কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। আজ সোমবার কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি দাবি করেন, সিনহা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন।
আদালতকে প্রদীপ কুমার দাশ বলেছেন, তাঁর (ওসি প্রদীপ) বিরুদ্ধে যাঁরা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সুবিধাভোগী। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী তিনি টেকনাফে মাদক নির্মূলে ভূমিকা রেখেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন। সিনহা হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। বরং পরিকল্পিতভাবেই তাঁকে (প্রদীপ) সিনহা হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এই হত্যার দায় তিনি নেবেন না।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আজ সকাল সোয়া ১০টার দিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়া শুরু হয়। এরপর দুপুরে ১ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ১৫ জন আসামির মধ্যে ১৪ জনের সাফাই সাক্ষ্য দেন। আসামিদের সাক্ষ্য নেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সরকার কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম। আদালত পরিচালনা করেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
আইনজীবী ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৪ জন আসামির সাফাই সাক্ষ্য আজ শেষ হয়েছে। সবাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না দাবি করে বলেন, পরিকল্পিতভাবে তাঁদের (আসামিদের) সিনহা হত্যা মামলার জড়িত করা হয়েছে। এর দায় থেকে তাঁরা অব্যাহতি চেয়েছেন। এর আগে অষ্টম দফায় ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। কাল মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) আসামি নন্দদুলাল রক্ষিতের সাফাই সাক্ষী গ্রহণ করা হবে।
আইনজীবীরা বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাফাই সাক্ষ্য দিতে আসেন সিনহা হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলী। ৬৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দিতে উল্লেখ ছিল, ওসি প্রদীপের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে খুন হন সিনহা মো. রাশেদ খান। কিন্তু সাফাই সাক্ষ্য দিতে গিয়ে পরিদর্শক লিয়াকত আলী আদালতকে বলেন, সিনহাকে তিনি (লিয়াকত) গুলি করেননি। হত্যাকাণ্ডের অপরাধেও তিনি যুক্ত নন। হত্যার দায় স্বীকার করে ইতিমধ্যে আদালতে তিনি যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন, আদালতে তা–ও অস্বীকার করে লিয়াকত আলী বলেন, এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তাঁর না, তিনি আদালতে জবানবন্দি দেননি।
এরপর সাফাই সাক্ষী দিতে আসেন বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। শুরুতে তিনি টেকনাফে মাদক নির্মূলে সরকারি শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা, মাদকবিরোধী অভিযানের কথা তুলে ধরে বলেন, সিনহা হত্যার সঙ্গে তিনি কোনোভাবে জড়িত নন। সিনহা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁকে (প্রদীপ) জড়িত করে আদালতে যাঁরা ইতিমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সুবিধাভোগী লোকজন।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রদীপকে জিজ্ঞাসা করেন, সাক্ষীদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, মসজিদের ইমামরাও ছিলেন, তাঁরাও কী ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন? তখন প্রদীপ কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। তারপর বলেন, ইয়াবা সিন্ডিকেট মিলে তাঁকে সিনহা হত্যা মামলার আসামি বানিয়েছে। তিনি এই হত্যার দায় নিতে রাজি না।
আইনজীবীরা বলেন, প্রথম দফায় গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে এ মামলার সাক্ষ্য দেন দুজন। তাঁরা হলেন মামলার বাদী ও সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এবং ২ নম্বর সাক্ষী ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে গাড়িতে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাত। দ্বিতীয় দফার ৪ দিনে সাক্ষ্য নেওয়া হয় ৪ জনের, তৃতীয় দফার ৩ দিনে ৮ জন, চতুর্থ দফার ২ দিনে ৬ জন, পঞ্চম দফার ৩ দিনে ১৫ জন, ষষ্ট দফায় ৩ দিনে ২৪ জন, সপ্তম দফার ৩ দিনে ৫ জন এবং অষ্টম দফার ৩ দিনে ১ জনের (তদন্তকারী কর্মকর্তা) সাক্ষ্য নেওয়া হয়। নবম দফায় গত ২ দিনে ১৪ জন আসামির সাফাই সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করে। ঘটনার পাঁচ দিন পর, অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন