ইতিহাস-ঐতিহ্যের শীতলক্ষ্যা আজ লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নীরব শীতলক্ষ্যা লাশের ভাগাড়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। অহরহই মিলছে শীতলক্ষ্যায় লাশ। এসব লাশের দুই একটির পরিচয় মিললেও অধিকাংশের কোনো পরিচয় মেলেনি।
বছরে অন্তত ৪ থেকে ৫টি লাশ উদ্ধার হয় শীতলক্ষ্যা নদ থেকে। শুধু যে শীতলক্ষ্যা লাশের ভাগাড়, তা কিন্তু নয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম এলাকা ও বেশ কিছু স্পট লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অন্য কোনো স্থানে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদ ও নারায়ণগঞ্জের নির্জন স্থানে লাশ ফেলে যাচ্ছে খুনিরা। সব মিলিয়ে এ যেন এক মৃত্যুকূপ, অজ্ঞাতপরিচয় লাশের ভাগাড়।
ঢাকা রেঞ্জের ১৭ জেলার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা সূচকে তবুও এক নম্বরে আছে শীতলক্ষ্যা পাড়ের এই জেলা। গত এক দশকে নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে ৯০০ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কেন খুন হচ্ছে, কারা খুন করছে, প্রশাসনের কি ভূমিকা, স্থানীয়রা কি ভাবছে ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি পুরো জেলা চষে বেড়িয়েছেন যুগান্তরের নারায়ণগঞ্জ স্টাফ রিপোর্টার রাসেল মাহমুদ। তার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের ছাপা হলো।
জেলা পুলিশ ও থানাগুলোর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত এক যুগে শীতলক্ষ্যা নদ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান তাদের জানা নেই।
তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্যমতে ও অসমর্থিত কয়েকটি সূত্র জানায়, গত এক যুগে শীতলক্ষ্যা নদ ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে থেকে প্রায় ৯০০ অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জেলার ৭টি উপজেলা থেকে গড়ে প্রতিমাসে একটি করে লাশ উদ্ধার করা হলে বছরে ৮৪ টি লাশ উদ্ধার করা হয়। আর সে হিসেবে এক দশকে দাঁড়ায় প্রায় ৮৪০টি লাশ। এ সংখ্যা কমবেশিও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ সবের মধ্যে কয়েক বছরের কয়েকটি চিত্র দেওয়া হলো। বিগত ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে আড়াইহাজারের উচিৎপুরা বিল থেকে যুবকের লাশ, ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর গোপালদী লক্ষ্মীবরদী মাদ্রাসার কাছ থেকে নারীর লাশ, ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর হাউজদী ইনুমদী আমবাগ থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। সোনারগাঁয়ের বৈদ্যেরাজার খংসারদি ব্রিজের নিচ থেকে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ যুবকের লাশ, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর দড়িকান্দি এলাকায় যুবকের লাশ, ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর জামপুরের কলতাপাড়া থেকে মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর বন্দরের কুড়িপাড়ার খাল থেকে বস্তাবন্দী তরুণের লাশ, ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি সৌমবাড়ি এলাকা থেকে যুবকের লাশ, ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর মদনপুরের চাঁনপুর এলাকা থেকে নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সিদ্ধিরগঞ্জের মিতালী মার্কেটের ছাদ থেকে ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুবকের লাশ, ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গোদনাইল থেকে নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
ফতুল্লার কাশিপুর হাটের পাশ থেকে ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যুবকের লাশ, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নরসিংপুর থেকে কিশোরের গলাকাটা লাশ, ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ইসদাইর থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। রূপগঞ্জের জিয়সতলা থেকে ২০২১ সালের ৩ মার্চ আগুনে পোড়ানো এক তরুণীর লাশ, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল বরাব থেকে যুবকের লাশ, ২০২০ সালের পহেলা জুলাই কোটাপাড়া বিল থেকে তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, কখনো দুর্বৃত্তরা লাশ নিয়ে সেখানে আসে অ্যাম্বুলেন্সে, কখনোবা মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, কাভার্ড ভ্যান, ইঞ্জিন চালিত নৌকা, লঞ্চ, বালুর ট্রলার বা কার্গো জাহাজে। কখনো জীবিত ব্যক্তিকে ধরে এনে বা বেড়ানোর নাম করে এনে লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনাও আছে।
মদনগঞ্জ ট্রলার ঘাটের লাইনম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ছয়-সাত বছর আগেও শীতলক্ষ্যার পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। পানি ছিল পরিষ্কার, ছিল প্রচুর মাছ। এখনকার ঘোলা পানিতে মাছ কমে গেছে, বেড়েছে লাশের আনাগোনা।
নিহত ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক কর্মী রাফিউর রাব্বি জানিয়েছেন, শীতলক্ষ্যায় সাত খুনসহ ভুলু, চঞ্চল, আশিকদের মত অসংখ্য লাশ পাওয়ার পর থেকেই লাশের ভাগাড় হিসাবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা। অপরাধীদের অভয়ারণ্য এই শীতলক্ষ্যা।
এখানে লাশ পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে করছে না। নৌ-পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর টহল থাকা সত্ত্বেও এইভাবে লাশ পড়তে পারে না। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা বলে আমি মনে করি।
জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যাকে আমরা লাশের ভাগাড় তখনি বলা শুরু করছি ত্বর্কীসহ ৭ খুনের মত অসংখ্য বেওয়ারিশ লাশ নদীতে বেশে উঠা শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জে এমন অসংখ্য বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে যা অন্য জেলায় হত্যা করে এখানে ফেলে গেছেন বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, শীতলক্ষ্যাতে মাঝে মধ্যে অজ্ঞাত ও বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া য়ায়। সে ক্ষেত্রে আমরা সিআইডি এবং পিবিআইপি দিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে লাশ ও অপরাধী শনাক্ত করতে সক্ষম হই।
নদীপথে নৌ পুলিশ, উপরে থানা,ফাঁড়ি ও জেলা পুলিশের টহল অব্যাহত আছে। কোনো অপরাধীরা যেন অজ্ঞাত এবং বেওয়ারিশ লাশ ফেলতে না পারে এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়েছে বলে তিনি জানান।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, শীতলক্ষ্যাতে অজ্ঞাত বেওয়ারিশ লাশ পড়ার বিষয়ে আমরা পুলিশ বিভাগকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে। যাতে করে তারা নৌ ও থানা পুলিশের টহল জোরদার করে এবং আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসারদেরও এ ব্যাপারে নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন