দেশে খুব অল্প সময়েই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল অনলাইনে কেনাবেচার মাধ্যমগুলো। মহামারি করোনাকালেও যখন সার্বিক অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধের উপক্রম হয়েছিল, তখন দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ২০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় যথাযথ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে ই-কমার্স খাত। নিয়ন্ত্রণের অভাব আর কিছু ব্যবসায়ীর অসাধু কর্মকাণ্ডে আস্থার সংকটে পড়েছে খাতটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-কমার্স হলো অনলাইনে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাবেচার সহজ মাধ্যম। কিন্তু সম্ভাবনাময় এই মাধ্যম ব্যবহার করে চটকদার বিজ্ঞাপন, অস্বাভাবিক মূল্যছাড়ের নামে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে প্রতারণার জাল বুনেছে অসাধুরা।
শুরুর দিকে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সাইক্লোন অফার, ২০% থেকে ১৫০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক দেয়ার অবিশ্বাস্য অফার দিতে দেখা যায়।
অর্থাৎ ১০০% অফারে গ্রাহক যেমন পণ্য পাবেন, সেইসঙ্গে মূল টাকাও ফেরত পাবেন। এমন অবিশ্বাস্য অফার পেয়ে লাখ লাখ গ্রাহক ওই ই-কমার্স সাইটগুলোতে পণ্য অর্ডার করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এভাবে প্রথম প্রথম কিছু গ্রাহকের কাছে পণ্য সরবরাহ করলেও কয়েকদিনের মাথায় বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ না দেয়া, সেইসঙ্গে মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ না করার অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটি বড় ধসের মুখে পড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অস্বভাবিক মূল্য ছাড় এবং এডভান্স পেমেন্ট অর্ডার নিয়ে যথাসময়ে গ্রাহকের হাতে পণ্য না পৌঁছানোর অভিযোগই ছিল মূল আলোচনা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বৃহৎ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ বেশ গুরুতর। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে মনিটরিংয়ের অভাব এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য থামছে না।
ই-কমার্স অঙ্গনে খুব অল্প সময়ে উত্থান ইভ্যালির। কিন্তু বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের আকর্ষণ দেখিয়ে ক্রেতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে অল্পদিনে সফল হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহক ভোগান্তির শীর্ষে অবস্থান করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির গ্রাহক ছিল ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকায়। চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৪ কোটি টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। আবার যেসব কোম্পানির কাছ থেকে ই-ভ্যালি পণ্য কিনেছে, তাদের কাছেও এর বকেয়া পড়েছে ১৯০ কোটি টাকা। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৭ই জুলাই আদালত ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও সিইও মো. রাসেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ইভ্যালির প্রতারণার বিষয়টি আলোচনায় এলে এরসঙ্গে আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্টসহ অন্তত ১০-১২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠে আসে। তখন থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনসহ যাবতীয় কার্যক্রম নজরদারিতে রাখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই মধ্যে নতুন করে আলোচনায় আসে ই-অরেঞ্জ এবং ধামাকার কয়েকশ’ কোটি টাকার প্রতারণার বিষয়টি। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া ধামাকা শপিং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ৫৮৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির এমডিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।
ই-কমার্স এসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশ-এর (ইক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুুল ওয়াহিদ তমাল মানবজমিনকে বলেন, ই-কমার্সকে ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করছে তাদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। কোনোভাবেই তাদেরকে আমরা ছাড় দিচ্ছি না। যারা ই-কমার্সের নাম নিয়ে এমএলএম ব্যবসা করছে কিংবা বিভিন্ন পলিসির নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা ইতিমধ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। তাদের সদস্য পদ স্থগিত এবং বাতিলও করছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছি। সেইসঙ্গে আমরা অনুসন্ধানও করছি যে, কারা কীভাবে ব্যবসা করছে। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এমনকি এনএসআইকেও জানাচ্ছি। এখন তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া আমরা ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে একটি সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি করছি। যেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার এবং ই-ক্যাব মিলে করা হচ্ছে। এটি শিগগিরই আমরা চালু করবো, যাতে ভোক্তারা একসঙ্গে এখানে অভিযোগ জানাতে পারেন।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমরা ইভ্যালিকে একটি নোটিশ করেছিলাম কিছু তথ্য দেয়ার জন্যে। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা এ সপ্তাহে একটি মিটিং করবো। এরপর কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেয় সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর অন্য ৯টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি। ধামাকা এবং ই-অরেঞ্জ তাদের একাউন্টস সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য জানতে চিঠি দিয়েছি। এটা আমরা এখনো পাইনি। অপেক্ষায় আছি। পেলে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন অভিযোগ আসে। অভিযোগ এলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তারা যে পলিসি কিংবা অফার দেয়, সেগুলো তারা সংশোধন করলে তাদেরকে আমরা আর কিছু বলি না। তিনি বলেন, তবে বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে দেশের ই-কমার্স খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে আমরা নতুন নীতিমালা করার পর বেশকিছু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছে তাদের পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছে না। তারা আটকে গেছে। তাই দীর্ঘ সময় পণ্য ডেলিভারি না দেয়াতে গ্রাহকদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন