সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টাকা-রুপির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অনেকের মতে এটি বাংলাদেশের ডলার নির্ভরতা কমাবে। অনেকে আবার বলছেন, মূল লাভের অংশ যাবে ভারতের ভাগে। এমন দ্বিমুখী অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কার লাভ বেশি হবে?
বিশ্ব অর্থনীতি নতুন একটি যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে ডলারের আধিপত্য অস্বীকার করে নিজেদের মুদ্রাব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে চাইছে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো। এরই সূত্র ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ডলারের বদলে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করছে ভারত।
পুরো বিষয়টি এখন পর্যন্ত একটি পাইলট প্রজেক্ট অবস্থায় আছে। এতে করে টাকা-রুপির বাণিজ্য নিয়ে অনেকের মনে রয়েছে সংশয়।
শুরুতে বাংলাদেশ-ভারত এ বাণিজ্য টাকাতে নয় বরং রুপিতে হবে বলে জানিয়েছেন দুটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধানরা। এর বাইরে বাংলাদেশ ভারতে যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করবে তার সমপরিমাণ পণ্য রুপিতে আমদানি করবে বলে চুক্তিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশের বৃহৎ আমদানি বাজার ভারত হলেও, রফতানি বাজারের জায়গা থেকে ভারতের অবস্থান অনেক নিচে। প্রতিবছর বাংলাদেশ ভারতে ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি করে। এর বিপরীতে ভারত থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলার।
এতে করে দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ভারতীয় মুদ্রায় ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য রুপিতে আমদানি করতে পারবে। বাকি ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করতে আপাতত আগের মতোই ডলার ব্যয় করতে হবে।
বাংলাদেশের কী লাভ?
ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মতে, রুপিতে বাণিজ্য চালু হওয়ায় বাংলাদেশের লাভ মূলত দুটি; প্রথমত রুপিতে পণ্য কিনতে পারলে টাকা থেকে ডলার ও ডলার থেকে রুপিতে রূপান্তরের ঝামেলা থাকবে না। এতে করে দুই দেশের ডলারের দুই দামের কারণে যে পরিমাণ অর্থ অপচয় হতো তা সাশ্রয় হবে। কিছুক্ষেত্রে এ সাশ্রয়ের পরিমাণ ৬ শতাংশ পর্যন্ত দাঁড়াবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে হিলি ও বেনাপোলের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, রুপিতে আমদানি শুরু হলে ডলারের জন্য যে হাহাকার তা কমে আসবে। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতা কমে আসবে। ফলে আমদানি সুগম ও সহজ হবে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ স্থানীয় সময় সংবাদের প্রতিনিধিকে বলেন, আপাতত বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (আইসিআইসিআই) ব্যাংকের মাধ্যমে রুপিতে বাণিজ্য হবে।
তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার প্রসার না হলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পূর্ণ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না।
ডুয়েল কারেন্সির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ডুয়েল কারেন্সি কার্ড চালু হবে। অন্যদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে ভারতও চলতি বছরের শেষের দিকে ডুয়েল কারেন্সি কার্ড চালু করবে। দুই দেশে ডুয়েল কারেন্সি কার্ড চালু হলে বাংলাদেশের শুধু ব্যবসায়ীরা নন, পর্যটক বা যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে যান তারাও সুবিধাভোগী হতে পারবেন।
রুপিতে বাণিজ্য কমাবে ডলার নির্ভরতা
তবে রুপিতে বাণিজ্য করা নতুন বা একেবারে ব্যতিক্রম কিছু না উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, এর আগেও ১৮টি দেশের সঙ্গে ভারতের রুপিতে বাণিজ্যের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯তম দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে এ চুক্তি করলো। যদিও এটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, তবে রুপিতে বাণিজ্য বহুপাক্ষিক হলে রিজার্ভে থাকা রুপি দিয়ে এসব দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে বাংলাদেশ।
একমাত্র কারেন্সি হিসেবে রিজার্ভে ডলারের মজুত নিয়ে আকাশ বলেন, ডলার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও রাজনৈতিক ফায়িদা হাসিল করছে। তারা চাইলেই যেকোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের বেকায়দায় ফেলতে পারছে। এরইমধ্যে রাশিয়া, চীন ও ইরান এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
রিজার্ভে সিঙ্গেল কারেন্সি থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই নিষেধাজ্ঞার নামে সেই দেশে একচেটিয়া আধিপত্য বিরাজের চেষ্টা করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশ্বের বড় বড় দেশ একক মুদ্রার মজুত থেকে সরে এসে বহু মুদ্রা মজুতের দিকে এগুচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রুপিতে বাণিজ্য ডলারের ওপর একক নির্ভরতা কমাবে।
এছাড়া টাকা-রুপির বাণিজ্যে আরকেটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দুটি মুদ্রার বিনিময় হার। বর্তমানে এক টাকার বিপরীতে রুপির বিনিময় হার ৭৫ পয়সার কিছুটা বেশি। যদি ভবিষ্যতে টাকার বিপরীতে রুপির মান বাড়তে থাকে তাহলে আবার ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এছাড়া রুপির সঙ্গে ডলার, টাকার সঙ্গে রুপি এবং টাকার সঙ্গে ডলারের মানের সামঞ্জস্য ঠিক থাকলে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
আমদানি-রফতানির বাজারের কথা উল্লেখ করে আকাশ বলেন, ভারত কিংবা চীন বাংলাদেশের আমদানি বাজার হলেও মূলত রফতানি বাজার ইউরোপ-আমেরিকা। এক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি করে বাংলাদেশ যেমনি ডলার আয় করতে পারবে, অন্যদিকে ভারত থেকে রুপিতে পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ ডলার সাশ্রয় করতে পারবে।
এদিক দিয়ে টাকা-রুপির এ ব্যবস্থা বাংলাদেশকে সুবিধা দেবে। অন্যদিকে ভারতে রফতানি করে বাংলাদেশ ডলার পাবে না এবং এতে করে ক্ষতির মুখে পড়বে বলে যারা ভাবছেন, মনে রাখতে হবে, একইভাবে আমদানির বেলায়ও ডলারের চাহিদা কমছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে কী হবে এখনই তা হলফ করে বলা না গেলেও, হাতে রুপি থাকলে স্বল্প মেয়াদে সেখান থেকে সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
ভারতের লাভ কতখানি?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর রিজার্ভে দেখা দিয়েছে ডলার সংকট যার ভুক্তভোগী খোদ ভারতও। এক্ষেত্রে গত বছর থেকেই নিজেদের মুদ্রায় আমদানি-রফতানিতে তোড়জোর শুরু করে দেশটি। বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করে বড় রকমের লাভ হয়েছে।
এছাড়া গত বছরের ডিসেম্বর থেকে রাশিয়ার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসের সঙ্গেও রুপিতে বাণিজ্য শুরু করেছে দেশটি। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার পাইলট প্রজেক্ট হাতে রয়েছে ভারতের।
এ সূত্র ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যে ভারতের লাভই বেশি। নিজেদের মুদ্রাকে সার্বজনীন করতে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশটি।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটি বাণিজ্যিক চুক্তি হলে দু’পক্ষই লাভের চিন্তা করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেমন লাভ আছে, তেমনি ভারতেরও অনেকগুলো সুবিধার দিক আছে। বাংলাদেশ যেমন ডলার নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে, ভারতও তাই করছে। কিন্তু টাকা চালু না হয়ে যদি শুধু রুপিতে ব্যবসা হয় বাংলাদেশ এক রকমের ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়েই থাকবে।
অন্যদিকে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করে এক লাফে আন্তর্জাতিক না হোক, রুপিকে আঞ্চলিক মুদ্রায় রূপ দিতে এগিয়ে যাবে ভারত। তবে আরেকটি বিষয় হলো, রুপির মুজতকে আদৌ রিজার্ভের মজুত বলা যায় কি না।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত না হলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বা বিশ্বব্যাংক রুপিকে রিজার্ভের অর্থ হিসেবে স্বীকার করবে না। আবার রুপি দিয়ে শুধু ভারতের সঙ্গেই ব্যবসা সীমাবদ্ধ হলে বাংলাদেশ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একচেটিয়া ভারতনির্ভর হয়ে পড়বে বলে জানান মনসুর।
এদিকে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, রুপিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তিশালী করতে চাইলে ভারতকে পণ্য রফতানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। ভারত উৎপাদনশীলতা বাড়ালে ও বিশ্বের দেশগুলোকে নিজদের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারলে রুপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। নিজেদের রফতানি মান না বাড়িয়ে শুধু দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে রুপিকে সার্বজনীন রূপ দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন