প্রমত্তা পদ্মাপাড়ের বিশাল বালুকাময় এলাকায় গড়ে উঠেছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। গড়ে উঠেছে শহরের পরিবেশ। পাল্টে যায় জীবনযাত্রার মান। তৈরি করা হয় নানা অবকাঠামো। অদূরে অজগাঁও গ্রামে হয়েছে অত্যাধুনিক ২০তলা ভবন। ছোঁয়া লেগেছে বিদেশি সংস্কৃতির। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, মাত্র কয়েক বছর আগেও এখানে ছিল ছোট ছোট ঘরবাড়ি ও গ্রামীণ পরিবেশ। ধু ধু বালুরাশি আর কাঁশবনের ঢেউ তোলা বিস্তীর্ণ এলাকা। পশ্চিম আকাশের সূর্যটি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসত রাজ্যের নীরবতা। শোনা যেত কেবল হুক্কাহুয়া বলে শিয়ালপ-িতের ডাক।
দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার পথ পাবনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক। এই সড়কেই পদ্মার ওপর লালনশাহ সেতু। আর সেই সেতুর পাশেই চলছে ১ লাখ ১৩ হাজার
কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের সবচেয়ে মেগাপ্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। দেশি-বিদেশি প্রায় ২৪ হাজার প্রকৌশলী-শ্রমিক কাজ করছেন। রাশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই হাজার বিদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। বাকিরা এ দেশের। প্রকল্প শুরুর পর থেকেই বদলে যেতে থাকে এলাকার চিত্র। বেড়েছে জমির দাম। শুধু রূপপুর নয়, পার্শ্ববর্তী পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদী শহরেও পরিবর্তনের ছোঁয়া।
বিদেশি নাগরিকদের কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন মেটাতে পাকশী, সাহাপুর, রূপপুর ও ঈশ্বরদী শহরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিপণিবিতান, আধুনিক শপিংমল, সুপারশপ, রিসোর্ট ও তারকা হোটেল। উন্নতমানের হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো এলাকাই এখন মুখরিত। এখানকার কাঁচাবাজারগুলোতেও লেগেছে রাশিয়ানদের ছোঁয়া। যাত্রাপথে যে কারোরই চোখ আটকে যায় ঈশ^রদীর গ্রিন সিটিতে। এর বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো কর্মহীন মানুষের। রুশভাষাভাষী কয়েক হাজার বিদেশি কর্মীর অবস্থানে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রাতেও প্রভাব পড়েছে রাশিয়ান সংস্কৃতির। সম্প্রতি এলাকার রিসোর্টগুলো ঘুরে দেখা যায়, রাশিয়ানদের সঙ্গে মিশে অনেক বাংলাদেশিও শিখে গেছেন রুশ ভাষা। রাশিয়ানরাও ভাঙা ভাঙা বাংলায় স্থানীয়দের সঙ্গে বিনিময় করতে পারেন মনের ভাব। সব মিলিয়ে পাবনার রূপপুর যেন এখন এক টুকরো রাশিয়া। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেক আধুনিক বহুতল ভবন। সেখানেও বসবাস করেন তিনশতাধিক রাশিয়ান।
ঈশ্বরদী শহর ছাড়াও গ্রিন সিটির সামনে গড়ে উঠেছে গ্রিন থাই চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কিউ বিস্ট্র চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, গ্যালাক্সি চাইনিজসহ প্রায় ১৪টি রেস্টুরেন্ট। এগুলো প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শপিংমল, দোকান ও খাবারের রেস্টুরেন্টে মূল্যতালিকা ইংরেজির পাশে রাশিয়ান ভাষাতেও লেখা থাকে, যাতে রুশরা তা বুঝতে পারেন। গ্রিন থাই চাইনিজ রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী মাসুদ রানা বলেন, ‘তিন বছর আগে আমরা এখানে প্রথম রেস্টুরেন্ট করি। এখন ১৪টি হয়েছে। সবগুলোতেই ভালো বিক্রি হয়। প্রথমে একটু ভাষাগত সমস্যা হতো, এখন আর সেটি হয় না। এখন আমরা অনেকটা রুশ ভাষা বুঝি আর রুশ নাগরিকও অনেকটা বাংলাভাষা শিখে গেছে। আমরা ওদের ফ্রেন্ড বললে ওরা আমাদের বলে নো নো বন্ধু। ওরা আমাদেন বন্ধু বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।’
স্থানীয়রা জানান, প্রথম প্রথম রুশ নাগরিকরা বাজারে এলে সঙ্গে পুলিশ থাকত কিন্তু এখন আর পুলিশ দরকার হয় না। রুশ নারী-পুরুষ সবাই একাই কখনো রিকশায়, কখনো বাইসাইকেল, অটোবাইকে আবার অনেকে পায়ে হেঁটে বাজারে, শহরে ঘুরে বেড়ায়। ওরা একেবারে ঈশ্বরদীবাসীর সঙ্গে মিশে গেছে। ঈশ্বরদীর পরিবেশ, মানুষ, খাদ্যসামগ্রী সম্পর্কে জানতে চাইলে রাশিয়ান কোম্পানি রোশেমের শ্রমিক এলরক্স বলেন, ‘ঈশ্বরদী অনেক ভালো লাগছে। এখানকার পরিবেশ, নদী, হার্ডিঞ্জ সেতু, লালন সেতু, রেলস্টেশন, এখানে বন্ধুদের সঙ্গে ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারি, শপিং করতে পারি; কোনো সমস্যাই হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার মানুষ ভালো, কোনো সমস্যা করে না। যে কোনো সহযোগিতা চাইলেই করে। এখানকার বাঙালি খাবার আমাদের অনেক পছন্দ।’
ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র ইসহাক আলী মালিথা বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পই বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এখানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। রূপপুরের নাম এখন আন্তর্জাতিক মহলে। রাশিয়ানদের পদচারণায় রূপপুর যেন একখ- রাশিয়াপল্লীতে বা মিনি রাশিয়ায় পরিণত হয়েছে।’ ঈশ্বরদী উপজেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, ‘অভাব-অনটনের কারণে আগে এসব গ্রামে প্রায়ই পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ দেনা-পাওনার নালিশসহ নানা ধরনের কলহ নিরসন করতে বিচার সালিশ করতে হতো। বেকারত্ব দূর হওয়ায় গ্রামে এখন আর সে পরিবেশ নেই। পারিবারিক, সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরেছে। হাজার হাজার মানুষের পদচারণা রয়েছে এখানে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন