রাজশাহীর বাজারে নকল ওষুধের আগ্রাসন বাড়ছে। নাম সর্বস্ব বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির লোগো আবার কখনো নামিদামি কোম্পানির মোড়কজাত করে নকল ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে। বেশি লাভের নেশায় কম দামে এসব ওষুধ কিনে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে অসাধু ফার্মেসি মালিকরা। এই ওষুধ বিক্রিতে ব্যবসায়ীরা পুষছেন দালালও। হাসপাতাল থেকে রোগি ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়াসহ বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কখনো মানহীন ওষুধ কিংবা নকল ওষুধ ধরিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন কৌশলে ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে।
দুই বছর থেকে নগরীর একটি বাসায় নকল ওষুধ প্রস্তুত করে আসছিলো আনিস নামের এক ব্যক্তি। গত ২৩ এপ্রিল শুক্রবার সেখানে অভিযান চালিয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারী বিভিন্ন সরঞ্জামসহ প্রায় কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধ জব্দ করে ডিবি পুলিশ। এ ব্যক্তির দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাজশাহীর বাজারে কোটি কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধ আছে। অথচ রাজশাহী ওষুধ প্রশাসন প্রায় প্রতিদিনিই বাজার থেকে ওষুধের স্যাম্পল সংগ্রহের কথা জানিয়েছে। এক্ষেত্রে গত দুই বছরে তারা নকল ওষুধের কারখানার সন্ধান বা ফার্মেসিতে নকল ওষুধ বিক্রয়কারী কোনো ব্যবসায়ীর সন্ধান পেয়েছেন কী না এবিষয়ে তারা কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। এসময় জনবলসহ বিভিন্ন সংকট ও প্রতিবন্ধকতার চিত্র তুলে ধরেন, রাজশাহী জেলা ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক মাখনুম তাবাসসুম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজশাহীর বাজারে নকল ওষুধ এটা নতুন কিছু বিষয় নই। তবে সম্প্রতি করোনাকালীন এটা বেড়েছে। আর এর সঙ্গে পুরো একটি চক্র জড়িয়ে আছে। উৎপাদক থেকে শুরু করে মেডিকেলের দালালসহ অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ী চক্র এর সঙ্গে জড়িত। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় জেনেশুনেই এসব ওষুধ কিনছেন। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে প্রশাসনিক কিছু অভিযান চললেও তা খুব একটা ফলপ্রস্যূ হয় না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র বলছে, এসব নকল ওষুধের সিংহভাগই বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। আর এসব ওষুধ সুকৌশলে সংরক্ষণ করা হয়। আর এটার সঙ্গে কোনো সাধারণ ওষুধ ব্যবসায়ীরা জড়িত নয়। প্রভাবশালীদের ছত্র-ছায়ায় উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত অসাধু চক্র কাজ করছে। আর এ কারণেই পুলিশি অভিযানে কেউ কেউ ধরা পড়লেও দ্রুতই বেরিয়ে এসে গ্রাহক প্রতারণার কাজে আবাও লিপ্ত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফার্মেসি দোকানি জানান, নকল ওষুধের দাম সাধারণত কম হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় এটা ক্রয় করে। আর শহরে কিছু চিহ্নিত ফার্মেসিও আছে। যেখানে অভিযানও চলে। প্রশাসন এ বিষয়ে অবগত। এই ওষুধ গোপনভাবেই রাখা হয়। যেটা সচরাচর কোনো স্পেশালিস্ট ছাড়া ধরতে পারবে না। তবে তার দাবি এটা নকল হলেও ক্ষতিকর নয়। আবার উপকারীও নয়। আর ভিটামিন জাতীয় ওষুধই বেশি নকল হয় থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল যে কোনো কিছুই ক্ষতিকর। আর তা যদি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হয় তবে তা রোগির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ওষুধের বাজারেও নকলের দৌরাত্ম বাড়ছে। এক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী অভিযানও পরিচালনা করছে। কিন্তু এর নিয়মিত তদারকির দায়িত্বে থাকা ওষুধ প্রশাসনকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
রাজশাহীতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজারের মতো ফার্মেসি রয়েছে। এই অল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে এটার কার্যকর মনিটর সম্ভব নয়। নকলের আগ্রাসনের চিত্র শহরে এমন হলে প্রান্তিক এলাকাগুলোর অবস্থা আরো নাজুক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারকে এখনিই পদক্ষেপ নিতে হবে। ফার্মেসিগুলোতেও নজরদারি বাড়াতে হবে। আর করোনাকালীন এ সময়ে যারা সাধারণকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে তারা যতই শক্তিশালী হোক তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির রাজশাহীর যুগ্ম আহ্বায়ক ড. ফয়সাল চৌধুরী জানান, বাজারে নকল ওষুধের দৌরাত্ম আছে। এক্ষেত্রে গুটি কয়েক অসাধু ব্যবসায়ীযুক্ত আছে। তারা অতিমুনাফার লোভে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব ওষুধ বিক্রি করছে। তবে তারা সচেষ্ট আছেন। নানা সীমাবদ্ধতাও আছে। তবে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি প্রশাসনের অভিযানগুলোতেও সহযোগিতা করে থাকেন তারা।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নানা সীমাবন্ধতার চিত্রই তুলে ধরছে রাজশাহী ওষুধ প্রশাসন। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীতে ২০ টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে। নিবন্ধিত অ্যালোপ্যাথিক ও ভ্যাটেরিনারি ফার্মেসি রয়েছে ৩ হাজার ২৩৪ টি, হোমিওপ্যাথি র্ফামেসি ১১৬ টি, আয়ুর্বেদ ২২ টি ও ইউনানী ২২ টি। এসব ফার্মেসির লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নসহ পর্যবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের। কিন্তু জেলা ওষুধ প্রশাসনে ১ জন সহকারী পরিচালক ও তিনজন কর্মচারী রয়েছে। এই জনবল নিয়ে তিন রুমের একটি বাসায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে ওষুধ প্রশাসন।
গত ৬ মাস আগে রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ও ছিলো এই তিন রুমের বাসা। যেখানে ১ জন অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে বিভাগীয় অফিসে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা কার্যক্রমও নেই। রাজশাহী জেলা ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক মাখনুম তাবাসসুম জানান, তাদেরকে বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। এ অফিসে তিনি নতুন যোগদান করেছেন। তারা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ওষুধের নকল প্রতিরোধেও কাজ করছেন। দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রায় প্রতিদিন ফার্মেসি থেকে ওষুধের স্যাম্পল সংগ্রহ করেন। এইসব স্যাম্পল নিজেরা টেস্ট করার পাশাপাশি ঢাকায় পাঠানো হয়।
তিনি আরো জানান, ওষুধের নকল রোধে ব্যবসায়ীদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা তারা সচেতন না হলে এটা রোধ করা কঠিন। দেখা যাচ্ছে তারা হয়তো কোনো জায়গায় অভিযানে যাচ্ছেন। একটি দোকানে ঠুকতেই পাশের দোকানগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে অভিযানগুলোও তেমন কার্যকর হচ্ছে না। তারা ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন