‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই)’ ও ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)’-এর মতো উদ্যোগে বাংলাদেশকে সঙ্গে চায় চীন। দেশটির স্টেট কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গতকাল রবিবার সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে তাইওয়ান, জিডিআই ও জিএসআইয়ের মতো চীনা উদ্যোগগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
ঢাকায় সোনারগাঁও হোটেলে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক। নিয়ম অনুযায়ী তাঁরা যেটা বলেছেন, তা জনসমক্ষে কতটা আনা হবে, সেটা তাঁদের বিষয়।
অবশ্যই এ ব্যাপারে (তাইওয়ান, জিডিআই ও জিএসআই) বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তাঁরা এসব বলেছেন। এটা আলোচনার বিষয় নয়। ’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকারে আরো অন্যান্য বিষয় আছে। তবে তাঁরা তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। ‘এক চীন’ নীতি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের জন্য তাঁরা ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমরা আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছি বলে তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ”
তাইওয়ান নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটি তাদের বিষয়। আমরা তো জানি যে তাইওয়ান ইস্যুতে তারা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মানার বিষয়টিতে জোর দেয়। তারা আমাদের কাছে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। ’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, চীন বিশ্বের সব রাষ্ট্রের জন্য একটি অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে পাশে চায়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কিছু রাষ্ট্র আছে, যারা ভুল বোঝে বা চীনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। ওই বিষয়ে কিছুটা কথা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তাইওয়ান ইস্যুতে বলেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উৎসাহিত করা হলে বিশ্বের কোথাও শান্তি থাকবে না।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাতে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওয়াং ই বলেছেন, বাংলাদেশের মতো চীনও দারিদ্র্য বিমোচন করে যাচ্ছে। চীনও উন্নতি করছে। এ কারণে কেউ কেউ চীনের ওপর অসন্তুষ্ট।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে বিশ্বের সব জায়গায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা দরকার। অনেকে উসকানি দেবে। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের এই সফর রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তাঁরা আরো অনেক অনেক দূরে নিতে যান। চীন সব সময় বাংলাদেশের সহযোগী হিসেবে থাকবে।
জিডিআই প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের উদ্যোগ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রায় ৭০টি দেশ জিডিআই নিয়ে তাদের ভাবনা জানিয়েছে। বাংলাদেশ এখনো কোনো বলয়ে যায়নি। বাংলাদেশ জিডিআইয়ে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব খতিয়ে দেখবে। জিএসআই নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীন অবকাঠামো, অর্থনৈতিক ও শিল্প পার্ক, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, সহযোগিতা, স্থানীয় মুদ্রায় দুই দেশের মধ্যে লেনদেন, ফাইভজি এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে সহযোগিতা জোরদারে সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ ও সমন্বয় অব্যাহত রাখবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, শক্তিশালী ও জোরালো কণ্ঠের চীনকে বিশ্বের প্রয়োজন।
চার চুক্তি-এমওইউ সই
ওয়াং ই গত শনিবার বিকেলে ঢাকায় আসেন। গতকাল সকালে তিনি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দুই দেশের প্রতিনিধিদলকে নিয়ে প্রাতরাশ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে চারটি চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। এগুলো হচ্ছে পিরোজপুরে অষ্টম বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতুর হস্তান্তর সনদ, দুর্যোগ মোকাবেলা সহায়তার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারকের নবায়ন, ২০২২-২৭ মেয়াদে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা সমঝোতা স্মারকের নবায়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চীনের ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশেনোগ্রাফির মধ্যে মেরিন সায়েন্স নিয়ে সমঝোতা স্মারক।
এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গণভবনে যান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর ঢাকা ছাড়েন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
শুল্কমুক্ত সুবিধা বাড়ছে
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘চীনের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার পরিধি আরো ১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। আমরা আশা করি, বাড়তি এই শতাংশে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাতের ওভেন প্রডাক্টসের যে সীমাবদ্ধতা ছিল, সেটা দূর হবে। ’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এ সফরে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অতিরিক্ত ১ শতাংশ পণ্য ও সেবা, যেটা আমাদের তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে। ’
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চীন আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে।
সম্ভাব্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক চুক্তির বিষয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা শুরুর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের কারখানা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরে সহায়তা করবেন বলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুত চালুর বিষয়ে বাংলাদেশকে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি জানান, আলোচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। বাণিজ্যবৈষম্য দূর করাটা আলোচনায় একটি বড় ইস্যু ছিল।
শিক্ষার্থীদের ভিসা চালু, ফেরার সুযোগ
চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) সংক্রান্ত চীনা বিধি-নিষেধের কারণে যেতে পারছিলেন না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি বৈঠকে তুলে ধরা হয়। ঢাকায় চীনের মিশন উপপ্রধান হুয়ালং ইয়ান বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে জানান, এই মুহূর্ত থেকেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চীনে ফিরতে পারবেন। বৈঠক থেকেই তাঁরা চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসা চালুর ঘোষণা দেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন