৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় বেশ হতাশা আছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। নেতাকর্মীদের এই হতাশা কাটাতে কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা যায় তা নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের নেতাদের ভাষায়, তাঁরা ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করেন, বিগত ১৫ বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন এবং এর ভিত্তিতে সংগঠন পুনর্গঠন ও দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘প্রাণ’ ফেরানো সম্ভব।
এর পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার ও দলীয় কৌশলেও বেশ পরিবর্তন আনতে হবে।
দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর দলের শীর্ষ পর্যায়ে এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হচ্ছে। তাঁদের আলোচনা সূত্রে জানা যায়, আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে দলের কাউন্সিল করার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, যেকোনো বড় আন্দোলনে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে। এবারের আন্দোলনেও অনেকের ব্যর্থতা চোখে পড়েছে। কেউ দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। পুনর্গঠনের মাধ্যমে এসব বিষয়ের মূল্যায়ন করা হবে।
অভিজ্ঞতা থেকে নতুন শুরু
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে সফল হয়নি বিএনপি। আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে বিএনপি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উপলব্ধি হয়েছে যে বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শুধু রাজপথে সক্রিয় থেকে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় রোজার ঈদের পর দলীয় কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে তা শুরু করবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
কেউ কেউ প্রথমে সাংগঠনিক সংস্কার শুরু করার কথা বলছেন। অনেকে মনে করেন, আগে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা দরকার। এর ভিত্তিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা উচিত।
দলের কর্মকৌশল প্রণয়নে যুক্ত একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু দল পুনর্গঠন কিংবা জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে পদের পরিবর্তন করলে লাভ হবে না। বরং সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন চলবে না কি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনের নতুন পন্থা তৈরি করা হবে; তা আগে নির্ধারণ করতে হবে।
দল পুনর্গঠনে নজর বেশি
নির্বাচনের পর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দল পুনর্গঠনে তাঁর নজর বেশি। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ১ মার্চ বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি পুনর্গঠন করেছেন। এখন স্বেচ্ছাসেবক ও যুবদল পুনর্গঠন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে এই তিন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।
অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে মূল দল বিএনপির সাংগঠনিক নেতৃত্বে পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলীয় কাউন্সিলের বিষয়টি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয়ে দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
পূর্বমুখী কূটনীতি জোরদারের চিন্তা
পরাশক্তি দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে হবে বলে মনে করছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এ জন্য কূটনৈতিক তত্পরতায় ভিন্নতা আসতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর চীনসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠক হয়েছে। ওই আলোচনা থেকে দলটির নেতাদের মনে হয়েছে, বিএনপির বিষয়ে চীনের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বিএনপিও পূর্বমুখী কূটনীতি জোরদার করতে আগ্রহী।
বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে বলে দলটির নেতারা মনে করছেন। সে জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই ভারতের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনেকে। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সমালোচনার মনোভাব ধরে রাখার পক্ষে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে মত দিয়েছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিএনপি নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করতে চায়। পশ্চিমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা দূরত্ব আছে তা কাটিয়ে তোলার পরিকল্পনা আছে দলটির। মূলত পর্দার আড়ালে কৌশলগত আলোচনাকে এখন বেশি প্রাধান্য দেবে বিএনপি।
জনসম্পৃক্ত আন্দোলনেও থাকবে
চলতি বছরে বড় কোনো আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই বিএনপির। তবে ইস্যুভিত্তিক জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি বাড়ানো হবে। এ জন্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়লেও কর্মসূচি দেওয়া হবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সামনে গরমকাল আসছে। এ সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়বে। তখন কর্মসূচিও বাড়ানো হবে। তবে সব কর্মসূচি হবে অহিংস।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, ঈদের পর যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হবে। তাদের মতামতের ভিত্তিকে যুগপতের কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এখন যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি না থাকলেও শরিকদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন হয়ে গেল মানেই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ যে প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখল করে আছে তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন চলবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন