কবর-৮২ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:১২:২২ সকাল

হাসান হঠাৎ একটা বড় গর্তে কাত হয়ে পড়ে গেল। উরুমুল পর্যন্ত কাদায় ঢুকে গেছে, মেয়েটা কাধ থেকে ছিটকে কাছেই পড়ে আছে। সে বাম হাতে মেয়েকে টেনে এনে বুকের উপর রাখল। বাচ্চাটা গরু ছাগলের মরা বাচ্চার মত নেতিয়ে কোকড়ে গেছে, একটা মাংসের দলার মত জড়সড় হয়ে পড়ে আছে। বাবার এই অনুভূতি নেই যে, মেয়েটা জীবিত নাকি মৃত। সে মেয়েকে বুকে নিয়ে কিছুটা কাত হয়ে শুয়ে আছে, বিশ্রাম করছে। কিছুক্ষণ পর তার শরীরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এল। সে লক্ষ করল রাস্তার উপর বাড়ি-ঘর। ঘন ঘন ছোট ছোট ঘর, একটার সাথে আরেকটা লাগানো। সে অবাক হয়ে ভাবে এটা কোন জায়গা, তার পরিচিত এমন কোন জায়গা তো নেই। কিন্তু জন্মভূমির ছোঁয়ায় তার চেতনা তীব্র হয়ে উঠল।

সে রাস্তার দু’পাশে ভাল করে তাকাল আর সাথে সাথে খাচা থেকে মুক্ত পাখির মত তার মনটা দিগন্তে পাখনা মেলে দিল। সে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে পাগলের মত চুমুতে লাগল। কাদায় লেপটানো মেয়ের মুখ মাথা ও শরীরে চুমুচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘আব্বা আব্বা আমরা পৌছে গেছি আব্বা, এটা বালিয়া বাজার, এটা আমার জন্মভূমি’। সে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে, ‘ইনহাস্ত ওয়াতনাম, ইনহাস্ত ওয়াতনাম- এই তো আমার জন্মভূমি, এই তো আমার জন্মভুমি। এই মাটি আমার সোনার বাড়া, এই মাটি আমার মক্বা-মদিনার মাটি, এই মাটি আমার জান্নাতুল ফেরদাউসের মাটি, এই মাটি আমার পয়দায়েশের মাটি, এই মাটি আমার চোখের সুরমা। এই মাটি আমার চৌদ্দ পুরুষের ভিটে। এই ভু-তে আমার দেহ, আমার মা-বাপ, দাদা-দাদী, নানা-নানী চৌদ্দ পুরুষের দেহ প্রথম মিষ্ট হয়েছিল। এই মাটিতে শুয়ে আছে আমার পূর্ব পুরুষ। এই মাটি আমার ও আমার পূর্ব পুরুষের দেহের সুগন্ধি ছড়ায়, আমাকে মাতোয়ারা করে তুলে। কুদরত যদি এই মাটিকে ভাষা দিত তাহলে এর প্রতিটি ধুলিকণা বলে দিত আমি কে, তার সাথে কী আমার সম্পর্ক। এই মাটির প্রতিটা পরতে পরতে মিশে আছে আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের কত স্মৃতি কত ইতিহাস। এই মাটির প্রতিটা ধুলি কণায় মিশে আছে আমার কত হাসি কান্না, কত আবেগ উচ্ছ্বাস। এই মাটি আমার মা, এই মাটির অন্ন জল খেয়ে, বাতাস খেয়ে আমি জীবন ধারণ করেছি, বড় হয়েছি, পৃথিবীর পথে হেঁটেছি, সন্তান জন্ম দিয়েছি।

মা, আমার মা, আমি এসেছি মা, আমায় মার্জনা কর মা। সে পাগলের মত মাটির উপর হাত বুলাতে থাকে, কাদা নিয়ে নিজের শরীরে ও বাচ্চার শরীরে মাখতে থাকে, ‘মার্জনা কর মা, মার্জনা কর। তোমার শরীর ছোয়ে শপথ করছি মা আর কোনদিন তোমাকে ছেড়ে চলে যাব না, কোনদিন যাব না। শুধু তোমার বুকে পড়ে পড়ে হাসব কাঁদব নাচব গাইব। তোমাকে ছেড়ে গিয়ে উচিত শিক্ষা পেয়েছি মা। ঐ অভিশপ্ত পৃথিবী আমাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। কোন শিশু খেলার সময় যেমন অন্যদের সাথে তাল বাজিয়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বাবা এলে তার কোলে উঠে সাথীদের প্রতি ভেংচি কাটে, দাঁত বিজলায়, বুড়ো আঙ্গুল দেখায়, হাসানও সেভাবে পৃথিবীকে ভেংচি কাটে, ‘অভিশপ্ত পৃথিবী তুই আমাকে অনেক ঠকিয়েছিস, অনেক কষ্ট দিয়েছিস, অনেক অশ্রু ঝরিয়েছিস কিন্তু আর পারবি না। তোকে আর আমার দরকার নাই, তোকে আমি ঘৃণা করি, তুই দূর হ আমার জীবন থেকে। তোকে আর আমি চাই না। এখন আমি আমার মায়ের কোলে, এই মাটি আমার মা। এই মাটি মানুষ আমার।

এখানে আছে আমার মা, আমার জন্মদাত্রী, ত্রিভুবনে আমার একমাত্র বন্ধন- যে বন্ধন কোনদিন ছিড়ে যায় না। আমি আর কোথাও যাব না, আমার মায়ের কোলে হেসে খেলে জীবন কাটাব, আমার মায়ের কোল আমার জান্নাতুল ফেরদাউস। প্রতিদিন আমার মা ও মেয়ের সাথে একত্রে খেতে বসব। একটানে আধা কেজি চালের ভাত তোলার পর যখন আমি হাত ধুতে যাব তখনি মা চেঁচিয়ে উঠবেন, ‘আরে রাখ রাখ, তোর আসল তরকারিটা তো রয়েই গেছে। মুরগীর আদারের (খাদ্য) মত এ চারটা ভাত খাস এজন্যই তো তুই এমন শুকনা শক্তিছাড়া’। যদিও আমি গায়ে গতরে হাতির বাচ্চার মত গুতগুতে আর সিংহের মত তেজি শক্তিমান থাকব তবুও আমার মায়ের চোখে আমি স্বাস্থ্যহীন দুর্বল। তারপর সেই মজার তরকারিটা সবার শেষে দিবেন। তখন মজা খাওয়ার জন্য বাধ্য হয়েই আরো কিছু ভাত খেতে হবে। এটা হল ভাত বেশি খাওয়ানোর জন্য তার সারা জীবনের কৌশল। খাওয়ার শেষে আসল তরকারিটা দিবেন যাতে বাধ্য হয়ে কিছু বেশি খেতে হয়। আবার দাদা দাদির প্রকৃতি অনুসারে আমার মেয়েকে ছাড়া তো আমার মা চোখেই দেখবেন না। সারাদিন সাথে সাথে কোলে কাখে রাখবেন আর সব সময় শুধু খাওয়ানোর ধান্ধায় থাকবেন। আমার মেয়ে খেতে না চাইলে বলবেন, ‘দাদু এটা খেলে একটা বস্তু দিমু। আমার মেয়ে জিজ্ঞেস করবে, ‘আচ্ছা দাদু বস্তু জিনিসটা কি? তখন আমার মা উত্তর দিবেন, ‘বস্তু হল খুব মুল্যবান, খুব সুন্দর, খুব মজার একটা জিনিস। বস্তু পাওয়ার লোভে আমার মেয়ে খাওয়ার পর যখন তা চাইবে তখন আমার মা বলবেন, ‘বস্তুটা তো এখন তার দাদু বাড়ি বেড়াতে গেছে, আরেকবার খেলে আসবে, তখন দিমু। তারপর শুধু খাওয়ার পর খাওয়াই চলতে থাকবে কিন্তু বস্তুটা আর কোনদিন দাদু বাড়ি থেকে আসবে না। এটা অদৃশ্যে থেকে শুধু খাওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকবে। তাছাড়া প্রতিদিন সকাল বিকাল পুরা এক জগ দুধ দিয়ে বলবেন, ‘নে, মেয়েকে নিয়ে সবটা খা, মেয়েকে একটু বেশি খাওয়াস। বেশি করে দুধ না খেলে বাচ্চাদের মাথা (মেধা) হয় না। এভাবে আমার মা আমাদেরকে খাইয়ে খাইয়ে পেটটা সব সময় ফুটবল বানিয়ে রাখবেন। আর খাব না কেন খাবই তো, আমাদের কি কম আছে নাকি। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা দুধ- এসব কি শুধু দেখার জন্য, খাওয়ার জন্যই তো। রাক্ষসের মত খাব, পেটুক ভায়ার মত খাব আর তিনজন একসাথে বসে ছুটিয়ে আড্ডা দিব, গপ্প করব। মাকে ছেড়ে থাকার শিক্ষা তো পেলাম কিন্তু আর না, আর কোথাও যাব না।

এই দেশ আমার, এই দেশের মানুষ আমার, আমি ওদের। আমরা একসাথে থাকি, খাই, গাই, ঝগড়া করি মারামারি করি আবার গলাগলি করে পথচলি। ঐ যে দেখ বুড়াটা বুঝা নিয়ে আসছে, কাঠ পুড়া কয়লার মত চেহারা, খাটুনিতে কুজো হয়ে গেছে সে আমার মামা চাচা। ঐ যে দেখ তাগড়া ছেলেটা রিকশা বা ভেন গাড়ী নিয়ে আসছে, ঘামে নেয়ে গেছে, গা থেকে বুটকা গন্ধ বেরুচ্ছে- সে আমার বন্ধু। আমি গিয়ে ধমক দিলে, ‘এই হারামি এত দেরি করলি কেন, খেলা দেখতে যাবি না’? সে হেসে বলবে, ‘আরে কইস না, রাস্তা খুব খারাপ, হেল্লাগ্যাই দেরি অইলো’। তারপর দু’জনে গলাগলি করে বিড়ি ফুকতে ফুকতে খেলা দেখতে যাই আর প্রাণ খুলে হাসি। ঐ চাঁদের হাসিতে কলংক থাকতে পারে কিন্তু আমাদের হাসিতে কোন কলংক নাই।

আমরা সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে সোনার ফসল ফলাই, দেশের মানুষের অন্ন যোগাই কিন্তু আমরা গর্ব করি না। আমরা ঘুম থেকে উঠে কিলাকিলি করি আর বিকালে গলাগলি করে বাজারে যাই, খেলা দেখতে যাই, ওয়াজ শুনতে যাই। আমাদের রাগ আছে কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষ নাই, অহংকার নাই। ঐ যে দেখ মাস্টার বা প্রফেসর বা ডাক্তার বা পদস্থ চাকরিজীবী আসছে, সে আমার শত্রু। একদিন হয়ত তার সাথে ঝগড়া করেছিলাম বা মারামারি করেছিলাম। এরপর থেকে আর দু’জনে কথা বলিনি, সে আমার ছায়া মাড়ায় না, আমিও তার ছায়া মাড়াই না। দেখা হলে দু’জন দু’দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাই, কিন্তু এখন যদি সে আমাকে এই অবস্থায় দেখে অমনি দৌড়ে এসে আমার মাথাটা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে, সন্তান হারা মায়ের মত বিলাপ শুরু করবে। ডাক চিৎকার করে দশ গায়ের লোক জড়ো করে বলবে, ‘দেখেন আপনারা দেখেন, আমার ভাইটার কী হল, এভাবে রাস্তায় পড়ে আছে, ধরেন, আমার ভাইটাকে বাঁচান’। এরপর চড়া গলায় বলবে, কিরে আইজ্যা (আজিমুদ্দি) এখনো দাঁড়িয়ে কী দেখছিস, তাড়াতাড়ি রিকশাটা নিয়ে আয়, ওকে এখনি হাসপাতালে নিতে হবে।

তারপর গায়ের লোকেরা একে অন্যের কাছ থেকে সংবাদ নিবে, অমুকের শরীরের অবস্থা এখন কেমন? যদি টাকার সমস্যা দেখা দেয় তাহলে গ্রামবাসীরা সবাই সহযোগিতা করবে। তাতেও সংকুলান না হলে বাজারে যাবে, দোকানদারদের কাছে গিয়ে বলবে, ‘আমাদের অমুকের তো খুব অসুখ, হাসপাতালে ভর্তি, টাকার সমস্যা, যা পারেন কিছু সহযোগিতা করেন’। তখন যে দোকানদার সারাদিন বিকিকিনি করে দশ টাকা লাভ করেছে সে হাসি মুখে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিবে। এই তো হল আমার দেশ, আমার দেশের মানুষ, সোনার মানুষ, কোথায় পাব এমন খাটি মাটির মানুষ, আমি ওদেরকে ভালবাসি, এদেরকে ছেড়ে আর আমি কোথাও যাব না। কেন আমি এতদিন ওদেরকে ছেড়ে বাহিরে ছিলাম, এত লাঞ্চনা ভোগ করলাম। ওদেরকে ছেড়ে যাওয়ার শাস্তি আমি পেয়ে গেছি।

না, এই মাটি এই মানুষ ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না। এই মাটি আমার মা, এই মাটির অন্ন জল বাতাস আমায় লালন পালন করেছে। এই মাটির প্রতিটা ধুলি কণা সাত রাজার ধনের চেয়েও মূল্যবান। এই মাটি সোনা ফলায়। এই মাটির মায়া আমি গায়ে মেখেছি, কাজেই পৃথিবীর রূপ আর দেখতে চাই না। আমি চাইনা পৃথিবীর কোন কসরে আবয়ায (হুয়াইট হাউজ), চাইনা কোন কসরে আহমার (ক্রেমলিন), চাইনা কোন আইফেল টাউয়ার, পেট্রোনার্স টাওয়ার, টুইন টাওয়ার। আমি শুধু চাই একটা মাঠ, বন-বনানী ঘেরা, সবুজে ঢাকা, মায়ামাখা একটা মাঠ। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে মেয়েকে বলব, ‘আব্বু আমি ক্ষেতে গেলাম তুমি পড়তে বস, তোমার দাদু ভাত রান্না করলে আমার জন্য ভাত নিয়ে যেও’। তারপর মাঠে গিয়ে হাল চষব আর হেরে গলা ছেড়ে গান ধরব, ‘বসুমতি বসুমতি কেন তুমি এতই কৃপণা, কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা। দিতে যদি হয় দে না, প্রসন্ন সহাস- কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস। বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি? শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী, আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে, তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে। (কবি গুরু)

তারপর মেয়ে ভাত নিয়ে যাবে। আমি ঝিলের জলে হাত মুখ ধুয়ে এসে আলে বসব, মেয়েকে কোলে নিয়ে তাকেও খাওয়াব আমিও খাব। খাওয়া শেষ করে মেয়েকে বলব, ‘আব্বু এখন তুমি তাড়াতাড়ি স্কুলে যাও’। তারপর খান্দানি কৃষক হিসাবে ভাল লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে হাটু কাদা ভেঙ্গে বিকালে বাজারে যাব। সেখানে কুদ্দুসের দোকানে মিষ্টি খাব, সাইনুদ্দির দোকানে চা খাব ও রাজনৈতিক আলাপ করব। তারপর জক্ষু চাচার দোকানে পান খেতে যাব কিন্তু এই লোকটা রুক্ষ স্বভাবের। পান দিবে কিন্তু তার নিজ হাতে বানানো বিশেষ মসলাটা দিবে না। চাইলে বলবে এটা দিয়ে পান খেলে পাঁচ টাকা লাগবে। তখন কৌশল করতে হবে। তার ডান পাশে টানানো জিয়ার ফটোর দিকে তাকিয়ে বলতে হবে, ‘আহ জিয়ার মত একটা মানুষই হয় না, কত সুন্দর নায়কের মত চেহারা’। তখন সে মশলাটা এগিয়ে দিয়ে বলবে, ‘নেন একটু খেয়ে দেখেন, ভাল লাগবে’। আর মাগনা পান খাওয়ার ইচ্ছা থাকলে বলতে হবে, ‘আহ, জিয়ার মত একটা নেতাই হয় না, সে না থাকলে দেশটা ধ্বংস হয়ে যেত’। তারপর পানের টাকা দিতে গেলে সে বলবে, ‘আমি এত ছোট লোক নই যে, আমার নেতার ভক্তের কাছ থেকে পানের টাকা নেব’। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে বসব কোরান শিক্ষার আসরে। আসলে এটা শুধু নামে হবে কোরান শিক্ষার আসর, কার্যত এটা হবে মক্বা, মদিনা, আল আযহার, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য বিদ্যাপীঠ। আমার দেশের দরিদ্র, অশিক্ষিত, মুর্খ কৃষক- শ্রমিকদের আমি এখানে শিক্ষা দিব। তাদের আমি কোরান হাদীস তাফসীর শিক্ষা দিব, সেই সাথে জাগতিক জ্ঞানের সকল ভান্ডার তাদের মস্তিস্কে উপোর করে ঢেলে দিব। তাদেরকে আমি বিশ্ব সভার উপযোগি রুপে গড়ে তুলব- যেন তারা জ্ঞানী গুণীদের আসরে অলংকার হিসাবে বরিত হয়।

তারপর মেয়েকে নিয়ে বিলের মাছ দিয়ে দশাসই রাতের খাওয়াটা দিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ব। ভ্যাঁপসা গরম, হয়ত বৃষ্টি নামবে, হাত পাখায় বাতাস করব। আমি ক্লান্ত হয়ে গেলে আমার মেয়েটা পাখা নিয়ে বাতাস করবে আর বাবার পিঠে মমতার হাত বুলিয়ে দিবে। রোদে পোড়ে আলুর খোসার মত হয়ত পিঠের চামড়া উঠতে থাকবে। মেয়েটা চিমটিয়ে চিমটিয়ে তুলবে আর বলবে, ‘বাবা কাল থেকে তুমি আর রোদে যেতে পারবে না’। তখন আমি হেসে বলব, ‘পাগলি মেয়ে আমার কয় কি, ভাত খেতে হবে না’। তখন হয়ত বৃষ্টি নামবে, খড়ের ছাউনি পচে চাল চালনির মত শত ফুটো হয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ার আগে ঘরে পড়ে। তখন চৌকির কোণায় গিয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকব। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিব। তারপর পিঠ চাপরে শ্লোক বলে বলে ঘুম পারাব, ‘ঘুম পাড়ানি মাসি- পিসি মোদের বাড়ি এসো, খাট নাই পালঙ্গ নাই মুনিরার চক্ষে বস---। এই তো জীবন, খাটি জীবন, প্রাকৃতিক জীবন, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন। এখানে কোন কৃত্রিমতা নাই, মুনাফেকি নাই, স্বার্থ হানাহানি নাই, যা আছে সবই খাটি। প্রকৃতির সন্তান মোরা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকব, চাই না তোমাদের কৃত্রিম জৌলুসপূর্ণ জীবন। আমরা কঠিন মাটির বুক ফেড়ে সোনার ফসল উৎপাদন করব, তোমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করব। তোমরা আমাদেরটা খেয়ে বেঁচে থাকবে, জীবন ধারন করবে, এটাই আমাদের গর্ব আর তোমাদের পরাজয়। কাজেই এই মা, মাটি, মানুষ নিয়েই আমি থাকব, তোমাদের মদিরা গ্লাসে কৃত্রিম ও রঙ্গিন জীবন আমাকে আকৃষ্ট করতে পারবে না।

হাসান মনে মনে ভাবে, সে এই গ্রাম এই দেশ ছেড়ে জীবনে আর কোথাও যাবে না। সে নিজের ও মেয়ের শরীরে কাদা মাখে আর বলে ‘বাপ, বাপ আমার, কে বলেছে তোমার মা নেই, এই যে তোমার মা, এই মাটি তোমার মা আমার মা, আমাদের সকলের মা। আমরা মায়ের কোলে থাকব, কোথাও যাব না’। তারপর সে চারদিকে তাকিয়ে জায়গাটা শনাক্ত করল, এটা ধান ময়াল। এখান থেকে পশ্চিম দিকে একটা গলি চলে গেছে। প্রতি বর্ষায় এই গলির মাথায় ভয়ঙ্কর কাদা ও গর্ত হয়। ঐ গর্তেই সে পড়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এই ধান ময়ালে সে সারা জীবন ধান বিক্রি করেছে। পাটের মৌসুমে পাট বিক্রি করেছে। পাটের ভাল দাম পেলে আনন্দ সহকারে বাজার সওদা করে বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু যখন পাটের চাহিদা শুন্যের কোটায় তখন কৃষকরা পাট নিয়ে আসত কিন্তু কেউ কিনত না। ফলে তারা রাগে গোস্বায় পাট জ্বালিয়ে দিয়ে ছাইয়ের মত কাল মুখে বাড়ি ফিরত। সেও তো কতবার পাট বিক্রি করতে না পেরে বাকিতে কিছু সওদা নিয়ে গুমরাহ মুখে বাড়িতে ফিরেছে।

এই বাজারটা তার দেহ। এর প্রতিটা অলি গলি দেহের শিরা উপশিরার ন্যায়। শরীরে রক্ত সঞ্চালনের ন্যায় সে প্রতিটা অলি গলিতে ঘুরেছে। বাজারের দক্ষিণ পাশেই মাদরাসা। সেই যে প্রথম বাবার হাত ধরে এই বাজার ও মাদরাসার অলি গলিতে হাঁটা শুরু ... হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, বাজারের গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক কান্তিময় পুরুষ, যুল ওক্বার, জ্যোতির্ময় চেহারা। আর তার হাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটছে একটি শিশু। হাসান তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠে। সে মেয়েটাকে বাম কাধের উপর ফেলে বাম হাতে চেপে ধরল। তারপর পা দু’টি টেনে টেনে অনেক চেষ্টা করে গর্তের পাশে এসে দাঁড়াল। সে পশ্চিম মুখী তাকিয়ে আছে, যেন সেই কান্তিময় পুরুষের হেঁটে যাওয়া সে চেয়ে চেয়ে দেখছে। তার বাড়ি সোজা উত্তর দিকে কিন্তু তার পা ঘুরে গেল পশিম দিকে। তার ডান হাটু একদম বিকল হয়ে গেছে, বাম পায়ের উপর ভর রেখে কোন রকম খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একশ হাত গিয়ে উত্তরে মোড় ঘোরে গেল, বিশ হাত গিয়ে আবার পশ্চিমে মোড় ঘোরে গেল, ত্রিশ হাত সামনে আরেকটা মোড়।

বালিয়া বাজারের ঈশান কোণের এই মোড় থেকে একটা ছোট্ট মেঠো পথ উত্তর দিকে চলে গেছে। এই রাস্তায় মানুষের আনাগুনা কম। মোড়ে কয়েকটা টং দোকান, মানুষ বসার জন্য বাঁশ কাঠ দিয়ে এগুলির বেঞ্চি তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার উপর আবলুস কালো অন্ধকার। হাসান অদৃশ্য বন্ধনের তীব্র আকর্ষণে অবচেতন হয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ তার পা একটা বেঞ্চিতে বাজল, আর সে বেঞ্চির উপর দিয়ে অপর পাশে মুখ থুবড়ে পড়ল। বাচ্চাটা পড়ল তার দেহের নীচে, সে পলকে মোচড় দিয়ে বাচ্চার উপর থেকে সরে গেল। আর তখনই বেঞ্চিতে বেজে থাকা পায়ে মোচড় লাগল এবং সাথে সাথে ভাঙ্গা হাটুর অবশিষ্ট জোড়াটা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিল। সে তীব্র একটা আর্তনাদ করে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকল।

হায়রে হতভাগ্য মানব সন্তান, পৃথিবীর অভিশাপ, এদের দুঃখ ও যন্ত্রনার আহ এ পৃথিবী টইটুম্বুর হয়ে গেছে। এদের দুঃখে কাঁদে আকাশ, কাঁদে বাতাস, কাঁদে পৃথিবী, কাঁদে নদী সাগর অরন্য, কাঁদে প্রকৃতি, কাঁদে জীব জগত, শুধু কাঁদে না মানুষ- পাষাণে তৈরি মানুষের মন। হায় স্রষ্টা, এদের হৃদয় কন্দর থেকে নির্গত বিষে কি তোমার খোদায়িত্ব কলুষিত হয় না, এদের বক্ষ নিঃসৃত ধোঁয়া কি তোমার বিরাটত্ব ও মহানত্বকে স্লান করে না? কেন এদের পৃথিবীতে পাঠাও।

তার মেয়েটা নিথর হয়ে পড়ে আছে। বাচ্চাটার হৃদস্পন্দন নেই, নাড়ি ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ পর তার চেতনা ফিরল, আর সাথে সাথে ছিটিয়ে উঠে মেয়েকে হাতরে কোলে নিল, কিছুক্ষণ বসে বসে বিশ্রাম করল। তারপর বাম পায়ে ও হাতে ভর করে দাড়াল, ডান পায়ে ভর দিতে চাইল, কিন্তু সাথে সাথে আর্তনাদ করে আবার মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ এভাবেই পড়ে থেকে চিন্তা করল, আর হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়, বসে বসে কোমর হেচড়ে হেচড়ে যাওয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। সে মেয়েটাকে বাম কাঁধে নিয়ে থুতনি ও মাথা দিয়ে চেপে রাখল, বাম হাতে ভর দিয়ে কোমর হেচড়ে গেল, এভাবে তিন চার হেচড়া যাওয়ার পর তার নিঃসীম দুর্বল দেহটা কাঁপতে লাগল। মাটিতে ঢলে পড়ার উপক্রম হল। সে বুঝতে পারল এভাবে যাওয়া সম্ভব নয়, হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে কোমর হেচড়ে একটা বেঞ্চির কাছে গেল কিন্তু এটা কাঠের। আরেকটার কাছে গেল, হা এটা বাঁশের। বাঁশে তারকাটা মেরে বেঞ্চিটা বানানো হয়েছে। সে বাম হাতে একটা বাঁশ ধরে অনেকক্ষণ টানল খুলতে পারল না। তারপর বেঞ্চিতে উঠে বাঁশে ধরে হেচকা টানে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে একটা বাঁশ খুলতে সক্ষম হল।

সে উঠে দাঁড়াল, বাম হাতে মেয়েকে পেছিয়ে ধরল এবং মুঠিতে বাঁশ ধরল, এই বাঁশ ডান পায়ের বিকল্প হল। তারপর ‘ইন্নাকা আলা কুল্লি শায়্যিং কাদির’ পড়তে পড়তে হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর গর্তে পড়ে গেল। একেবারে কাত হয়ে ধপাস করে পড়ল। গর্তের পানিতে বাচ্চাটা ডুবে গেল, তার শরীরও অর্ধেকটা ডুবে গেছে। ত্বরিতে টান দিয়ে মেয়েটাকে বুকে তুলে এভাবেই অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল। তারপর উঠে বসল, শরীর কাঁপছে, দেহে এক ফোটা শক্তি নাই। সে বুঝতে পারছে, সম্ভবত তার সময় শেষ। এ অবস্থায় মরলে মেয়েটার কি হবে। হতভাগ্য বাবা উর্ধ্বে দু’হাত মেলে ধরতে চাইল কিন্তু ডান হাতের ব্যথায় ককিয়ে উঠল। বাম হাত তুলে ধরল কিন্তু দুনিয়ার এই বদবখত কাঁদতেও পারল না, কাঁদার শক্তি নেই। কান্নার রসদ যোগানোর মত অশ্রু নেই, শব্দ নেই, রা নেই, কান্না নেই। আছে শুধু আর্তরব। পৃথিবীর সবচেয়ে বদনসিব এক বাবার হৃদয় কন্দর থেকে উৎসারিত হয় শব্দহীন আর্তরব। স্বর্গ মর্ত পাতাল চাপিয়ে উঠে এক অসহায় বাবার আর্তরব, সেই শব্দাতিত আর্তনাদ মহাকাশের খিলানে খিলানে প্রতিধ্বনি তুলে, ইথারে ইথারে অনন্ত কান্নার রাগিণী হয়ে বাজতে থাকে, গলা দিয়ে গরগর শব্দ বের হয়, সৃষ্ট জগত কাঁপতে থাকে, মহাবিশ্ব দুলকের মত দুলতে থাকে, কাঁদে অরণ্য নদী সাগর, কাঁদে স্থাবর জঙ্গম। চলতে থাকে শব্দহীন ভাষায় আর্তনাদ।

তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, হাঁটতে শুরু করল কিন্তু সে আর হাঁটতে পারছে না শুধু ধোকছে, ধোকছে সে পৃথিবীর পথে। দেখ দেখ জনপদবাসী, দেখ জগৎবাসী একটা কুকুর ধোকছে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট, সবচেয়ে বদনসিব একটা জীব ধোকছে, সে চলে যাচ্ছে, যাচ্ছে সে তার গন্তব্যে। সে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে সে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূগর্ভের দিকে। কুকুরটা আবার পিছলে পড়ে গেল, এভাবেই পড়ে থাকল, কিছুক্ষণ পর উঠল। হাটতে চাইল কিন্তু হাটল না শুধু ধোকল। ধোকছে, ধোকছে পৃথিবীর এক অবাঞ্চিত মানব সন্তান। বাম হাতে মেয়েকে ধরে আছে, লাঠিও ধরে আছে। লাঠিতে ভর দিয়ে সে হাঁটতে চাইছে কিন্তু পারছে না, সেন্টিমিটার ও ইঞ্চি ইঞ্চি করে জায়গা অগ্রসর হচ্ছে।

বংশগতির ধারক জিন। জিনের প্রভাবে মানুষ বাপের মত বা মায়ের মত হয়। কেউ হয় শুধু বাপের মত, কেউ হয় শুধু মায়ের মত, কেউ হয় উভয়ের মত। হাসানও এককভাবে কারো মত হয়নি। দু’টি দেহের যৌথ কাঠামো হয়েছে তার দেহটি। তার অবয়বের ডান অংশটি ঠিক মায়ের মত এবং বাম অংশটি ঠিক বাবার মত। লক্ষ করে দেখলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আসল নিদর্শন হল তার পায়ের পাতা দু’টি। যে কেউ দেখে অবাক হয়ে যেত, একই ব্যক্তির দুই পা দুই রকম কেন? আসলে তার ডান পা মায়ের আর বাম পা বাবার। এখন তার দেহের ডান অংশ পুরোপুরি বিকল ও অকেজো হয়ে গেছে। ছোট বেলায় পড়ে গিয়ে ডান চোখের পার্শ্বে ফেটে গিয়েছিল- সেলাই দিয়েছিল, বাসায় টিউবওয়েলের আঘাতে থুতনির ডান অংশ ফেটে গেছে, দাঁত ভেঙ্গে গেছে। ভেলায় চড়তে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি থেকে উরুমুল পর্যন্ত চামড়া কেটে দু’ভাগ হয়ে গেছে, ডান হাত ভেঙ্গে গেছে, সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেছে। ডান পা ভেঙ্গে গেছে, হাঁটুর জোড়া ছেড়ে দিয়েছে, ভাঙ্গা লাঠির সিলকার মত শুধু চামড়ায় ঝুলে আছে। তার দেহের ডান অংশ সম্পূর্ণ বিকল। অর্থাৎ তার দেহে মায়ের অংশটা পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। এ অংশটা আর পৃথিবীর উপযোগি নয়। বস্তুত তার দেহে মায়ের অংশের ইহকাল সমাপ্ত হল।

দীর্ঘ সময়ে ধোকতে ধোকতে সে মোড় থেকে তিনশ হাত পরিমাণ অগ্রসর হতে সক্ষম হল। হঠাৎ সে রাস্তার পূর্ব পাশে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সোজা পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছে, বিশ হাত দূরে আধারে ঢাকা নিশানাহীন একটা টার্গেটে সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার চেহারায় আনন্দ উপছে পড়ছে। মেঘের পর সুর্যের ন্যায় তার মুখটা জ্বল জ্বল করছে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠছে। শরীরটা ভাল লাগছে, যেন তার দেহে কোন ক্লান্তি নাই, কোন অবসাদ নাই, সে সুস্থ, সুন্দর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এর সাথে তার যত দুঃখ ব্যথা যন্ত্রনা গ্লানি সব ঝড়ে পড়ল। তারপর সে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেল।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File