাণীর অস্তিত্ব নাই।

ফযরের আযান দিচ্ছে। জামালের ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা টলছে। সে আযানের শব্দ লক্ষ করে টলতে টলতে মসজিদের দিকে চলল। মসজিদে এখনো মুসুল্লি আসেনি, সে অজূখানায় গিয়ে বসল। এই প্রথম সে নিজের দিকে তাকাল, নাকে মুখে শরীরে ও জামায় তার বাবার রক্ত লেগে আছে। সে চিৎকার করে কাঁদতে চাইল। কিন্তু তার মধ্যে কান্নার শক্তি নেই শুধু মুখটা বিকট হা করে ওয়া ওয়া শব্দে কতক্ষণ আর্তধ্বনি বের হল। হায়রে বদনসিব সন্তান- যার দেহ ও কাপড় চোপড়ে বাবার রক্ত লেগে আছে। সে জামা খুলে বাবার রক্ত ধৌত করল, গায়ে লেগে থাকা রক্ত ধুইল তারপর অজু করে মসজিদে চলে গেল। নামাযের পর সে উঠে বাইরে যেতে চাইল কিন্তু তার মাথা ঘুরছে, টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। কোন রকমে বারান্দায় এসে শুয়ে পড়ল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। যে বালক বাবার সাথে এসেছিল খোদার দ্বীন রক্ষা করতে, এখন দ্বীনের কি হল জানা নেই কিন্তু তার ও তার পরিবারের একমাত্র নোঙ্গরটি বিষাদ সিন্দুতে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।

দশটার দিকে জামালের ঘুম ভাঙ্গল, তার বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করছে, মাথায় যেন হিমালয় চেপে আছে, শরীরটা অসম্ভব ক্লান্ত। হঠাৎ বাবার কথা স্বরণ হতেই সে লাফিয়ে উঠল। তারপর বাবার সন্ধানে অজানা অচেনা ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। রাতের কারবালার পর কনক্রিটের জনপদ আবার সজিব হয়ে উঠেছে। এত বড় ট্রাজেডি ঘটে গেল তাতে মানুষের কোন পরোয়া নেই, সবাই নিজ নিজ কর্তব্যে ছুটছে। সর্বস্ব খোয়ানো এক বালক কুকুরের মত ঘুরছে, তার বাবাকে খুজছে কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। আপন বৃত্তে আবর্তিত মানুষ একবার তাকে জিজ্ঞেস করে না, ‘বাছা কি তোমার দুঃখ কাকে খুজছ। জামাল উদভ্রান্তের মত ঘুরতে থাকে, আলেম ধরনের কাউকে দেখলেই সে গভির ভাবে তাকিয়ে দেখে কিন্তু প্রতিবারই নিরাশ হয়। রাস্তার ধারে ড্রেনে তার বাবার লাশ খোঁজে কিন্তু নিরাশ হয়, সে জানে না কোথায় যাবে, কি করবে, কোথায় গেলে তার বাবাকে পাবে, শুধু অসহায় হয়ে পাগলের মত ঘুরতে থাকে।

এক সময় সে ক্লান্ত হয়ে গেল, ক্ষুধায় তার শরীর অচল হয়ে গেছে। একটা হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, কিছু খাওয়ার জন্য তার প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার কাছে তো টাকা নাই। ভাবছে একটা কিছু চেয়ে খাবে কিনা কিন্তু এটা তার কাছে ভিক্ষা মনে হল। অন্তহীন কষ্ট নিয়ে সে ধোকে ধোকে হাঁটতে লাগল। পা দুটি আর চলে না, অগত্যা একটা দোকানের সামনে রাখা চেয়ারে বসে বসে ঝিমুতে লাগল।

জহুরের আযান দিচ্ছে, শব্দ ঠাহর করে করে সে মসজিদে গেল। নামায পড়ে ঠায় বসে রইল, গায়ে দাড়ানোর মত শক্তিও নাই। অনেক্ষণ পর উঠে ইমাম সাবের হুজরায় গেল, পাগড়ি ওয়ালা একজনকে দেখে বুঝল ইনিই ইমাম সাব, তার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জবাই করা মুরগির মত তড়ফাতে লাগল। কোন কথা বলতে পারল না শুধুই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করতে লাগল। কি ঘটেছে ইমাম সাবের বুঝতে বাকি রইল না। তিনি দ্রুত ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্তনা দিতে লাগলন, ‘শান্ত হও পুত্র, শান্ত হও। হা শান্ত হল, সে বেহুশ হয়ে গেল। ইমাম সাব মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের নিয়ে পানি দিয়ে সেবা করে ছেলেটার হুস ফিরিয়ে আনলেন। তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর ভাত আনিয়ে তাকে নিজের সাথে বসিয়ে ভাল করে খাওয়ালেন, কিন্তু কোন কথা বললেন না। খাওয়ার পর আবার শুইয়ে দিয়ে ‘তোমার একটু ঘুমের দরকার বাবা, এখন ঘুমাও, উঠলে তোমার সাথে কথা বলব’ বলে নিজেই জামালের মাথা ও শরীর টিপে টিপে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। একটানা মাগরিব পর্যন্ত সে ঘুমাল। নামাযের পর ইমাম সাব তাকে নিয়ে শান্ত হয়ে বসলেন এবং নাম ঠিকানাও পরিচয় জানতে চাইলেন। জামাল পরিচয় দিয়ে বলল, আমার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। আমার আব্বা ময়মনসিংহের বড় মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন আর ইমামতি করতেন। আমরা শাপলা চত্বরে এসেছিলাম। হঠাৎ আব্বার বুকে গুলি লাগল আর— বলে সে আবার আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ইমাম সাব আবার তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে শান্ত করলেন।

এশার পর খাওয়া দাওয়া করে ইমাম সাব তাকে নিয়ে কাছাকাছি একটা মাদরাসায় রওয়ানা হলেন। মাদরাসায় ছাত্র শিক্ষক তেমন নেই। সবাই শাপলার ঘটনার ভয়ে নিজ নিজ বাড়িতে বা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। অনেক খোজাখূজি করে হাফেজ খলিল নামে ময়মনসিংহের একজন শিক্ষকের সন্ধান পাওয়া গেল। হাফেয খলিল বলল ‘ময়মনসিংহের আরো দুই তিন জন ছাত্র আছে। ইমাম সাব তাদের সবাইকে ডাকিয়ে এনে জামালের আড়ালে বললেন, ‘ছেলেটাকে যত্ন করে আপনাদের সাথে রাখবেন, এর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে এবং লাশ সম্ভবত গুম করে ফেলা হয়েছে। কাল সকালে আপনাদের একজন সাথে গিয়ে ওকে তার বাড়িতে দিয়ে আসবেন’। তারপর তিনি পাচশত টাকার একটা নোট বের করে বললেন, ‘ভাড়ার টাকাটা আমি দিয়ে গেলাম। হাফেয খলিল বলল, ‘লাগবে না, আমাদের কাছে টাকা আছে। তারপর ইমাম সাব টাকাটা জামালের পকেটে গুজে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ‘চিন্তা করো না বাপ, মজলুমের সাথে আল্লাহ আছেন। আল্লাহ তোমার ও তোমার পরিবারের উপর রহম করবেন’ আরো কিছু উপদেশ দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। জামাল কাঁদতে লাগল।

হাফেয খলিল তাকে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিল। পরদিন তারা জামালকে বাড়িতে পাঠাতে চাইল কিন্তু সে তার বাবাকে ছাড়া যাবে না। অগত্যা হাফেয খলিল ও আরেকটা ছাত্র জামালকে নিয়ে তার বাবার খোঁজে বের হল। তারা শহরময় ঘুরল, বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে খোজ খবর নিল। গোয়েন্দা অফিস ও কয়েকটা থানায় গিয়ে তল্লাসি নিল কিন্তু থানা ওয়ালারা ঠাট্টা মশকরা করল, ‘জালালুদ্দিন নামের কোন মোল্লা তো দুরের কথা এ নামের কোন কুকুরও তারা আটক করেনি। সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে রাত্রে তারা মাদরাসায় ফিরল।

পরদিনও জামালের একই কথা বাবাকে ছাড়া সে বাড়িতে যেতে পারবে না। সে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। অগত্যা হাফেয খলিল দুই তিনটা ছাত্রসহ জামালকে নিয়ে বের হল, দুপুর পর্যন্ত ঘুরল, বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান করে নিরাশ হল। তাদের বুঝতে বাকি রইল না লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। তারা জামালকে শান্তনা দিতে লাগল আর বুঝাতে লাগল ‘তুমিই এখন তোমার পরিবারের একমাত্র সম্বল। তোমার তো আর ভাই নাই, এখন তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো তোমার পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এভাবে ঘোরাফিরা করে লাভ নেই, বাড়িতে যাও পরিবারের দেখাশুনা কর গিয়ে। আল্লাহ তোমার বাবাকে বাঁচিয়ে রাখলে তিনিও বাড়িতে পৌছে যাবেন। এভাবে বুঝাতে বুঝাতে তারা জামালকে নিয়ে মহাখালী বাস স্টেশনে গেল। জামালপুরের বাসগুলি মুক্তাগাছা হয়ে যায়, জামালকে একটা বাসে তুলে দিয়ে হাফেজ খলিল বলল, ‘তুমি একা যেতে পারবে নাকি আমরা কেউ সাথে যাব? জামাল বলল, ‘না, আমি একাই যেতে পারব। তারপর হাফেয খলিল কনট্রাক্টরকে ভাড়া দিয়ে বলল, ‘ছেলেটাকে মুক্তাগাছা নামিয়ে দিবেন।

জামাল বাসে চড়ে বসল আর বাস চলল আপন গতিতে। জানালার ধারে তার বেদনা বিধুর পাণ্ডুর মুখ খানি বাইরে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, ‘এই যে সুবিস্তৃত পৃথিবী, নিঃসীম আকাশ, দিগন্ত জোড়া মাঠ, বন বনানি ঘেরা সবুজের সমারোহ, মাঠ ঘাট খাল বিল নদী সাগর পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য আগের মতই আছে। কিন্তু আমাদের পৃথিবী বিরান হয়ে গেছে, আমাদের দুনিয়া এখন শূন্য ফাকা মরুময়। কাঠ ফাটা রুদ্দুরে এই সুন্দর প্রকৃতি যেভাবে পোড়ছে, নিষ্ঠুর নিয়তি আমাদের ভাগ্যের দুনিয়াটাও এভাবে পোড়িয়ে দিয়েছে’। তার মনে হল সেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যাহত অভিশপ্ত জীব। আজ থেকে তার ও তার পরিবারের সকল চাওয়া পাওয়া ও আশা আকাঙ্ক্ষা শাপলার চত্বরে দাফন হয়ে গেল চির দিনের তরে। এখন থেকে সমাজ তাদেরকে নতুন নামে ডাকবে, ইয়াতিম নামে তাদের পরিচয় হবে। তারা ফিরকাবাজির বিষ ও রাষ্ট্র শক্তির পৈশাচিকতার শিকার।

বিষয়: রাজনীতি

৮৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File