১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। আজ থেকে ৪০ বছর আগে এই দিনটিতে বাংলাদেশের প্রথম ওপেন হার্ট অপারেশন সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাদেশি ও জাপানি সার্জনদের একটি যৌথ টিম এই অপারেশনের মাধ্যমে এদেশের হৃদরোগ চিকিৎসায় এক নবযুগের সূচনা করেছিল।
হার্টের চিকিৎসার উন্নতি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বিশাল এক অর্জন। বিগত চার দশকে দেশের এ অর্জনের পেছনে এদেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সার্জনগণের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ ছিল সে অর্জনের পথে এক প্রধান মাইল ফলক।
হার্ট বা হৃদপিণ্ড মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অঙ্গ। মাতৃজঠরে ৬ সপ্তাহ বয়স থেকে ভ্রূণের হৃদপিণ্ড কাজ করা আরম্ভ করে। এক মহূর্ত না থেমে এই অঙ্গটি আজীবন সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন চালিয়ে যায়। কোনো কারণে কারো হার্ট যদি তিন মিনিট রক্ত পাম্প করা বন্ধ রাখে, তবে মস্তিষ্কের কোষগুলোর মৃত্যু আরম্ভ হয়। খুব দ্রুত অন্যান্য অঙ্গগুলোরও ক্ষতি আরম্ভ হয় এবং এক সময়ে মানুষটির মৃত্যু ঘটে। চলন্ত হার্টের অপারেশন করা কঠিন, বিপজ্জনক এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। বহুকাল ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাই হার্টকে অপারেশনের জন্যে অধরা এক অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর সার্জারি বিষয়ের গুরুদেব থিওডোর বিলরথ সেজন্যে বলেছিলেন, 'Any surgeon who dares to touch the heart of his patient would lose the respect of his colleagues.' অর্থাৎ হার্টকে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখানো সার্জন তার সহকর্মীদের শ্রদ্ধা হারাবে। তবে তার এই সতর্কবার্তায় অন্যেরা উৎসাহ হারাননি। হার্টের নিরাপদ অপারেশনের পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন সার্জনরা। জন হেইশ্যাম গিবন নামের এক আমেরিকান সার্জন তার নিজের উদ্ভাবিত হার্ট-লাং মেশিন দিয়ে ১৯৫৩ সালের ৬ মে সিসিলিয়া বাভোলেক নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর হৃদপিণ্ডে বিশ্বের প্রথম সফল ওপেন হার্ট অপারেশনটি করেন। হার্টকে থামিয়ে হার্ট-লাংস মেশিন নামের এক বিশেষ যন্তের সাহায্যে অপারেশনের সময়ে সারা শরীরে রক্তে ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে এই পদ্ধতিতে হার্টের অপারেশনকেই সহজ কথায় ওপেন হার্ট সার্জারি বলা হয়। এই যুগান্তরী ঘটনার ২৮ বছর পরে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের প্রথম ওপেন হার্ট অপারেশন সম্পন্ন করা হয়।
বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসার ইতিহাস বেশি প্রাচীন নয়। ষাটের দশকের শেষদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনে Institute of Post Graduate Medicine and Research (IPGMR) বা পিজি হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে সেখানে নামেমাত্র কার্ডিওলজি এবং কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিংবদন্তী সার্জন আলী আশরাফ সার্জারির অধ্যাপক পদে যোগ দিয়ে সেখানে ক্লোজড হার্ট অপারেশন চালু করার চেষ্টা চালান। উপযুক্ত পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই এই দুঃসাহসী সার্জন সেখানে কিছু হার্টের অপারেশন সম্পন্ন করেন। সম্প্রতি প্রয়াত সেনাবাহিনীর একজন সার্জন মেজর জেনারেল আব্দুল মোহাইমেন কাছাকাছি সময়েই তৎকালীন টিবি হাসপাতাল নামে খ্যাত বর্তমানের জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে নিজ উদ্যোগে কিছু ক্লোজড হার্ট অপারেশন সম্পন্ন করেন। এ সময়ের অপারেশনগুলো মূলত ছিল হার্টের মাইট্রাল ভাল্ভের (Closed mitral Commissurotomy CMC)।
স্বাধীনতার পর শাহবাগ হোটেলের পরিত্যক্ত ভবনে পিজি হাসপাতাল স্থানান্তর হলে হার্টের চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে সেখানে নিয়ে আসা হয়। শোনা যায়, স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেশের একজন খ্যাতনামা মেডিসিনের অধ্যাপকের উদ্যোগে কক্সবাজারের এক মিশনারি হাসপাতালে কর্মরত একজন বিদেশি সার্জনের দ্বারা একটি ক্লোজড হার্ট অপারেশনের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি এবং অপারেশন টেবিলেই রোগীর মৃত্যু ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চট্টগ্রামকে হার্ট অপারেশন চালু করার জন্যে আরো তিন যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ হলেও ১৯৭৮ সালে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট বা Institute of Cardiovascular Disease (ICVD) প্রতিষ্ঠার পরেই কেবল বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে হার্টের চিকিৎসা ও অপারেশন আরম্ভ হয়। স্বাধীনতার পূর্বে সেকেন্ড ক্যাপিটাল অর্থাৎ বর্তমান শেরেবাংলানগর এলাকায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আইয়ুব জেনারেল হাসপাতাল একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর এর নামকরণ করা হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল। সে সময়ে সেনাবাহিনীতে কর্মরত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কর্নেল আব্দুল মালেকের তত্বাবধানে এই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ভবনের পূর্বাংশের তিনটি ব্লক নিয়ে ১৯৭৮ সালে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হল। পরবর্তীকালে এর নামকরণ করা হয়েছে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল বা National Institute of Cardiovascular Disease (NICVD)। কর্নেল মালেক ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। অধ্যাপক এম নবী আলম খান হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে প্রথম সার্জারি বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন। ওই সময় বেশ কিছু দক্ষ, প্রশিক্ষিত এবং প্রতিভাবান প্রবাসী চিকিৎসক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রবাসজীবন, বিশেষত বিলেতের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ছেড়ে দেশে ফিরেছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন ডা. সিরাজুর রহমান খান, যিনি এস আর খান নামেই বিশেষ পরিচিত। তিনি লন্ডন থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা ফিরে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ সার্জন হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপক নবী আলম খান এবং অধ্যাপক এস আর খান তাদের ব্যাক্তিগত বন্ধুত্ব এবং পেশাগত প্রতিযোগিতার জন্য সব মহলে আলোচিত ছিলেন। সপ্তাহে তিন দিন হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এবং বাকি তিন দিন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে তারা সে সময়ে কাজ করতেন।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউটকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে সে সময়ে জাইকার (JICA, Japan International Cooperation Agency) উদ্যোগে জাপানী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের একটি দল লম্বা সময়ের জন্য ঢাকায় অবস্থান করেন এবং বাংলাদেশি কার্ডিওলজিস্ট, সার্জন, অ্যানেসথেটিস্ট, নার্স, টেকনিশিয়ান এমনকি ক্লিনারদের হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। জাইকা বেশ কিছু বাংলাদেশি ডাক্তার, নার্সদের জাপানে নিয়ে গিয়েও স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। এভাবে ধীরে ধীরে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অবশেষে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ তারিখে এলো সেই বিশেষ ক্ষণ। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থেকে আসা জন্মগত হৃদরোগ Atrial Septal Defect (ASD) আক্রান্ত ১৮ বছরের এক কলেজ ছাত্রের ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পন্ন হল। সার্জিক্যাল টিমে ছিলেন জাপানী সার্জন কোমে সাজি, অধ্যাপক এম নবী আলম খান, অধ্যাপক এস আর খান এবং ডা. মিনহাজউদ্দিন। অধ্যাপক খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে এনেস্থেশিয়া টীমে ছিলেন ডা. নুরুল ইসলাম, ডা. এ ওয়াই এফ এলাহি চৌধুরী। আরেকজন জাপানী সার্জন ডা. টোমিনো এবং হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সে সময়ের আবাসিক সার্জন ডা. ফজলুর রহমান পারফিউশনিস্ট হিসেবে হার্ট লাং মেশিন পরিচালনা করেন। সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আব্দুল মালেক। কার্ডিওলজি বিভাগের পক্ষে অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করেছিলেন সে সময়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. এম নজরুল ইসলাম, সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. এম মহিবুল্লাহ এবং ডা. নাসিরউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীকালে কার্ডিয়াক সার্জন এবং বিভাগীয় প্রধান)। উল্লেখ্য, ডা. এম নজরুল ইসলাম, ডা. এম মহিবুল্লাহ এবং ডা. এ ওয়াই এফ এলাহি চৌধুরী এরা তিনজনেই পরবর্তীতে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
অপারেশনটি সেদিন সুন্দর ভাবেই শেষ হয়েছিল। ক্রস ক্ল্যাম্প টাইম অর্থাৎ হার্ট পুরোপুরি বন্ধ ছিল ২৭ মিনিট। বাংলাদেশী ও জাপানী সার্জনদের যৌথ টিম হৃদপিণ্ডের ত্রুটিটি সাফল্যের সাথে মেরামত করেন। রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। আইসিইউতে অবস্থানকালে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি সত্বেও রোগী সুস্থ্য হয়ে বাড়ি যান এবং পরবর্তীতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন।
১৯৮১ এর সেই প্রথম ওপেন হার্ট অপারেশন থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে দেশের ৬টি শহরের ৩০টি হাসপাতালে বছরে বারো হাজারের বেশি হার্টের অপারেশন হচ্ছে। দু’একটা খুব জটিল ও বিরল অপারেশন ছাড়া প্রায় সব ধরণের হার্টের অপারেশন আন্তর্জাতিক মানের সাফল্য নিয়ে বাংলাদেশের সার্জনরা সম্পাদন করে চলেছেন। দুই দশক আগেও হার্টের অপারেশনের প্রয়োজন হলেই দেশের বাইরে নিদেনপক্ষে ভারতে যাওয়া ছাড়া গত্যান্তর ছিল না, আজ সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখনো অনেকে বিদেশে যাচ্ছেন, তবে সেটা প্রয়োজন নয়, সেটা বিলাস। এর সব কিছুর পেছনেই ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ ছিল এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিনের সেই প্রথম টিমের সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক এম নবী আলম খান ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে ইন্তেকাল করেছেন। অধ্যাপক এস আর খান বর্তমানে তার নিজ শহর কুষ্টিয়াতে অবসর জীবনযাপন করছেন। টিমের জুনিয়র সার্জন ডা. মিনহাজউদ্দিন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। জাপানী সার্জন ডা. কোমে সাজি এবং ডা. টোমিনো বাংলাদেশ মিশন শেষে জাপানে ফিরে যান। ৮৭ বছর বয়সী কোমে সাজি বর্তমানে জাপানের সেন্দাই শহরে বসবাস করছেন। চিফ এনেস্থেটিস্ট অধ্যাপক খলিলুর রহমান পেশাদারী জীবন থেকে অবসর নিলেও একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সহকারী অধ্যাপক এ ওয়াই এফ এলাহি চৌধুরী বর্তমানে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের আইসিইউ বিভাগের প্রধান।
কার্ডিয়াক সার্জারির সূচনা দিবস যে কোন দেশের জন্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের সেই দিনটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চার দশক পেরিয়ে এ দিনটিতে সেদিনের সেই প্রথম দিনের টিমের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন