রাশিয়া জান্তাকে সমর্থন করছে। কারণ রাশিয়ার ওই অর্থে এখন কোনো বন্ধু নেই। রাশিয়াকে মিয়ানমারের যতটা দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার মিয়ানমারকে রাশিয়ার। চীন এখন গঠনমূলক অবস্থান নিয়েছে।
তারা মিয়ানমারের জান্তাকে চাপ দিচ্ছে। আমি মনে করি, চীন মিয়ানমার ইস্যুতে সংযত উদ্যোগ নিচ্ছে। এটি ইতিবাচক
কালের কণ্ঠ : আপনিসহ কয়েকজন আইনজীবী ইন্দোনেশিয়ার আদালতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন। আপনারা কী উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নিলেন?
মারজুকি দারুসমান : মিয়ানমারে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। ইন্দোনেশিয়ার আইনে ইন্দোনেশীয় ও বিদেশি সবার সমান অধিকার। তাই আমরা মনে করি, বিচারের সর্বজনীন এখতিয়ার প্রয়োগের সুযোগ ইন্দোনেশিয়ায়ও আছে। অর্থাৎ মিয়ানমারে নিপীড়নের দায়ে জান্তার বিচার হওয়ার সুযোগ ইন্দোনেশিয়ায় আছে। সে জন্য আমরা ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আদালতে মামলা করেছি। সোমবার (আজ) দুপুরে ওই মামলার শুনানি হওয়ার কথা।
কালের কণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে মিয়ানমার পরিস্থিতি আসলে কেমন এবং কতটা জটিল?
মারজুকি দারুসমান : এখন সেখানকার পরিস্থিতি খুবই জটিল। সত্যিকার অর্থে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মিয়ানমারের জান্তা দেশটির অর্ধেকেরও বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব হারিয়েছে। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, এ মাসের প্রথমার্ধে মিয়ানমারের ৫২ শতাংশ এলাকা জান্তাবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তবে এটি স্থায়ী নয়। দখল-পাল্টাদখল, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের এক বছরের বেশি সময় পরও গণতন্ত্রের আন্দোলন থামাতে পারেনি জান্তা। বরং এটি আরো জোরালো হয়েছে। জান্তাবিরোধী পক্ষগুলো একজোট হচ্ছে। জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ গড়ে উঠেছে। সশস্ত্র নৃগোষ্ঠীগুলোও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারাই এখন কার্যত সরকারে পরিণত হয়েছে। কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণেই এখন বেশির ভাগ ভূখণ্ড এবং জনগণ তাদের নিয়ন্ত্রণে ও পক্ষে।
কালের কণ্ঠ : এ অবস্থায় জান্তার প্রতিক্রিয়া কেমন দেখছেন?
মারজুকি দারুসমান : জান্তা তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বিচারে বল প্রয়োগ করছে। এমনকি শিশুদেরও হামলার লক্ষ্যে পরিণত করছে। তাই পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভয়াবহ। জান্তার নিষ্ঠুরতা থেকে কেউই বাদ পড়ছে না। এটি অবশ্য দেশটিতে জান্তার কর্তৃত্ব কমার লক্ষণ।
কালের কণ্ঠ : মিয়ানমারে সংঘাতের গোলা বাংলাদেশেও এসে পড়ছে।
মারজুকি দারুসমান : আমি মনে করি, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। এ কারণে জান্তা তার সম্ভাব্য সব উপায়ে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে ও পড়বে। প্রতিবেশীদেরও মিয়ানমার সংকটের প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ওপর মিয়ানমারের এই সংঘাতের প্রভাব কতটা পড়তে পারে?
মারজুকি দারুসমান : সংঘাত, সহিংসতা থামলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলক সহজ। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে হয়তো রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে না। তাই রোহিঙ্গাদের ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মিয়ানমারে সংঘাত, সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। আবার দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ সংকটের সমাধান হয়ে গেল, এমনটি নয়।
কালের কণ্ঠ : রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী প্রবাসী সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি)’ মনোভাব কী?
মারজুকি দারুসমান : এনইউজি রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে পুরোপুরি অবগত। এনইউজি রোহিঙ্গা জেনোসাইড এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের অংশ হিসেবে পুরোপুুরি স্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেছে। এটি খুবই স্পষ্ট। তবে এ জন্য তাদের বর্তমান নাগরিকত্ব আইন বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। রোহিঙ্গাসহ অন্য সব নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটি আগামী দিনগুলোর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
কালের কণ্ঠ : এনইউজির শীর্ষ প্রতিনিধিরা মূলত কাজ করছেন বিদেশে। মিয়ানমারের সত্যিকারের সরকার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা এনইউজির কি আছে?
মারজুকি দারুসমান : মিয়ানমারের সত্যিকারের সরকার কারা হবে তা সে দেশটির জনগণই ঠিক করবে। তবে এই মুহূর্তে এনইউজি মিয়ানমারের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে। ২০২০ সালে মিয়ানমারে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এনইউজিতে আছেন। এনইউজি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার নিদর্শন। এটি সত্যি, এনইউজিকেও ভবিষ্যতে সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকার হতে হবে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে এনইউজি তাতে শীর্ষ দাবিদার থাকবে।
কালের কণ্ঠ : আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এনইউজির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?
মারজুকি দারুসমান : মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এনইউজি বেশ ভালো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে এনইউজি এখনো পুরোপুরি স্বীকৃতি পায়নি। এর পেছনে কিছু কারণও আছে। আমার মনে হয়, এনইউজির সঙ্গে প্রায় সব দেশই যোগাযোগ রাখছে। এটি অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নয়। আমি মনে করি, এনইউজিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
কালের কণ্ঠ : মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা কী? তারা কি এখনো জান্তাকে সমর্থন করছে?
মারজুকি দারুসমান : রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তাকে সমর্থন করছে। কারণ রাশিয়ার ওই অর্থে এখন কোনো বন্ধু নেই। রাশিয়াকে মিয়ানমারের যতটা দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার মিয়ানমারকে রাশিয়ার। চীন এখন অনেক গঠনমূলক অবস্থান নিয়েছে। সমস্যার সমাধান করতে চীন মিয়ানমারের জান্তাকে চাপ দিচ্ছে। চীন এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যুতে গঠনমূলক উদ্যোগ নিতেও প্রস্তুত। আমি মনে করি, চীন মিয়ানমার ইস্যুতে সংযত উদ্যোগ নিচ্ছে। এটি ইতিবাচক।
কালের কণ্ঠ : মিয়ানমার প্রশ্নে আসিয়ান দেশগুলোর মনোভাবেও কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?
মারজুকি দারুসমান : অবশ্যই। নভেম্বরে কম্বোডিয়ায় আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন হবে। সেখানে মিয়ানমার নিয়ে পাঁচ দফা ঐকমত্য বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করা হবে। আমার মনে হয়, মিয়ানমারে সংঘাত-সহিংসতা থামাতে আসিয়ানের নতুন উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আসিয়ানের উচিত মিয়ানমারের জন্য একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা, যেখানে মিয়ানমারে সংঘাতে যুক্ত সব পক্ষ স্বীকৃতি পাবে। সমাধান অবশ্যই মিয়ানমার থেকে হওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ : শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার ও তার জনগণের জন্য কেমন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বলে আপনি মনে করেন?
মারজুকি দারুসমান : মিয়ানমারের বর্তমান সময়টা রক্তপাতের। এই সংঘাত ও কঠিন সময় শেষে মিয়ানমারের জনগণের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে। কারণ মিয়ানমার সম্পদশালী দেশ। ভৌগোলিকভাবে বেশ কৌশলগত স্থানে দেশটি। মিয়ানমার যখন গণতান্ত্রিক দেশ হবে, তখন আবারও গঠনমূলকভাবে আঞ্চলিক ও বিশ্বমঞ্চে ভূমিকা রাখবে।
কালের কণ্ঠ : ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মারজুকি দারুসমান : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন