আর সবার মত খালেদ মাহমুদ সুজনও মনে করেন ছোট বেলার ঈদ অনেক বেশি আনন্দের ছিল। তখন ঈদে খুব মজা হতো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যা কমতে থাকে। পরিণত বয়সে গিয়ে সেই শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের ঈদ পরিণত হয় দায়িত্ব এবং কর্তব্যে।
খালেদ মাহমুদ সুজন এখন ঈদ এলেই দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভাবেন। ব্যক্তি জীবনে ক্রিকেট, ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের সাথে সম্পৃক্তা অনেক বেশি। তাই ঈদ এলে পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও ক্রিকেটার, ক্লাব স্টাফ, টিম বয়দের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকে জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়কের।
সবার জানা, ক্রিকেটার, কোচ ও ক্রিকেট পাড়ায় সবাই তাকে ‘চাচা’ বলে ডাকেন। তার আচার, আচরণে একটা চাচাসূলভ মনোভাব আছে, তিনি ছোট-বড় সবার কথা ভাবেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে নানা ভাবে অনেককে সাহায্য সহযোগিতার চেষ্টা করেন। দেশের সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগীদের তা জানা না থাকলেও ক্রিকেট পাড়ার অনেকেই তা জানেন।
ছোট বেলার ঈদ কেমন ছিল? তার সাথে এখনকার ঈদের কতটা পার্থক্য? জাগো নিউজের কাছ থেকে এ প্রশ্ন পেয়ে খালেদ মাহমুদ সুজন কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে যান তার শৈশবে।
এরপর এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করেন, ‘আসলে তখন আমরা ঈদে অনেক মজাও করতাম। ভাই-বোন মিলে হইচই, খাওয়া-দাওয়া সারাদিনই একটা মজার ভিতরে কাটতো।’
জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ক যোগ করেন, ‘আমার আব্বারা চারভাই ছিলেন। আমরা সব চাচাসহ সিদ্ধেশ্বরীতে এক বাসায় থাকতাম। খুব স্বাভাবিকভাবে অনেকগুলো ভাইবোন। কাজিন। আমাদের প্রায় সবাই কাছাকাছি বয়সের বা পিঠাপিঠি। আমার বড় ভাইয়া আর বড় আপি বাদ দিলে বাকি কাজিনরা বড়জোর চার পাঁচ বছরের ছোট বড়। ওই সময় নতুন কাপড় কিনে দেয়ার কাজটি বড়রা করতেন। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম নতুন কাপড়ের।’
ছেলেবেলার ঈদের কোন স্মরণীয় ঘটনা আছে কী? উত্তরে বিসিবি পরিচালক জানান, ‘দুটি ঘটনা এখনো মনে দাগ কেটে আছে। এখনো ভুলিনি। প্রথমটি হলো, আমরা যখন স্কুলের নিচের দিককার ক্লাসে পড়তাম, তখন বিশ্বের সেরা পপ স্টার মাইকেল জ্যাকসনের পরনের জুতোর স্টাইলের জুতার খুব চল ছিল। আমার ছোট চাচা একবার আমাকে সেই মাইকেল জ্যাকসন স্যু কিনে দিয়েছিলেন। জুতোর সামনে গোল্ডেন প্লেট ছিল। আমি ওই জুতোর জন্য অনেক বায়না ধরেছিলাম, তখন ছোট চাচা আমাকে সেটা কিনে দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম অনেক ছোট। বছর আটেক হয়তো বয়স ছিল। ছোট চাচা সেটা কিনে দেবার পর আব্বা রীতিমত তাকে চার্জ করেছিলেন, কেন এত দাম দিয়ে ওই জুতো কিনে দিয়েছেন?’
আর একটি ঘটনাও খালেদ মাহমুদ সুজনকে দোলা দিয়েছিল। সেটা হলো, তার বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ঈদের সালামি পাওয়া। আমার ভাইয়ার (সাবেক ক্রিকেটার ইয়াফী) বিয়ের পর আমরা গিয়েছিলাম তার শ্বশুর বাড়িতে। আগেই বলে রাখি ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ি ছিল পুরোন ঢাকার আরমানিটোলা। সেখানে ছেলেপুলেদের ঈদের বখশিস বা সেলামি দেয়ার রীতি ছিল এবং মোটা অংকের টাকাই দেয়া হতো। তো আমি ভাইয়ার এক খালা শ্বাশুড়ির কাছ থেকে ৫০০ টাকা পেয়েছিলাম, যিনি হয়ত বয়সে আমার প্রায় কাছাকাছি। আমি তখন বেশ ছোট, স্কুলে পড়ি। সেই ৫০০ টাকা সালামি পাবার ঘটনাটি খুব স্মরণীয় হয়ে আছে। কারণ এর আগে আমি কখনোই কারো কাছ থেকে অত টাকা ঈদ সালামি পাইনি।’
ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম দেশের বাইরে ঈদ করার স্মৃতিটাও কিছুতেই ভুলতে পারেননি সুজন। ‘আমি আসলে দেশের বাইরে খেলতে গিয়ে কবে পরিবার ছাড়া প্রথম ঈদ করেছিলাম, ঠিক মনে নেই। তবে একটি ঈদের কথাই ঘুরেফিরে মনে পড়ে। পরিবার ছাড়া একটি ঈদের কথাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাহলো, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বিশ্বকাপের প্রথম গ্রুপ ম্যাচে আমরা কানাডার কাছে হেরে গিয়েছিলাম।’
‘আমার খুব কষ্ট ছিল, সেটা কোরবানীর ঈদের ঠিক আগের দিন আমরা হেরেছিলাম। রাত পেরুলেই ঈদ। আমার মনে আছে ক্রিকেটার, কোচ ও কর্মকর্তা সবাই এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে সবাই ঈদের নামাজ পড়তেও যাননি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমরা তিনজন মাত্র নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম সুমন (হাবিবুল বাশার), মঞ্জু (পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম) আর আমি। নামাজ পড়তে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ডারবানের বিরাট মসজিদ। কয়েক হাজার মুসুল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। আমরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি হাজার হাজার মুসলমান নামাজ পড়তে এসেছেন! বিশাল ঈদের জামাত। শেষে অনেক খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল সেখানে। যদিও আমি কানাডার বিপক্ষে সেই ম্যাচ খেলিনি। তারপরও আমিতো পার্ট অফ দ্য টিমই ছিলাম। তাই অনেক কষ্ট লেগেছিল।’
খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছেন। তাই ক্রিকেটার হিসেবে যখন অর্থ আয় শুরু করেন, তার আগেই মা পরপারে চলে গিয়েছিলেন। সে কারণে ক্রিকেটার সুজন তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে মা’র জন্য কোন উপহার কিনতে পারেননি। সেটাও একটা কষ্টের জায়গা। ‘মাকে হারিয়েছি অনেক ছেলেবেলায়। তখন আমার বয়স ছিল ১৫। আমি যখন প্রথম মোহামেডান থেকে পেমেন্ট পাই ৮৯ সালে। খুব সম্ভবত ২৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। তা দিয়ে ভাবি, তথা ইয়াফি ভাইয়ের স্ত্রী, বোনদের শাড়ী কিনে দিয়েছিলাম সেটা মনে আছে। তবে সেটা ঈদে ছিল কিনা মনে নেই। কারণ আমি যখন পেমেন্ট পাই তখন মনে হয় না ঈদ ছিল।’
ছোট বেলার ঈদের কথাতো শোনা হলো, বর্তমান সময়ে ঈদে কী করেন? ‘এখন মানুষকে দেয়া, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের জন্য কিছু করাই আসল কাজ। সাথে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের স্টাফ, টিম বয়দেরও যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করি। আর এবার চেষ্টা করেছি ক্রিকেটারদের পাশে দাড়াতে।’
সুজন আরও বলেন, ‘গর্ব করি না আমি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আত্মীয়-পরিজন ছাড়া আমাদের ঢাকার ক্লাব পাড়ার টিম বয়দের পাশে থাকার চেষ্টা করি। ক্লাব বয়কে আমি ঈদে বখশিস দেয়ার চেষ্টা করি। মোহামেডানের শরীফ, পচা, আবুল ভাই, তৌহিদসহ ক্রিকেট পাড়ার অনেক পরিচিত বয়ই আমার কাছের মানুষ। ওদের ঈদের বখশিষ দেয়ার চেষ্টা থাকে সব সময়। তাদের কিছু দিতে পারলে খুব ভাল লাগে।’
‘এবার পিচ ফাউন্ডেশন থেকে ৩০ জন টিম বয়কে আমরা সাবেক ক্রিকেটাররা মিলে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। মাহবুব ভাই (বিসিবি পরিচালক মাহবুব আনাম), নান্নু ভাই, আকরাম ভাই, দুর্জয়, আতহার ভাই আর মিঠু ভাই (ইফতেখার রহমান সাবেক ক্রিকেটার ও সংগঠক) ভাই সবাই মিলে ক্লাব পাড়ার ৩০ জনকে বয়কে আমরা যতটা পেরেছি অল্প অল্প করে সহায়তার চেষ্টা করেছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন