পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রউপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আছড়ে পড়ার একদিন পরেও হাজার হাজার হেক্টর জমি জলমগ্ন হয়ে রয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বঙ্গোপসাগরের তীরে কাঁচা বাড়ি একটিও আর অবশিষ্ট নেই।
আবার দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগণার সুন্দরবন লাগোয়া অঞ্চলগুলিতেও নদী বাঁধ ভেঙ্গে ভাসিয়ে দিয়েছে হাজার হাজার বাড়ি আর গ্রাম।
অনেকেই শুধুমাত্র দরকারী নথি আর পরণের শাড়ি-জামা ছাড়া আর কিছুই বাঁচাতে পারেন নি। তাদের চলে যেতে হয়েছে আশ্রয় শিবিরে।
"আমাদের কিচ্ছু বাঁচে নি - সব মাটিতে মিশে গেছে। এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মা আর সন্তানদের আগেই সরিয়ে দিয়েছিলাম। শেষে আমি আর আমার স্বামী ঘর থেকে 'আইলা কেন্দ্রে' চলে গিয়েছিলাম," ঘূর্ণীঝড় ইয়াস কেটে যাওয়ার পরের দিন ধরা গলায় বলছিলেন রীণা বেরা।
ঘূর্ণীঝড় আইলার পরে নির্মিত ওই অঞ্চলের আশ্রয় কেন্দ্রগুলিকে 'আইলা কেন্দ্র' বলেন অনেক মানুষ।
যে উড়িষ্যায় বুধবার আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণীঝড়টি, তারাই লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা রীণা বেরা।
স্বামী পেশায় মৎসজীবি। কাঁচা বসতবাড়ির সঙ্গেই নৌকা, মাছ ধরার জাল - সবই নিয়ে গেছে 'ইয়াস'।
কাল থেকে শুকনো মুড়ি খেয়ে আছেন স্বামী-স্ত্রী।
পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র মন্দারমনির কাছেই তাদের দাদনপাত্রবাড় গ্রামে মিসেস বেরার প্রতিবেশীদের কারও বাড়িও বাঁচে নি।
জোয়ারের প্রবল তোড়ে সয়লাব জনপদ।
"এরাই সমুদ্রের একেবারে কাছে বাস করেন বহু পুরুষ ধরে। অথচ এরা পাকা বাড়ি করতে সরকারী সহায়তা পান না। কোস্টাল রেগুলেটারি জোনের আওতায় এই সব মৎসজীবিদের গ্রামগুলো পড়ে, তাই সেখানে পাকা বাড়ি নির্মাণ করতে দেয়া হয় না। অথচ সরকারী অনুদানে পাকা বাড়ি এদেরই দরকার সবথেকে বেশী," বলছিলেন কাঁথি মহকুমা খুঁটি মৎসজীবি ইউনিয়নের সভাপতি তমালতরু দাস মহাপাত্র।
তার কথায়, "আইনের একটা অপব্যাখ্যা করে এটা আটকানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী চিরাচরিতভাবে যারা সমুদ্র উপকূলে বসবাস করেন, তাদের কিন্তু ছাড় দেওয়া আছে ওই আইনে।"
অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াস যেখানে স্থলভাগে আছড়ে পড়েছে, সেই উড়িষ্যার লাগোয় এই পূর্ব মেদিনীপুরেই সবথেকে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে - বিশেষত সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে।
পূর্ব মেদিনীপুরের মতোই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগণার বিভিন্ন এলাকাতেও। বহু জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে লবনাক্ত জল ভাসিয়ে দিয়েছে চাষের ক্ষেত। ভেসে গেছে মাটির বাড়ি। লবন জলে ভরে গেছে মিষ্টি জলের মাছ চাষের পুকুর।
সুন্দরবন লাগোয়া দক্ষিণ ২৪ পরগণার দ্বীপ গোসাবার বাসিন্দা সফিউল লস্কর যখন গতকাল বাড়ি ছেড়ে এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে এসেছিলেন, তখন তার বাড়ির অর্ধেকেরও বেশী জলের তলায়।
তিনি বলছিলেন, "বাড়িটা কী অবস্থায় আছে জানি না, আদৌ টিঁকে আছে কী না কে জানে! কয়েকটা দরকারী নথি আনতে পেরেছিলাম। যে আত্মীয়ের বাড়িতে আছি, তারা কেউ এখন যেতে দিচ্ছে না।"
সুন্দরবনের আরেকটি দিকে উত্তর ২৪ পরগণার মিনাখাঁ অঞ্চল।
সেখানকার মোহনপুর এলাকায় বাড়ি বিশ্বজিত আরির।
তিনি বলছিলেন, "ঘূর্ণীঝড় আর জোয়ারের জল একসঙ্গে আসায় বেশ কয়েকটা জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গে পুরো গ্রাম ভাসিয়ে দিয়েছে। কাঁচা বাড়ি কোথাও নেই - মাঠে, পুকুরে লবনাক্ত জল ভরে গেছে বেশ কয়েক ফুট।"
প্রায় একই দৃশ্য চোখে পড়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের কর্মী আজিজুল হালদারের।
পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে তিনি বৃহস্পতিবার গিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার কুলতলি এলাকার পেটকুলচাঁদে।
"চারদিকে শুধু জল। পাকা বাড়িগুলো টিঁকে আছে। মাটির ঘরগুলো বেশীরভাগই পড়ে গেছে। যে ক'টার চাল বা অর্দ্ধেকটা এখনও টিঁকে আছে, সেগুলোও পড়ে যাবে জল সরতে শুরু করলেই। মাটির বাড়িতে সেটাই হয়," জানাচ্ছিলেন মি. হালদার।
ঠিক এক বছর আগে সুপার সাইক্লোন আমপানের কবলে পড়ে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছিল এই দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগণা জেলা দুটি। তারপরে ত্রাণ গেছে- নদী বাঁধ সারাই হয়েছে - কিন্তু একবছরের মধ্যে আবারও সেই বাঁধ ভেঙ্গে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলছেন, তার সরকার নদী বাঁধ রক্ষা করতে একটা টাস্ক ফোর্স গঠন করবেন ক'দিনের মধ্যেই। তবে গ্রামের মানুষ নিজেরাই বাঁধ সারাইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন ইতিমধ্যে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন