পঞ্চাশোর্ধ্ব নাসির ভূঁঁইয়া। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বালুচর গ্রামের এই বাসিন্দা ১০ বছর ধরে নিখোঁজ। স্বজনরা ধরেই নিয়েছিলেন- নাসির হয়তো আর বেঁচে নেই। নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন সংসার পেতেছেন প্রিয়তমা স্ত্রীও। একমাত্র সন্তানটি লালিত-পালিত হচ্ছে তার নানাবাড়ি। এর মধ্যেই সম্প্রতি খবর আসে- নাসির বেঁচে আছে। তবে দেশে নেই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক পরিবারে আশ্রিত। নাসিরের পরিচয় ও তার পরিবারকে খুঁজে বের করার জটিল কাজটি করেছেন অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি বাংলাদেশ (এআরএসবি) এবং ভারতের পশ্চিমবাংলা অ্যামেচার রেডিও ক্লাবের (ডব্লিউবিআরসি) সদস্যরা। দুই বাংলার এই শখের অপারেটররা হ্যাম রেডিওর সদস্য।
‘হ্যাম রেডিও’ হলো এমন এক বেতার তরঙ্গ, যার মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ তথ্য আদান-প্রদান করে। শুধু পৃথিবীতেই নয়, এর মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায় মহাকাশেও। এমনকি কোনো বড় দুর্যোগে প্রচলিত নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়লেও সচল থাকে তাদের এই যোগাযোগব্যবস্থা। হ্যাম রেডিও কমিউনিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সুদূর জাপানে। বাংলাদেশে এর সহস্রাধিক শখের অপারেটর রয়েছেন।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের হ্যাম রেডিওর দুটি ক্লাব সূত্র জানায়, আজ থেকে বছর আট আগে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার গঙ্গাসাগর এলাকার সাগরদ্বীপ গ্রামে পথের ধারে পড়েছিলেন নাসির। বিশু নামের এক তরুণ স্থানীয়দের সহায়তায় সেখান থেকে তুলে নিয়ে সেবা-শুশ্রুষা করেন। কিন্তু নিজের নাম ও ঠিকানা কিছুই মনে করতে পারছিলেন না তিনি। একমুখ দাঁড়ি গোঁফওয়ালা অপরিচিত লোকটিকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন ওই গ্রামেরই বাসিন্দা অরবিন্দ গিরি। চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারটির সবার ভালোবাসা পেয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন নাসির। আশ্রয়দাতাকে জানান নিজের নাম, ধর্ম ও পরিচয়। এর পরও নাসিরকে পরিবারের একজন করেই সাত-আট বছর ধরে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন অরবিন্দ।
হ্যাম রেডিও অপারেটর দিবসে ঘটনাটি স্থানীয় মন্ডল (কলসাইন ঠট৩তওও) পুরো বিষয়টি পশ্চিমবাংলা অ্যামেচার রেডিও ক্লাব সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অমবারিশ নাগকে (কলসাইন ঠট২ঔঋঅ) জানান। সেই সূত্র ধরে অমবারিশ নাগ ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি বাংলাদেশের (এআরএসবি) সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল হুদাকে (কলসাইন ঝ২১ঐউ) ঠিকানা ও নামসহ একটি বার্তা পাঠান। তাতে নাসিরের গ্রামের অস্পষ্ট ঠিকানা ও তার অনেক আত্মীয়ের নাম ছিল। সেখান থেকেই শুরু হয় অনুসন্ধান। খুঁজতে খুঁজতে নাসিরের গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে পৌঁছে যান শামসুল হুদা। বাবা, ভাইবোন ও বোনজামাইকে পুরো বিষয়টি জানানো হয়। তার ফিরে আসার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু নাসিরকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার বাবা ছাড়া অন্য কারোরই যেন তেমন আগ্রহ নেই।
পরবর্তী সময়ে গ্রামবাসীর সহায়তায় নাসিরের অন্য স্বজনদের খোঁজ শুরু করেন শামসুল হুদা। পেয়ে যান তার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা। ফরিদপুরের হাজীগঞ্জ এলাকায় বিয়ে করেছিলেন নাসির। মুঠোফোনে শাশুড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নাসির নিরুদ্দেশ হওয়ার পর স্ত্রী নাসরিন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আর তাদের এক বছরের শিশুসন্তানটিকে নানির হেফাজতে রেখে তিনি চলে যান নতুন পরিবারে। নাসিরের সেই ছেলেটির বয়স এখন ১০ বছরেরও বেশি। নাম আহাদ। ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের হাজীগঞ্জের স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে আহাদ। ভিডিওকলের মাধ্যমে আহাদ ও বাবা নাসিরকে কথা বলার সুযোগ করে দেন হ্যাম রেডিও অপারেটররা। জন্মের পর বাবার সঙ্গে শিশু আহাদের এটিই প্রথম কথা। অথচ সে জানত তার বাবা আর এই পৃথিবীতে নেই। তাকে ফেলে চলে গেছে বহুদূরে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়! তাই বাবার প্রতি তার ছিল রাজ্যের অভিমান। এআরএসবির সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভিডিওকলে বাবা-ছেলের এই মিলন এক অভূতপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি করে। তাদের কান্না হৃদয় ছুঁয়ে যায় উপস্থিত অন্যদেরও।’
পরিবার জানায়, ২০১০ সালের এক বিকালে ফুটবল খেলার সময় মাথায় আঘাত লাগে নাসিরের। তখন থেকেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে ২০১১ সালে তিনি নিখোঁজ হন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ এক দশক পর সুস্থ হয়ে পরিবারে ফিরতে চাইলেও নাসিরকে এখন গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তার ভাইবোনরা। ‘সম্পত্তির অংশীদার’ বেড়ে যাওয়াই হয়তো এর একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন হ্যাম রেডিওর অপারেটররা।
এদিকে নাসিরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমবারিশ নাগ। এরই মধ্যে তিনি কলকাতার বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও আদান-প্রদান করেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের শামসুল হুদাও মাঠপর্যায়ে সব ধরনের যোগাযোগ সম্পন্ন করেছেন। কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ উপহাইকমিশনকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নাগরিক সনদপত্র তুলে কলকাতায় বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ডব্লিউবিআরসির সাধারণ সম্পাদক অমবারিশ নাগ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা নাসিরকে খুঁজে পাওয়ার পর তার পরিবারকে খুঁজে বের করার অনুরোধ জানিয়ে এআরএসবিকে বার্তা পাঠাই। সে অনুযায়ীই সংগঠনটির সদস্যরা তার পরিবারের খোঁজ পেয়েছে। এখন সবাই মিলে তাকে দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছি।’ এআরএসবির সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল হুদা বলেন, ‘কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে নাসিরের সব কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। সেগুলো খতিয়ে দেখে বিশেষ ভ্রমণ পাসের ব্যবস্থা করলে নাসিরকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
কথা প্রসঙ্গে এআরএসবির শামসুল হুদা জানান, বিশ্বজুড়ে হ্যাম রেডিওর সদস্যা সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। আর বাংলাদেশে শখের রেডিও অপারেটর রয়েছেন এক হাজার। তাদের অর্ধেকই বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে বৈধ লাইসেন্সধারী। এসব হ্যাম রেডিও অপারেটর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সেবামূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন।
হ্যাম রেডিও কী
দুর্যোগ বা বিপর্যয়কালীন ইন্টারনেটের পাশাপাশি এই বেতার তরঙ্গও যোগাযোগের একটি বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এটি আসলে এক ধরনের শক্তিশালী বেতার যোগাযোগব্যবস্থা, যা সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে বেসামরিক জনগোষ্ঠীও ব্যবহার করতে পারে। আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে যখন টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট সব ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে; তখন প্রশাসনও ভরসা করে হ্যাম রেডিও অপারেটরদের ওপরেই। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম ইউনিয়নের (আইটিইউ) নিয়মানুযায়ী, একটি পরীক্ষায় পাস করার পরেই প্রতিটি দেশের হ্যাম অপারেটরদের লাইসেন্স দেওয়া হয়। বিশ্বে এবং বহির্বিশ্বে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য একই ভাষা ব্যবহার করেন হ্যাম অপারেটররা। সেই সঙ্গে আইটিইউ ঠিক করে দিয়েছে কোন দেশের কলসাইন কী হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন