প্রযুক্তির অত্যাধুনিকতায় যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতি

লিখেছেন লিখেছেন এস কে দোয়েল ১৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৭:২৮:৩০ সন্ধ্যা

প্রযুক্তির ঝলকানি আলোর বিপরীতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছুই। নতুন প্রজন্ম ধাবিত হচ্ছে যন্ত্রসভ্যতার নব্য সংস্কৃতির দিকে। যার ফলে প্রকৃতির সেই আদি বিশুদ্ধ সংস্কৃতি ক্রমাগতভাবেই বিলীন হতে চলেছে কালের মহাগর্ভে। গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্যে অনেককিছুই চোখে পড়ে না আগের মতো। শিশু-কিশোরদের মধ্যে নেই কানামাছি বৌ বৌ, গোল্লাছুট, গুডুল্লুা, বৌচি, কুটকুট, অ্যাভেন্টি বাঁশকো, 'ইচিং বিচিং' দাড়িয়াবাঁধা, ডাংগুলি, মার্বেল, হা-ডু-ডু, কাবাডি, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, হাড়িভাঙ্গা, লুকোচুরি ঢ়াং, দড়িরলাফ, এক্কা-দোক্কা, আগডুমবাগডুম, পাতা খেলা, লুডু, পাশা-এর মতো খেলাগুলো। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এখন হাতে হাতে মুঠোফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেঙ্টপ কম্পিউটারের জয়জয়কার। তাতে শিশু-কিশোরসহ বয়োজ্যেষ্ঠরাও জড়িয়ে পড়ছেন প্রযুক্তির কৃত্রিম সব সংস্কৃতির মোহে। যার ফলে যন্ত্রসংগীত, টিভি আর কম্পিউটার এবং হাতের মুঠোফোন রঙ- বেরঙের মোবাইলে গান, ভিডিও, সিনেমাসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে ডুবে থাকছে তারা। এতে যন্ত্র সভ্যতায় অভ্যস্ততায় গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে লক্ষ্য করা যায়। কয়েক বছর আগেও গ্রামীণ খেলাগুলোতে শিশু-কিশোর, তরুণ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্য করার মত।

অপরদিকে গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্যে বিয়ে উৎসবে যেসব যানবাহন ব্যবহার করা হতো সেগুলো বিলুপ্তির পথেই বলা যায়। পালকি, ঘোড়ার গাড়ি, গরু-মহিষ গাড়িতে চড়ে দূর থেকে দূরান্ত গাঁগুলোতে বিয়ে উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। কয়েক বছর আগেও ভ্যান গাড়িতে চড়ে বর-কনের বিয়ের মেজবান যাওয়া-আসার দৃশ্য লক্ষ্য করা যেত। এখন সভ্যতার আধুনিকতায় মাইক্রোবাস, মিনিবাস, অটোরিকশা, ট্যাঙ্ক্যিাব এবং খুব যারা বিত্তশালী তারা হেলিকপ্টার, বিমানে চড়ে বিয়ে উৎসব করতে দেখা যায়। এই অত্যাধুনিকতার কবলে পড়ে পিছনে পড়ে যাচ্ছে এই গ্রামীণ সংস্কৃতির যানবাহনের চিত্রগুলো। এছাড়াও গ্রামীণ সেই বিয়েগুলোতে ব্যাপক আনন্দ-ফুর্তি লক্ষ্য করা যেত। রং ছিটাছিটি, গৃহিনী নারীদের দলবেঁধে হাস্তর (গান), হেরুয়া গাওয়ার মধ্যে ছিল এক প্রাণবন্ত আনন্দের মেলা। অথচ প্রযুক্তি সভ্যতার কৃত্রিমতা মানুষের জীবনকে করে তুলছে সংক্ষিপ্ত। এখনকার বিয়ে উৎসবগুলোতে ক্যামেরা বন্দি ছবি ও ভিডিও চিত্র সংগ্রহের ব্যস্ততা, বর-কনের বিয়ের আসরে কবুল শব্দটি উচ্চারণে সময় না নেয়া। ডিজিটাল সময়ের ফিজিক্যাল প্রেম-ভালবাসার তড়িৎ প্রবাহের কারণে বধূ বেশে কনেও বিলম্ব করে না কবুল উচ্চারণ করতে। তাই দ্রুত সময়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে বাসায় ফিরে বাসরশয্যার মধ্যদিয়ে দু'এক দিনের মধ্যে কর্মব্যস্ততায় ফিরে যাওয়া দৃশ্য লক্ষণীয়।

প্রযুক্তি যান্ত্রিক প্রেমের কাছে গ্রামীণ প্রেম-ভালবাসা যেন খুবই বেমানান হয়ে দাঁড়িয়েছে একালে। সে যুগের প্রেম ভালবাসাকে আনকালচারাল বলে ধিক্কার দিয়ে থাকে এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকারা। অথচ গ্রামীণ সেই যৌবনে পা রাখা মেয়েটি তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষায় প্রহরের পর প্রহর দিন গুনতো। রাত জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি লিখতো নিখুঁত প্রেমের মনের গাথুনি দিয়ে। প্রেমিক ছেলেরাও তাদের মনের আবেগ জড়ানো কথাগুলো চিঠিতে ফুটিয়ে তুলতো। পোস্ট অফিসের ডাকবাঙ্গুলো ভরে যেত চিঠি। পোস্ট অফিসের পিয়নও বকশিসের আশায় সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে দিত প্রেমিকের কাছে সেই চিঠি। চিঠি পেয়ে প্রেমিকরা উন্মাদের মতো প্রিয়জনের লেখা সেই চিঠি। প্রযুক্তির যান্ত্রিকতার কবলে শহর-বন্দরের পোস্ট অফিসের ডাকবাঙ্গুলো চিঠিবিহীন নিঃসঙ্গ অবহেলায় দাঁড়িয়ে আছে। কতগুলো মরচে ধরে ভাঙতে শুরু করেছে। মোবাইল প্রযুক্তি আসায় বছরের খুব কমসংখ্যক খোলা হয় ডাকবাক্সগুলো। তাতে দায় আর দায়িত্ব কমে গেছে কর্মকর্তা কর্মচারীদেরও। যার কারণে সেই অবলা নারীর কণ্ঠে আর শোনা যায় না, চিঠি দিয়ো প্রতিদিন, নইলে থাকতে পারবো না, চিঠি কেন আসে না, কিছু ভাল লাগে না'।

প্রযুক্তির যন্ত্রসংগীতের আড়ালে গ্রামীণ সংস্কৃতির সেই ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গানগুলো কৃষক ও রাখালদের মাঝে শোনা যায়না। শোনা যায় রাখালের বাঁশির সেই মনটানা সুর। দেখা যায় না বিশাল চরে রাখাল চড়ানো গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার পাল। মহিষের পিঠে রাখালের সওয়ার। দলবেঁধে পথ চলা গরু-মহিষের দীর্ঘ সারি। খটখট করে চলা গরু-মহিষের গাড়িও তেমন একটা নজরে পড়ছে এখন। শোনা যায় না পল্লী বালিকার সেই আকুতি প্রেমের কলি- ওকি গাড়িয়াল ভাই....এর মতো গানগুলো। শহরের চাকচিক্য পোশাক পরিধি আসায় গ্রামীণ পোশাকে দেখা যায় না নারী-পুরুষদের শরীর। পশ্চিমা কালচারে মিশে গিয়ে দেশীয় সাজ ভুলতে শুরু করেছে এখনকার প্রজন্মরা। জিন্স, টি-শার্ট পোশাকে বোঝাই যায়না নারী না পুরুষ এমন এক শ্রেণীর কালচার। ঘরের গৃহিনীদের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ভোর না হতেই শোনা যেত ঢেঁকির শব্দ। ঢেঁকিতে ধানা ভানার দৃশ্য এখন নজরে পড়ছে না তেমন। শহরের কলকারখানা মেশিনেই ধান, গম ভাঙিয়ে আনে গৃহকর্তারা। দেখা যায় গৃহিনীদের রাঙা পায়ে সিদ্ধ ধান মাড়ানোর দৃশ্য। ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে যেন এসব। তাতে গৃহিনীরা সভ্যতায় পা বাড়িয়ে অফিস আদালতে গিয়ে কাজকর্ম করায় সংসারের সময় মিলেনা অনেক আধুনিক নারীদের। ঘরে ঘরে ইলেক্ট্রিক লাইন আসায় প্রতি ঘরেই এখন স্যাটেলাইট ডিসের টিভির হিড়িক। টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখে এখনকার গৃহ নারী-তরুণীদের। যার কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতির সেই কিছু ঘরোয়ার কাজকর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গ্রামীণ নারীরা একসময় দলবেধে পাখি, ফুল, লতাপাতা ও বিভিন্ন চিত্র এঁকে আকর্ষণীয় নকশিকাঁথা, শিখা তৈরি করতো। এসব নকশিকাঁথা তৈরিতে মেয়েদের যেমন শিল্প নৈপূণ্যের পরিচয় বহন করত, তেমনি অবসর কাটানোর মাধ্যম ছিল এই কারুকার্য । এই চারুকার্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে শহরের যন্ত্রসভ্যতায় নারীদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায়।

প্রযুক্তির যন্ত্রসভ্যতায় কৃষিক্ষেত্রে গ্রামীণ কিছু হারিয়ে যেতে বসেছে। ভোর হলেই কৃষকদের লাঙ্গল-জোয়াল, মই কাঁধে নিয়ে ছুটতে হতো ক্ষেত-খামারে। কৃষক গরু-মহিষের কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল বেঁধে টানা দুপুর পর্যন্ত হাল মারতো ক্ষেতগুলোতে। গ্রীস্ম-বর্ষা ঋতুতে কৃষকদের মাথায় থাকতো মাথাল বা মাথল। বাঁশ ও শাল পাতার সাহায্যে এটি প্রস্তুত করা হতো। রোদ ও বৃষ্টি হতে রক্ষা পেতে গ্রামীণ কৃষকদের নিকট এটি স্মরণীয়। ক্ষেতে বেচারা স্বামীর জন্য গৃহবধূ গামছায় খাবার বেঁধে চলে যেত ক্ষেতে। স্বামী বেচারাও দীর্ঘক্ষণ হাল মারতে মারতে হাঁফিয়ে উঠে প্রতীক্ষা করতো কখন তার গিন্নী খাবার নিয়ে আসে। গ্রামীণ পোশাকে গৃহিনীকে দেখাতো যেন অনন্য সুন্দর নারী। সেই অনুভূতি যেন শুষ্কবোধে পরিণত। গরু-মহিষের হালের পরিবর্তে এখন ট্রাক্টর, সেলোমেশিন দ্বারা ক্ষেত চাষ করছে এখনকার কৃষকরা। যান্ত্রিকতার ব্যবহারে কাজ সহজতর হলেও গ্রামীণ এ দৃশ্যপট হারিয়ে যেতে বসেছে। কার্তিক নবান্নের কৃষক-কৃষাণীর মধ্যে যে ধান মাড়ানি, পিঠা উৎসবের আয়োজন ছিল লক্ষ্য করার মতো। তাছাড়া চাষাবাদের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় গ্রামের সেই উৎপাদিত শস্যগুলো দেখা যাচ্ছে না। কাউন, ডেমছি, মারুয়া গ্রামীণ এ ফসলগুলো কয়েক বছর আগেও কৃষকের ক্ষেতে ও বাড়িতে দেখা যেত। দারিদ্র্যতার হেতু এসব শস্য চাষ করে কৃষকরা খাবারের ব্যবস্থা করতো। কিন্তু সে চিত্র এখন প্রায় অদেখার মতো।

এছাড়াও গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্য হতে হারিয়ে গেছে উৎসবচিত্র। পৌষ পার্বণে প্রচন্ড শীতের মধ্যে গ্রামীণ ছেলে-মেয়েরা মেতে উঠতো বিভিন্ন উৎসবে। পৌষ-মাঘ মাসে ধান কাটার পরপরই চরের মধ্যে কলাপাতা, ধানের খড় দিয়ে কুটির বানিয়ে পিকনিকের আয়োজন করতো। সে পিকনিকে থাকতো মাইক ও ভিসিডি, রঙিন কিংবা সাদাকালো টিভি। সারারাত চলতো মাইকে বিভিন্ন গানবাজনা, ভিসিডির মুভি ও ভিডিও গানের দৃশ্য। উন্মাদ আনন্দ করে কাটিয়ে দিত শীতের লম্বা রাত। এ বনভোজনের দৃশ্যও যেন আজকাল দেখা যায়না। এছাড়াও গ্রামীণ সংস্কৃতির বিয়ে, খাৎনাসহ বিভিন্ন উৎসবে রেডিও, ক্যাসেট, মাইক, ভিসিডি ব্যবহারের প্রচলনে গ্রামীণ আনন্দ-উৎসবগুলো ছিল উপভোগ করার মত। যেমন ছিল প্রযুক্তির কম ব্যবহার, তেমনি ছিল বিশুদ্ধ সংস্কৃতির সমাহার। কিন্তু প্রযুক্তির অসম অত্যাধুনিকতায় যখন মোবাইল, আইপড, আইফোন, ল্যাপ্টপের মতো অনায়াসে ব্যবহার উপযোগী হয়ে পড়েছে, তখন যেন কালের গর্ভে স্থান নিতে শুরু করেছে গ্রামীণ আনন্দের ওই যন্ত্রগুলো।

সভ্যতার ক্রম বিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ অবকাঠামোগুলোর চিত্রও পাল্টে যাচ্ছে চোখের পলকে। গ্রামের প্রায় বাড়িগুলো এখন ইটের দেয়াল, টিনশেড দ্বারা বিল্ডিং। ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকসজ্জা। অথচ কয়েক বছর আগেও গ্রামের বাড়িগুলো দেখা যেত ছন, আখের পাতার তৈরি ঘরের চাল। পাটখড়ি, ছন, কুশিয়ার (আখ) ও গাছের পাতায় বাঁশের বেতিতে বাঁধা বেড়া। এসব বাদেও মাটির দেয়াল ছিল গ্রামের কোনো কোনো বাড়ি। এখন এগুলো তেমন সচরাচর দেখা মেলে না বললেই বলা যায়। বাড়ির আঙিনার পাশেই ছিল মাটির কূপ। কূপ থেকে পানি তুলে গৃহস্থালি, পরিবার, পরিজনদের পানির চাহিদা মিটতো। এখন মাটির কূপের স্থলে টিউবয়েল ও মর্টারের সাহায্যে পানি ব্যবস্থা। এছাড়াও গ্রামীণ সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় মাছ। খাল-বিল, নদ-নদী ভরাট করে শহর-নগরের আবাসন ব্যবস্থাপনার কারণে দেশীয় মাছের অস্তিত্ব নেই। বাজারে এখন দেশীয় মাছ তেমন পাওয়া যায় না বললেই চলে। বাইম, টেংরা, পুঁটি, চেলা, শোল, ঢেরা, বোয়াল, গজার, টাকি, চিংড়ি, শিং, মাগুড়, পাবদা, বাইলা, বিদুরি, বইরালি, কৈ, পয়া, চেং, ভেদা, মাছগুলো পূর্বের তুলনায় পাওয়া যায় না। দেশীয় মাছ ছাড়াও পাখ-পাখালির মধ্যে চড়ই, বাবুই, ঘুঘু, সারস, মাছরাঙা, টিয়া, শালিক, বুলবুলি, বক, পানিকৌড়ি, শকুন, বন মুরগি, বাটৈল, বনহাঁস পাখিগুলোও সচরাচর দেখা মেলে না। পশুদের মধ্যে ভেড়া, মহিষ, শেয়াল, খরগোস, এদের অনেকগুলোই হারিয়ে যাচ্ছে যেন। সভ্যতার পটপরিবর্তনের ফলেই মানুষের জীবনযাত্রা অগ্রবর্তী হওয়ায় পিছনের সমাজ সংস্কৃতি হারিয়ে যায় যেন মহাকালের গহবরে। তবে সচেতন নাগরিক ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিষয়: বিবিধ

১৩২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File