|
মিজানুর রহমান খান
|
 |
জামায়াত কীভাবে জড়িত?
14 Dec, 2014
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভে ২০১২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত আমি গবেষণাকাজে নিয়োজিত ছিলাম। এ সময় আমি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্টের আওতায় ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অবমুক্ত করা গোপনীয় নথিপত্র পরিদর্শন করি। ঢাকার মার্কিন কনসাল হার্বার্ট ডি. স্পিভাক ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি তারবার্তায় (আমার নোটবুক অনুযায়ী এর ক্রমিক নম্বর ঢাকা ৫৭২৪) উল্লেখ করেছেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতি দুর্বৃত্ত বা ‘জামায়াত থাগস’রা জড়িত। নিহত বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যায় কত তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি এটা ‘জামায়াত থাগস’রা এটা ঘটিয়েছে। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘কনাইভেন্স’ বা তাদের সম্মতিতে এটা ঘটেছে। এই ঘটনা অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা এবং যুদ্ধাপরাধের দাবি তুলতে পারে।’
আর নির্দিষ্টভাবে আলবদরই যে এর নেতৃত্ব দিয়েছে সে বিষয়ে মার্কিন দলিলপত্রে যেমন, তেমনি তা পাশ্চাত্যের গবেষকেরাও নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক সাইদ ভালি রেজা নসরের নাম প্রণিধানযোগ্য। ভালি নসর লিখেছেন,
‘জাতীয় রাজনীতিতে আইজেটির অবস্থান নিশ্চিত হয় বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মে মাসে। এ সময় আইজেটি পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমন অভিযোনে যোগ দেয়। সেনাবাহিনীর সাহাঘ্যে আইজেটি দুটি আধা সামরিক বাহিনীর ইউনিট সংগঠিত করে। আর তা হলো আলবদর ও আলশামস। তাদের কাজ ছিল বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ আলবদর নেওয়া হয়েছিল আইজেটি সদস্যদের মধ্য থেকে, যারা পূর্ব পাকিস্তানে মুহাজির সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল। আইজেটির নাজিম-ই-আলা মতিউর রহমান নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলবদর ও আলশামস সংগঠিত করেন। গৃহযুদ্ধে তাদের ওই ভূমিকার কারণে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়।’
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ৮ ডিসেম্বর লন্ডনের দি ইকনোমিস্ট ‘গিল্টি অ্যাট বার্থ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে নিজামীকে আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে উল্লেখ করলে নিজামী তার প্রতিবাদ করেন। নিজামী দাবি করেন যে আলবদরের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। অথচ আলবদরের সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা মাওলানা নিজামীরই দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের বরাতে দাবি করেছেন অধ্যাপক ভালি নসর। অধ্যাপক নসর তাঁর বইয়ের ফুটনোটে নির্দিষ্টভাবে এর তথ্যসূত্র হিসেবে ১৯৮১ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত সৈয়দ মুত্তাকিল রহমানের ‘য্যাব ভু নাজিম-ই আলা দি’-এর বরাত দিয়েছেন।
জামায়াত গোড়া থেকেই বাংলা, বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতি, পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন ও নাৎসিদের মতো বর্ণবাদী অবস্থান নিয়ে প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তিক ইস্যুকে নির্দিষ্টভাবে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। এটাকেই আমি বলি জামায়াতবাদ। নাৎসিবাদের মতো এটা নিষিদ্ধ করার দাবি রাখে। ‘মওদুদি স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী, যৌথ নির্বাচনপদ্ধতিকে ইসামবিরোধী এবং সর্বোপরি পদ্ধতিগতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত হয়ে নিজেকে অন্যান্য সব ইসলামি দল বা গোষ্ঠী থেকে পৃথক করেছে। তাই রংপুরে বাংলা ভাষার দাবিতে অধ্যাপক গোলাম আযমের তিন সপ্তাহ জেল খাটার একটি বিচ্ছিন্ন দাবির সঙ্গে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কোনো মিল নেই।’
মার্কিন নথিই সাক্ষ্য দিচ্ছে, মওদুদীর ওই মতবাদই হয়ে উঠেছিল গণহত্যার মূল ‘আদর্শগত’ ভিত্তি।
১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর স্পিভাক লিখেন ‘বাঙালি সৈন্যরা কথিতমতে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প আগে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েক শ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ওই ব্যক্তি অন্তত ২০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ আছে।’ এটা লক্ষণীয় যে মার্কিন কনসাল মূল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ১৪-১৬ ডিসেম্বরে সংঘটিত হয় বলে বর্ণনা করেন। এটা ঘটে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পরে।
হার্বার্ট স্পিভাক ১৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন যে, ‘ঢাকার পশ্চিম পাশে ইটখোলাসংলগ্ন পতিত একটি মাঠের গর্তে ৩০টি গলিত মরদেহের সন্ধান মিলেছে। বিশ্বাস করা হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা সমর্থক ও রাজাকার আত্মসমর্পণের শর্তাবলি যাতে তাদের অনুকূল হয়, সে জন্য প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করেছিল “হোস্টেজ” হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। ওই লাশগুলো গ্রেপ্তারকৃত বুদ্ধিজীবীদেরই হবে। নারী প্রফেসর এবং কতিপয় মেডিকেল স্পেশালিস্টকে আত্মসমর্পণের মাত্র দুদিন আগে হত্যা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, ইটের কারখানার কাছে অনেককেই হত্যা করে গর্তে নিক্ষেপ করা হয়। কথিতমতে রাজাকাররা এখনো ইটখোলায় লুকিয়ে আছে। ভারতীয় একটি টহল দল শনিবার অতর্কিতে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন রাজাকারকে আটক করেছে। কথিতমতে তাঁরা ওই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছে।’
২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্পিভাক ওয়াশিংটনকে জানান, ‘ঢাকার প্রেস এবং জনগণ সার্বক্ষণিক এই চিন্তায় আছেন যে, “বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য” করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেলের বরাতে বলা হয়েছে, জেনারেল ফরমান আলী এবং অন্যরা ১৫-১৬ ডিসেম্বরে যারা নিহত হয়েছে তাদের তালিকা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।’ আরেকটি নথিতে আছে, কেলি নামে ঢাকায় ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনের জে এন দীক্ষিত কেলিকে একান্তে বলেছেন, ভারতীয়রা ফরমান আলীর দপ্তর থেকে কিছু নথিপত্র পেয়েছেন, যা থেকে অনুমান করা চলে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা ছিল।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
Source: প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
BAL /RAW paid agent. He refers 'It is believed ' frequently. So , is it the belief of Ram & RAW groups?
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন