অনিয়মের কবল থেকে বের হতে পারছে না দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো। একের পর এক সমালোচনার পরও শোধরাচ্ছে না প্রকল্প প্রণয়নে অনিয়ম। ২০১৮ সাল থেকে চলছে চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্পের প্রস্তাবনা। যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দেয়া মূল্য বাজারের দরের সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ প্রস্তাবনায় নেই। জনবল নির্ধারণেও নেয়া হয়নি অর্থ বিভাগের অনুমোদন। তখন এক বছর পার করে ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধিত ডিপিপি পাঠিয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক বিভাগ থেকে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী, চাঁদপুর চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জনবহুল জেলা হওয়া সত্ত্বেও চাঁদপুরবাসী স্বাস্থ্যসেবার জন্য নোয়াখালী জেলার টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। গত ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চাঁদপুরের নবজাতক মৃত্যুহার সাড়ে ২৫ শতাংশ। পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। পাশাপাশি এই জেলার রোগ এবং দুর্যোগ সংক্রান্ত কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধীর হার শতকরা ১২ দশমিক ২ শতাংশ। চাঁদপুর জেলার স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য ২০১০ সালের ২৭ আগস্ট চাঁদপুরে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী চাঁদপুরে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি প্রদানের আলোকে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, ৩০.১২ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, আসবাবপত্র সংগ্রহ, যানবাহন ক্রয়, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয়, প্রশিক্ষণ এবং জনবল নিয়োগ করা।
কার্যপত্রে বলা হয়েছে, আগের ডিপিপিতে অনাবাসিক ভবন খাতে ৬৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও পুনর্গঠিত ডিপিপিতে ২২৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আগের পিইসি সভা ও ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ সভার সিদ্ধান্ত না থাকার পরও নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন বিভিন্ন খাতে বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবাসিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ৫২৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা করা হয়েছে।
আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ইউনিট-প্রতি মূল্যে অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে। আর যন্ত্রপাতিগুলো হলো- নেবুলাইজার মেশিন, পিক ফ্লো মিটার, গ্লুকো মিটার, কার্ডিয়াক মনিটর ডেফ্রিবিলাটরসহ, ইসিজি মেশিন চ্যানেল-১২, রোগীর এক্সামিনেশন টেবিল, ভিউ বক্স, এক্সরে ডাবল, পালস অক্সিমিটার, ট্রলি, মেডিসিন, ফুল সাচিবিক টেবিল ইত্যাদি।
হাসপাতালের জন্য সমন্বিত তালিকায় পৃথকভাবে প্রস্তাব করা সত্ত্বেও গাইনি ও অবস বিভাগের জন্য দু’টি হুইল চেয়ার ও ১০টি পালস অক্সিমিটার, নিউরোলজি বিভাগের জন্য একটি ইনফিউশন পাম্প এবং নার্সিং কলেজের জন্য ২০টি বিপি মেশিন ও ২২টি স্টেথোস্কোপের সংস্থান রাখা হয়েছে। সমন্বিত তালিকা থেকে দেখা যায় যে, হাসপাতালের জন্য কোনো হসপিটাল বেডের সংস্থান রাখা হয়নি।
খরচের বিভাজন থেকে দেখা যায়, হাসপাতালের আসবাবপত্রের আওতায় সোফা সেট ৫২ হাজার টাকা থেকে এখন ৭০ হাজার টাকা, কনফারেন্স টেবিল এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৯৫ হাজার টাকা, মিট সেফ ১২ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং কলেজের আসবাবপত্রের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ব্যয় বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। ইমার্জেন্সি বা রিসুসিটেশন কার্ট এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা, ডিজিটাল এক্সরে ৭৫ লাখ টাকা থেকে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা, হাই গ্রেড ডিজিটাল মামোগ্রাফি মেশিন এক লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান বলছেন, প্রকল্পে জনবল সংক্রান্ত অর্থ বিভাগের সুপারিশে আউট সোর্সিং খাতে তিনজনের সংস্থান রয়েছে; কিন্তু এখানে ব্যয়ের সংস্থান রাখা হয়েছে পাঁচজনের। সর্বশেষ পিইসি সভায় উপস্থাপিত ডিপিপি অপেক্ষা ব্যয় ২৪ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন পরিকল্পনা বিভাগের এসইসি-একনেক ও সমন্বয় অনুবিভাগের ফরমেট মোতাবেক যথাযথ হয়নি। কমিশন বলছে, পরামর্শক খাতে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে ফিক্সড বাজেট উল্লেখ করা হয়েছে, যা কোনো ক্রয় পদ্ধতির আওতায় পড়ে না। দরপত্র আহ্বান, চুক্তি স্বাক্ষর ও সম্পাদনের তারিখ প্রকল্পের প্রস্তাবিত বাস্তবায়নকালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হালনাগাদ করতে হবে।
অতিরিক্ত সচিব তার মন্তব্যে বলেছেন, ক্রয়কালীন বাজারদর অনুযায়ী যন্ত্রপাতি কেনা হবে- উল্লেখ থাকলেও এর সপক্ষে প্রমাণ নেই। প্রকল্পের আওতায় কাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে তা স্পষ্ট করতে হবে। প্রকল্পটি ২০১৯ সালে অনুমোদন পেলে শুরু করতে পারত; কিন্তু ডিপিপিতে ত্রুটি ও অসামঞ্জস্যতার কারণে সেটি পিছিয়েই যাচ্ছে। দুদফা পিইসিতে প্রকল্প সে আলোকে সংশোধন করা হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন যুক্ত না থাকায় চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পত্রের মাধ্যমে তা যুক্ত করার জন্য বলা হয়; কিন্তু সেই পুনর্গঠিত ডিপিপি প্রায় এক বছর পর হাতে পায় কমিশন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন