মহিমান্বিত রজনী : লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য ও করণীয় ..

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৭ জুন, ২০১৬, ০১:২৬:১১ রাত



লাইলাতুল কদর :

লাইলাতুল কদর অর্থাৎ মহিমান্বিত রজনী সাধারণভাবে শবে কদর নামেও অভিহিত। আরবী শব্দ ‘লাইল’ ফারসী শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘কদর’ অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত, সম্মানিত। সুতরাং লাইলাতুল কদর এর অর্থ মহিমান্বিত রাত। বৎসরের এই রাতটি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ এবং প্রিয় রজনী। উম্মতে মোহাম্মদী (সা)এর নিকট এটি আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বিশেষ উপঢৌকন এ মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে আল্ কোরআন কর্তৃক ঘোষিত হয়।রমজান আরবী হিজরী সনের মাস গুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এই মাসেই নাজিল হয়েছে মানব জাতির হেদায়েতের বিধান আল্ কোরআন। এরশাদ হয়েছে,

“রমজান সে-ই মাস যাতে নাজিল হয়েছে আল্ কোরআন, যা মানুষের জন্য দিশারী এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মানদ-।” (সূরা বাকারা-১৮৫)

আরো এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমি এই (গ্রন্থ) টিকে নাজিল করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে। তুমি কি জান সেই মর্যাদাপূর্ণ রাত কি? এই মর্যাদাপূর্ণ রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সূরা আল্ কদর : ১-৩)


রাসূল (সা) বলেছেন, “দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহপাক্ পয়গম্বরদের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন তা সবই রমজান মাসেই নাজিল করেছেন।” পবিত্র কোরআন এই মাসে নাজিল হওয়ার কারণে মাহে রমজানের এত মর্যাদা ও সম্মান। আল্ কোরআন আল্লাহর দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত ও নেয়ামত। এরশাদ হয়েছে, “এই কোরআন অসীম দয়াময় আল্লাহ শিখিয়েছেন।” (সূরা আর-রাহমান-১০২)

হযরত জিবরাইল (আ) রমজান মাসের প্রতি রাতে রাসূল (সা)কে কোরআন শিক্ষা দিতেন। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত ফাতেমা (রা)এর অপর বর্ণনায় এসেছে, হযরত জিবরাইল (আ)প্রতি বছর রমজান মাসে একবার রাসূল (সা)এর নিকট কোরআন আবৃত্তি করতেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের বছর দু’বার রাসূল (সা)এর নিকট কোরআন পেশ করেন। কাজেই কোরআনের বদৌলতেই রমজানের মর্যাদা। রমজান মাসের লাইলাতুল কদরেই কোরআন নাজিল হয়েছে বলে আল্ কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা।

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব :

মুসলিম সমাজ রমজানের রোজা রাখার মাধ্যমে এ রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাই ইসলামে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। রোজাদার মুসলমানরা এ রাতকে পেয়ে নিজেকে একজন আল্লাহর বান্দাতে পরিগণিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন। আল্ কোরআনে লাইলাতুল কদরের অনন্য মর্যাদায় একটি পূর্ণাঙ্গ সূুরা রয়েছে। এ সূরা থেকে এর গুরুত্ব অনুভব করা যায়। (১) এ রাতে কালামে রব্বানী নাজিল হয়। (২) এ রাত হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষা উত্তম। (৩) এ রাতে জিবরাইল (আ)এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের একটি দল ধূলির ধরায় অবতরণ করেন। রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ রাতে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে।” (বুখারী)

অন্য হাদীসে আছে, “রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাযা)

অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা) বলেন, “কদর রাতে হযরত জিবরাইল (আ) একদল ফেরেশতা নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। তারা সকল লোকের জন্য দু’আ করে থাকেন, যারা এ রাতে দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় ইবাদতে লিপ্ত থাকেন।” (বায়হাকী)

লাইলাতুল কদরকে “লাইলাতুল হাকাম বা সিদ্ধান্তের এবং লাইলাতুল তাকদীর বা ভাগ্য নির্ধারণের রাতও বলা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়-লাইলাতুল কদরে মানুষের জীবনকাল, মৃত্যু, রিজিক এবং বৃষ্টিপাত ইত্যাদির মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এমনকি পরবর্তী হজ্বের সময় হাজীদের সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের ছায়ালিপি ফেরেশতাদেরকে প্রদান করা হয়। তাকদীরের সিদ্ধান্ত লাইলাতুল কদরে কার্যকরের দায়িত্ব ফেরেশতাদের উপর অর্পিত হয়।”(তাফসীরে রুহুল মা’আনী)



কদরের রাত কোনটি?

লাইলাতুল কদরের রাত কোন্টি তা নিয়ে মত ভিন্নতা চলে আসছে সাহাবায়ে কেরামদের সময়কাল থেকেই। আমাদের দেশে ২৬শে রমজান দিবাগত রাত তথা ২৭শে রমজানকেই নির্ধারণ করে পালন করা হয়। ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকগণও বেশীর ভাগ ঐ দিনকেই সমর্থন করেন। উবাদা ইবনে সামেত (রা) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) বলেছেন, “কদরের রাত হল রমজানের শেষ ১০ রাতের মধ্যে এক বেজোড় রাত। অর্থাৎ হতে পারে তা ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯-এর মধ্যে যে কোন রাত।” (মুসনাদে আহমাদ)

হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “লাইলাতুল কদরকে তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতের মধ্যে বেজোড় রাতে তালাশ কর।” (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযী)

হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি কদরের রাত্রের ভোরে পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করছি। তিনি ২৩শে রমজানের ভোরে সালাত শেষে প্রত্যাবর্তনকালে তাঁর কপালে পানি ও কাদার চিহ্ন দেখা যায়।” (মুসলিম)


ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, “এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আমি একজন বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি। আমার জন্য রাতের সালাত খুব কষ্টকর। আমাকে এমন রাতের আদেশ দিন যে রাত হবে কদরের রাত। তিনি বললেন, তুমি ২৭শে রমজানের রাতকে আঁকড়ে ধর।” (মুসনাদে আহমদ)

সুতরাং এই আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, কদর রাত্রির সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে এবং নির্দিষ্ট তারিখ না হওয়ার পেছনে আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত রয়েছে। ওলামায়ে কেরাম বলেন, এর ফলে মানুষের বেজোড় রাতগুলিতে লাইলাতুল কদর তালাশের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং মুসলমানগণও বেশী বেশী ইবাদত করতে পারবেন।

এই রাত কেন এত মহিমান্বিত-কয়েকটি অভিমত :

ইমাম যুহুরী (র)এর মতে, “আল্লাহর যাবতীয় দিনকালের মধ্যে এ রাতটি সর্বাধিক মর্যাদাশীল, মাহা্ত্ম্যপূর্ণ, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও মহিমান্বিত বলে এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর।”আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর মতে, “লাইলাতুল কদর অর্থ এমন রাত বুঝায় যাতে যাবতীয় ব্যাপারে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এগুলোর চুড়ান্ত রূপদান করা হয় এবং এক বছরের জন্য সব বিধান ও মর্যাদার ফয়সালা আল্লাহ এ রাতে জারি করে দেন।” (শরহে বুখারী আইনী) আবু বকর আল্ ওয়াররাকের মতে, “এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর রাখার কারণ হল, যে লোক মর্যাদাশীল নয় সে যদিও এ রাতকে যথার্থভাবে গ্রহণ করে এবং রাত জাগরণ করে আল্লাহর ইবাদত করে তাহলে সেও মর্যাদাশীল হতে পারে।” এছাড়াও বলা যায়, এ রাতে মু’মিন ব্যক্তি যে নেক আমল করে তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হওয়ার কারণে সে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী হয় বলে এ রাতের নাম দেয়া হয়েছে লাইলাতুল কদর। হাজার মাসের তুলনায় এ রাত উত্তম হওয়ায় এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর হওয়া যুক্তিযুক্ত। সবচেয়ে মর্যাদাশীল কিতাব মহাগ্রন্থ আল্ কোরআন এ রাতে অবতীর্ণ হওয়ায় এ রাত কদর বা অতি মর্যাদার রাতরূপে অভিহিত হতে পারে। হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহর মতে, “আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত বষর্ণের পরিমাণ এ রাতে নির্ধারণ করেন বলে এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর বা নির্ধারণী রজনী।

এ রাতের ইবাদত ও দোয়া :

রাসূল বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে আখেরাতে মুক্তির আশায় কদরের রাতের ইবাদত করবে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (বুখারী) রাসূল (সা) নিজের পরিবারবর্গকে রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে জাগিয়ে দিতেন এবং সাহাবারাও তা ইত্তেবা করতেন। তাই আমাদেরও উচিত রাসূল (সা)এর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে কোরআন নাজিলের এই মাসে বেশী বেশী কোরআন পাঠ, দান-সদকা, যিকির-আযকার এবং নফল ইবাদত করা। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, “আমি একদা রাসূল (সা)কে জিজ্ঞেস করলাম? আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কি দোয়া করব? তিনি বললেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।’’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি মহীয়ান, ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতেই তুমি ভালবাসো, আমাকে ক্ষমা কর। আসুন আমরা সবাই এই মহান রাতকে কাজে লাগিয়ে ইবাদত বন্দেগী করে, আল্লাহর দরবারে তওবা করে অতীতের কৃত গুনাহ থেকে ক্ষমা চেয়ে জীবনকে পুত-পবিত্র করে তুলি।

=====

বিষয়: বিবিধ

১৬৬৬ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

373239
২৭ জুন ২০১৬ রাত ০২:৪০
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইর
২৭ জুন ২০১৬ রাত ০২:৫৬
309839
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : শোকরান, ইয়া হাবিবী..Good Luck Good Luck
373244
২৭ জুন ২০১৬ রাত ০৩:৫৪
কুয়েত থেকে লিখেছেন : এই রাতটি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ এবং প্রিয় রজনী অনেক ভালো লাগলো جزاك الله خيرا وشكرا ধন্যবাদ
২৭ জুন ২০১৬ সকাল ০৭:০৬
309844
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম: ভালো লেগেছে লেখাটা| ধন্যবাদ |
373266
২৭ জুন ২০১৬ সকাল ১১:১৩
দ্য স্লেভ লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ খায়রান। অনেক তথ্যবহুল। আল্লাহ শবে কদরের মর্তবা হাসিলের তাওফিক দান করুন।
৩০ জুন ২০১৬ দুপুর ০১:১৯
310058
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আমিন। জাযাকাল্লাহ!
373293
২৭ জুন ২০১৬ দুপুর ০৩:০৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আমিন। ধন্যবাদ শিক্ষনিয় লিখাটির জন্য।
৩০ জুন ২০১৬ দুপুর ০১:১৯
310059
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আমিন। জাযাকাল্লাহ..
373327
২৭ জুন ২০১৬ রাত ০৮:৩৯
শেখের পোলা লিখেছেন : এই মহিমান্বিত রজনী শুরু হয়ে গেছে। কে কতটুকু নিতে পারবে তা আল্লাহই জানে
তাৎপর্যপূর্ণ লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
৩০ জুন ২০১৬ দুপুর ০১:২০
310060
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : সেটাই আসল কথা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও..
373410
২৮ জুন ২০১৬ বিকাল ০৫:২৫
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : ছুম্মা আমিন, জাজাকাল্লাহ
৩০ জুন ২০১৬ দুপুর ০১:২০
310061
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আমিন। জাযাকাল্লাহ!.
377675
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:২১
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইর
১৯ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০২:২১
313786
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File