অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিকশিত বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনায় দাগ লাগিয়ে দিয়েছে গুটিকয়েক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। ফলে আরো ঘনীভূত হয়েছে আস্থার সংকট। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অপকর্মে ঝুঁকিতে পড়েছেন কয়েক লাখ নতুন উদ্যোক্তা। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা সম্ভাবনাময় খাতটি হঠাৎ করেই স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধারে বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি নজরদারি বৃদ্ধির তাগিদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
অনলাইনে ব্যবসা করছে—এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জোট ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে আনুমানিক আড়াই হাজার ই-কমার্স সাইট রয়েছে। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন অন্তত পৌনে দুই লাখ উদ্যোক্তা। অল্পদিনেই ই-কমার্স খাতের ব্যবসাটি দেশের অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে বহু মানুষকে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেওয়া তথ্য বলছে, বিশাল এই খাতের মূলে কুঠারাঘাত করেছে গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত। বিভিন্ন সময়ে এমএলএম কম্পানি, মাল্টিপারপাস বা সমবায় সমিতির নাম দিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার বহু নজির ছিল। যোগ হলো ই-প্রতারণা। চলতি বছর অন্তত ১১টি প্রতিষ্ঠানের নাম সামনে আসে, যারা গ্রাহকের কাছে টোপ ফেলে হাতিয়ে নিয়েছে তিন হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। তারা আঘাত করেছে কয়েক লাখ উদ্যোক্তার তিলে তিলে অর্জিত সুনাম ও গ্রাহকের আস্থায়।
kalerkantho
গ্রাহকের অর্থ লোপাটকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই বয়সে নবীন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বয়স এক বছরও পূর্ণ হয়নি। প্রতিষ্ঠার মাত্র আট মাসেই গ্রাহকের ৮০৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘ধামাকা’। প্রতিষ্ঠার মাত্র ১০ মাসে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামের এক প্রতিষ্ঠান। বহুল আলোচিত ইভ্যালির বয়সও তিন বছর হয়নি। ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা কম্পানিটি এরই মধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। ই-অরেঞ্জের বয়স হলেও ই-কমার্স ব্যবসায় ডালপালা মেলেছে অল্প কিছুদিন হলো। এতেই লোপাট করেছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর বাইরে নামসর্বস্ব আরো কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো গ্রাহকের সঙ্গে ঠিকমতো পরিচিত হওয়ার আগেই অবিশ্বাস্য মূল্যছাড় দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের উদাহরণ টেনে বলছেন, বৈশ্বিক এই প্রতিষ্ঠান রাতারাতি অর্থ উপার্জনের চিন্তা করেনি বলেই এর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের এক নম্বর ধনীর তালিকায় উঠে আসেন। মাত্র দুই দশক আগে সাধারণ এক উদ্যোক্তা ছিলেন জেফ বেজস। কিন্তু তিনি সে সময় বুঝতে পেরেছিলেন, এমন এক সময় আসবে, যখন কম্পিউটার বা মোবাইলে এক ক্লিকেই কেনা যাবে যেকোনো কিছুই। শপিং মলের জনপ্রিয়তা কমে যাবে, দোকানপাট নানা অফার দিতে বাধ্য হবে। ফলে গেছে বেজসের দিব্যদৃষ্টি। এখন এক ক্লিকেই মিলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। শপিং মল বা রেস্তোরাঁর বদলে মানুষ ঘরে বসেই পছন্দের খাবার পাচ্ছে। ওষুধ, পোশাক, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা চলছে অনলাইনে। পোশাক, গয়না, খাবার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, কসমেটিকস, সবজিসহ সব কিছুই মিলছে। ক্রমেই ই-বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়ছে ভোক্তারা।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে ই-কমার্সের বাজার ডানা মেলতে শুরু করে বছর পাঁচেক আগে। সর্বশেষ তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০০ ভাগ। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে খাতটি। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গত বছরের মার্চে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ই-বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে। বর্তমানে এ খাতের আকার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের মধ্যে এটি ২৫ হাজার কোটির মাইলফলক ছুঁয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়।
এ সম্ভাবনার মধ্যেই গত কয়েক মাসে টালমাটাল হয়ে গেছে খাতটি। বিশেষ করে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও ধামাকার প্রতারণার মধ্য দিয়ে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। গ্রাহক ও মার্চেন্টের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং তাঁর স্ত্রী কম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিআইডি সূত্র জানায়, মাত্র আড়াই বছরে দেশের ই-কমার্স খাতকে ওলটপালট করে দেওয়ার অন্যতম হোতা এই প্রতিষ্ঠান।
ইভ্যালির প্রতারণার ফাঁদ ছিল ‘সাইক্লোন’, ‘থান্ডারস্টর্ম’ নামক অবিশ্বাস্য মূল্যছাড়। এ কারণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইভ্যালি একটি লোকসানি কম্পানি ছিল—এমনটাই মনে করেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ইভ্যালি কোনো ব্যাবসায়িক লাভ এ যাবৎ করতে পারেনি। গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই ইভ্যালি চলত। রাসেল তাঁর কোম্পানির ব্যয়, বেতন ও নিজস্ব খরচ নির্বাহ করতেন। ক্রমেই তাঁর দায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ই-বাণিজ্যের এই অস্থির পরিস্থিতিতে আস্থার সংকটের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘দেশে বর্তমানে ৩০ হাজার অনলাইন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০-১২টির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তাই সামগ্রিকভাবে অনলাইন প্রতিষ্ঠানকে খারাপ বলা যাবে না। এর আগে আমরা দেখেছি, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কাজে লাগানো হয়নি। সেগুলো অন্যরা ভোগদখলে রেখেছে। অথচ গ্রাহক তাঁদের পাওনা বুঝে পাননি। ইভ্যালির ক্ষেত্রেও যেন এমনটা না হয় সে জন্য গ্রাহকদের টাকা ফেরতের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।’ গতকাল বুধবার এক অনলাইন মেলার আয়োজন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় মন্ত্রী আরো বলেন, ‘অর্থ লোপাটকারীদের জেলে পাঠানো সমাধান নয়। গ্রাহকরা যেন তাঁদের টাকা ফেরত পান, আবার অভিযুক্তরাও যেন শাস্তি পান—উভয় বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে সরকার। আমরা সার্বিক বিষয়গুলো অবজারভেশন করছি। আমরাসহ চার মন্ত্রণালয় (অর্থ, বাণিজ্য, আইন ও স্বরাষ্ট্র) বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। তাদের অবস্থান নির্ণয় করা হচ্ছে।’
প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইভ্যালি একটি ঈদ ধামাকা অফার দিয়েছিল। তখনই সন্দেহ হয়েছিল, তাদের অবিশ্বাস্য মূল্যছাড়ের পেছনের আসল কাহিনি কী। তাদের বিরুদ্ধে আমরাই প্রথম মামলা করেছি। এখন তো সব কিছু স্পষ্ট।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইভ্যালির যে দেনা রয়েছে, সেখান থেকে গ্রাহকদের কিভাবে নিরাপদে বের করে আনা যায় সেটাই এখন মুখ্য বিষয়।
ই-ক্যাব সভাপতি শমী কাওসার কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার কারণে অনলাইন মার্কেট দ্রুত বাড়ছে। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কারণে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা উদ্যোক্তাদের সুনাম ভেস্তে যেতে পারে না। তিনি আরো বলেন, ভোক্তারা ই-কমার্স বিজনেসের ক্ষেত্রে ঠকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য দেশে আইনও আছে। ইভ্যালি সে আইন না মেনেই ব্যবসা করেছে। এ জন্য গ্রাহকদের বিশাল অঙ্কের টাকার অর্ডার এখন অনিশ্চয়তায়।
অফারের ফাঁদে পা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলবেন না। দেশে ই-কমার্স ব্যবসায় আইন আছে। আইনের বাইরে গিয়ে যারা ব্যবসা করবে সেখানে ঝুঁকিও থাকবে, এটি মাথায় রাখা উচিত। এতে করে গ্রাহকের মাঝে অনাস্থার সৃষ্টি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নতুন উদ্যোক্তারা।
সূত্র জানায়, দেশের ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় কিছুদিন আগে নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোনো পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবেন। সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কম্পানি পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব নির্দেশনা এখনো শুধুই কাগজে-কলমে!
kalerkantho
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন