পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকা। সংযোগ সড়কের নিচেই টিনের ছাউনি ও বেড়ায় ঘেরা ছোট্ট একটা দোকান। সামনে ঝুলছে এক টুকরো মোটা কাগজ। যেখানে কাঁচা হাতে লেখা- গরুর খাঁটি দুধের চা পাওয়া যায়। দোকানে বেশ ভিড়। বেশিরভাগ ক্রেতাই সংযোগ সড়কে ঘুরতে এসেছেন। দোকানদারের নাম ইব্রাহিম হাওলাদার। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা। পান খাওয়া লাল ঠোঁট। একের পর এক চা বানিয়ে যাচ্ছেন। দোকানের ভেতরে বসা ইব্রাহিম হাওলাদারের স্ত্রী সুফিয়া বেগম। তিনি খুঁটিনাটি পণ্য ক্রেতাদের এগিয়ে দিয়ে স্বামীকে সাহায্য করছেন।
দীর্ঘ দুই দশক পর নিজভূমে ফিরে ইব্রাহিম হাওলাদার ছোট্ট দোকান দিয়ে শুরু করেছেন নতুন জীবন। প্রায় ২০ বছর আগের এক সকালে দুঃস্বপ্নের মতো নিজের বসতভিটা, গবাদিপশু, চাষের জমি বিলীন হয় পদ্মার গর্ভে। এর পর জীবন ও জীবিকার তাগিদে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন রাজধানীর অলি-গলিতে। কখনো প্লাস্টিকের কারখানার শ্রমিক, কখনো কারওয়ানবাজারের আড়তে কর্মচারী, কখনো আবার রিকশার প্যাডেলে জীবনের চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করেছেন। এভাবে জীবিকা করে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ঢাকায় মোটর মেকানিকের কাজ করেন। এখন বয়স বেড়েছে, ভারী কাজ করতে পারেন না। ছয় মাস আগে ফিরেছেন গ্রামে। চার কাঠা জমি কিনেছেন, টিনের ঘর উঠেছে সেখানে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ছেলেকেও গ্রামে নিয়ে আসবেন। মোটর গ্যারেজ দেবেন পাশেই। একসঙ্গে থাকবেন। শৈশবের চিরচেনা মুখ, স্বজনদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় পার করতে চান বাকিটা জীবন।
কেবলই একজন ইব্রাহীম হাওলাদারের গল্পই এমন নয়। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা, বিশেষ করে মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর জেলার মানুষের মধ্যে এখন এমন পরিবর্তনের উন্মাদনা। ‘সব হারানো’ অনেক মানুষ ফিরতে চান গ্রামে। অনেকেই জড়িয়েছেন ছোটখাটো ব্যবসায়। তুলনামূলক সচ্ছলরা ঝুঁকছেন ছোট ছোট কারখানার দিকে। পদ্মার পার ঘেঁষে যেন এক অন্যরকম গল্পের অবতারণা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে পদ্মার দুই পারে। পদ্মা সেতু ঘিরে এখানেই সম্ভাবনার আরেক বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। উন্নয়নের আরেক বাংলাদেশও দেখাচ্ছে নতুন দিনের স্বপ্ন।
মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে পদ্মা নদীর দুই প্রান্তকে যুক্ত করছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসের শেষ দিকে উদ্বোধনের তোড়জোড় চলছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এ সেতুর ওপর দিয়ে চার লেন দিয়ে চলবে গাড়ি, নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুর তলদেশ দিয়ে যে কোনো ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারবে অনায়াসেই। সেতু দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন, যে লাইন দিয়ে গ্যাস পৌঁছবে এ জনপদসহ আশপাশের অনেক জেলায়।
এদিকে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নয়নমূলক মহাকর্মযজ্ঞ চলছে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোয়। পদ্মা সেতু ঘিরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যেসব প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেখে জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন এক সময়কার অবহেলিত এ জনপদের মানুষ।
সরেজমিন পদ্মাপারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে উন্নয়নের উন্মাদনা। আশপাশের এসব এলাকায় জমির দাম যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনই বেড়েছে স্থাপনাও। জাজিরার ঐতিহ্যবাহী কাজিরহাট বাজারের ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, আগে এসব এলাকার জমির দাম কম ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পাল্লা দিয়ে জমির দাম বাড়ছে। বর্তমানে এক বিঘা জমির দাম স্থানভেদে পঞ্চাশ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত। অনেকে বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি কিনে রেখেছেন। স্থানীয় মানুষজনও নানামুখী ব্যবসার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
জাজিরা পৌরসভা এলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম। ঢাকায় সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করেন দীর্ঘদিন। তার ইচ্ছা নিজেই একদিন কারখানার মালিক হবেন। কিন্তু ঢাকায় কারখানার জায়গার ভাড়া ও অগ্রিম অনেক বেশি। তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরই তিনি গ্রামে চলে যাবেন। জাজিরা এলাকায়ই দেবেন কারখানা।
একই কথা বললেন সদ্য মধ্যপ্রাচ্য ফেরত নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘আর বিদেশে যাব না। একজন ব্যবসায়ী এলাকায় হিমাগার তৈরি করবেন। ইতোমধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ওইটা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। তাই আর বিদেশ থাকব না। দেশেই তো কাজের সুযোগ আছে।’
এর বাইরেও শিবচর, জাজিরা, নড়িয়া, ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন উপজেলায় বড় বড় শিল্প গ্রুপ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি কিনে রেখেছেন। অনেক স্থানে তৈরি হচ্ছে পার্ক-রিসোর্ট। এ ছাড়া নদীভাঙন ঠেকাতেও নড়িয়া, জাজিরা, শিবচরসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নড়িয়ায় ভাঙন ঠেকাতে তৈরি হওয়া বেড়িবাঁধে পর্যটকরা নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় করছেন প্রতিদিন। শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলায় তৈরি হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবায় স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে নির্মাণ হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় তাঁতশিল্প ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী’। পদ্মা সেতু এলাকায় এ তাঁতপল্লীর প্রথম পর্যায়ে মাটি ভরাট ও সীমানা প্রাচীরের কাজ শেষ হবে ৩০ জুনের মধ্যে। এ শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে অন্তত ১০ লাখ মানুষের। এমন খবরে খুশি স্থানীয় বাসিন্দারাও। কর্মসংস্থানের স্বপ্ন বুনছেন তারা।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এক হাজার ৯১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। পদ্মা সেতুর শরীয়তপুর প্রান্তের রেলস্টেশনের কাছাকাছি নির্মাণ হচ্ছে এ তাঁতপল্লী, যাতে করে তাঁতিরা কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য সহজে আনা-নেওয়া করতে পারেন।
শরীয়তপুর জেলার জাজিরার নাওডোবা ইউনিয়নের নাওডোবা মৌজায় ৫৯ দশমিক ৭৩ একর ও মাদারীপুর জেলার শিবচরের কুতুবপুর মৌজায় ৬০ একর করে ১১৯ দশমিক ৭৩ একর জমিতে এ তাঁতপল্লী হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় তাঁতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কলকারখানার পাশাপাশি কর্মরত তাঁতিদের জন্য থাকছে আবাসন ব্যবস্থাও। প্রকল্পের আওতায় ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড নির্মাণ হবে। যেখানে ৮ হাজার ৬৪ তাঁতিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। বার্ষিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৩১ কোটি মিটার কাপড়।
নাওডোবা এলাকার কৃষক আলতাফ মিয়া। পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস ঝরল তার কথায়। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ পুরো এলাকাই বদলে গেল। প্রত্যন্ত এ এলাকায় তেমন চোখে পড়া কোনো সরকারি স্থাপনা নেই। রাস্তাঘাট ভালো নয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পরই পাল্টে যেতে থাকে এলাকার মানচিত্র। এখানে নির্মাণ হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় তাঁতপল্লী। এখনই পদ্মা সেতু দেখতে পর্যটকরা ভিড় করছেন আমাদের এলাকায়।’
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মাপারে শুধু এ তাঁতপল্লীই নয়, হবে আইটি পার্কও। ইতোমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় আইটি পার্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিবচরের কুতুবপুরের কেশবপুরে ‘শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি অ্যান্ড হাইটেক পার্ক’ নির্মাণে ৭০ একর জায়গা নির্ধারণ করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। প্রকল্প পাস হলেই ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হবে। এর বাইরে আরও অনেক ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট অ্যান্ড কলেজ, আইএইচটি ভবন, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, মুক্তমঞ্চ ও অলিম্পিক ভিলেজ। সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তোলা হবে বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও আইকন টাওয়ার। ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীর (দাদা ভাই) নামে শিবচর উপজেলায় ‘দাদা ভাই উপশহর’ হাউজিং প্রকল্পের প্লট প্রস্তুতির কাজ ও বরাদ্দ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু বহুতল ভবন হয়েছে এবং সেগুলোতে মানুষ বসবাস করা শুরু করেছে। প্রায় ১০৫ একর জমিতে গড়ে ওঠা এ প্রকল্পে ১ লাখের বেশি মানুষের আবাসন হবে।
এ ছাড়া পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় সেতুর দুই প্রান্তে পদ্মা সেতু উত্তর থানা ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা নামে দুটি থানা স্থাপন করা হয়েছে। সেতুর জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার আওতায় থাকবে পূর্ব নাওডোবা ও পশ্চিম নাওডোবা নামে দুটি ইউনিয়ন। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু উত্তর থানার আওতায় থাকবে মেদিনীম-ল ও কুমারভোগ নামে দুটি ইউনিয়ন।
পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার জন্য জাজিরা প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস। গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সেনানিবাস উদ্বোধন করেন। ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’-এর আলোকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান সোহেল দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, জাজিরাসহ আশপাশের এলাকায় বিস্তৃর্ণ কৃষি জমি রয়েছে। এখানে মূলত মসলাজাতীয় পণ্য ও শাকসবজির চাষ হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এতদিন কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতেন না। পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের কৃষি ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি কৃষকরা ন্যায্য দামও পাবেন।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের উদ্যেক্তা হিসেবে তৈরি ও স্বাবলম্বী করে তুলতে যুব উন্নয়নের মাধ্যমে দুই মাস মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, চরাঞ্চল হওয়ায় এ অঞ্চল দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। তবে এখন সর্বত্র পরিবর্তনের ঢেউ। নগরায়ণ হচ্ছে, গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। অনেকে ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন। নানা কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন