বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকটে আছে। এই অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশ্বে পণ্যের বাজারে অস্থিরতা। আর এ কারণেই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে বারবার অর্থ পাচারের প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে গেছে বলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্রগুলো জানাচ্ছে। বাংলাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি জিএফআই এর তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের টাকা যদি পাচার হতে থাকে এবং এই পাচার যদি বন্ধ না করা যায় তাহলে যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি যে অর্থ পাচার হয়েছে সে অর্থগুলো উদ্ধার করাটাও বাংলাদেশের জন্য জরুরী। এ বছর ১৬ জুন ন্যাশনাল ব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ওই ব্যাংকে বাংলাদেশে টাকার পাহাড় জমেছে। ২০২১ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিলো ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্রাংক, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্রাংকের দাম ৯৫ টাকা হিসেবে)। আগের বছরের চেয়ে আমানত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। অর্থাৎ সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ টাকা যে পাচার হচ্ছে এটি কারো কোনো অজানা নয়। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড বলেছেন যে, সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বাংলাদেশীদের টাকা জমার বিষয়ে তথ্য পেতে বাংলাদেশকে চুক্তি করতে বলেছে সুইজারল্যান্ড। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি করেনি। এমনকি বাংলাদেশীদের টাকার বিষয়ে কোনো তথ্য জানতে চায়নি। এই বিষয়টি বাংলাদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এমনকি আজকে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রসঙ্গটি উঠেছে এবং হাইকোর্ট এ ব্যাপারে সরকার কি পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানতে চেয়েছে।
বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে, যখন আমাদের রিজার্ভে টান পড়েছে, যখন ডলার সংকট ঠিক সেইসময় কেন বাংলাদেশ পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে যথেষ্ট উদ্যোগী এবং উদ্যমী নয়, এই প্রশ্নটিই উঠেছে। এক বছর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আব্দুল মোমিন বলেছিলেন যে, আগে আমরা মনে করতাম যে বিদেশ সম্পদ বোধহয় রাজনীতিবিদরাই করেছেন। কিন্তু আমরা যে সমস্ত তথ্য পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, আমলাদের সম্পদ বেশি। কানাডায় বেগমপাড়ায় যে সমস্ত বাঙ্গালীদের বাড়িঘর রয়েছে তার অধিকাংশই আমলাদের। এমনকি শুধুমাত্র কানাডার বেগমপাড়ায় নয়, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বিভিন্ন আমলারা। আর এই কারণেই অর্থ পাচার রোধে আমলারা যথেষ্ট উদ্যোগী নন। বাংলাদেশে যে আইনগুলো আছে সেই আইনগুলোতে যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর রয়েছে। একই কারণে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারেও আমলারা তেমন কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং যারা অর্থ পাচার করেছে তাদের এক ধরনের দায়মোচন দেওয়ার চিন্তাভাবনা সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এই অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী পাচারকৃত অর্থ আনার জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রক এখন আমলারাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একজন আমলা অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয় এখন আমলারাই চালাচ্ছেন, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। এরকম বাস্তবতায় অর্থ উদ্ধারের জন্য যে ধরনের উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তা আমলারা ইচ্ছা করেই নিচ্ছেন না। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং এগুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে নানামুখী আলাপ-আলোচনা চলছে। এই সমস্ত আমলারা এখন অবসরে গেছেন কিন্তু অবসরে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। সে কারণেই সাধারণ মানুষ এমনকি রাজনীতিবিদরা মনে করছেন যে, আমলাদের কারণেই পাচার করা অর্থ উদ্ধারে শ্লথগতি তৈরি হয়েছে। কারণ, আমলারা অর্থ পাচারের অন্যতম সুবিধাভোগী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন