রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ১০ ডিসেম্বর থেকে সব ধরনের নিয়োগের ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরপরও বিদায়কালে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে সাবেক ভিসি ড. সোবহান এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। শুধু তা-ই নয়, প্রফেসর সোবহানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির ২৫টি অভিযোগ ইউজিসির তদন্তে প্রমাণিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইউজিসি তাকে অপসারণের সুপারিশ করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা করেনি। মন্ত্রণালয়ের এমন শৈথিল্যের সুযোগে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। কার্যকালের শেষদিকে মন্ত্রণালয়কেও আর তোয়াক্কা করেননি ড. সোবহান। এমন মতামত দিয়েছেন রাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর রাবিতে নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মাত্র দুদিন পর ১২ ডিসেম্বর প্রফেসর সোবহান ৫০৩তম সিন্ডিকেট সভায় ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ও বায়োলজিক্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে দুজন সেকশন অফিসার নিয়োগ দেন। শনিবার তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে দুজন সেকশন অফিসার নিয়োগের বিষয়টি কেউ জানতেই পারেননি।
তদন্ত কমিটি, রাবি প্রগতিশীল ও দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকসমাজ সূত্রে জানা গেছে, ১৩ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক আদেশপত্রে ড. সোবহানের জামাতা শাহেদ পারভেজ ও মেয়ে সানজানা সোবহানের নিয়োগ বাতিল করতে বলা হয়েছিল। তবে মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনাকেও বিন্দুমাত্র পাত্তা দেননি ড. সোবহান। মেয়ে-জামাতার নিয়োগ বাতিল তো দূরের কথা, উলটো ৩ এপ্রিল সিন্ডিকেটের ৫০৫তম জরুরি সভা ডেকে সেখানে মেয়ে-জামাতার চাকরি স্থায়ী করে নেন। মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে ভিসি সোবহানের কাছে ১৫টি অনিয়মের বিষয়ে পৃথকভাবে কৈফিয়ত তলব করে। কিন্তু ড. সোবহান তাতেও কর্ণপাত করেননি। মন্ত্রণালয়ের কোনো কৈফিয়তের জবাব দেননি তিনি, বরং নিজের গতিতেই কাজ করে গেছেন।
সাবেক ভিসি সোবহানের বেপরোয়া হয়ে ওঠা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহা. সোলাইমান চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে সদ্যবিদায়ি ভিসির অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শতাধিক প্রগতিশীল শিক্ষক আন্দোলন করে আসছেন। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দুর্নীতি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও মন্ত্রণালয় চুপচাপ থেকেছে। অভিযোগ প্রমাণের পরও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তা-ও এক রহস্য। তখন ব্যবস্থা নেওয়া হলে এখন রাবিকে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না।
রাবির প্রগতিশীল শিক্ষকসমাজের কো-কনভেনার ড. সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা যুগান্তরকে বলেন, ‘সদ্যবিদায়ি ভিসির অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা চরম পর্যায়ে চলে গেলেও মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনেক ধীরে চলো নীতিতে এগিয়েছে। এই সুযোগে ড. সোবহান আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ড. সোবহান সিনেট প্যানেলের ভিসি ছিলেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছিল। এ কারণে তাকে অপসারণে মন্ত্রণালয়ের কোনো বাধাই ছিল না। মন্ত্রণালয় কেন এটা করেনি-প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জানা গেছে, বিদায়ের কয়েক ঘণ্টা আগে ৫ মে রাতভর ভিসি নিয়োগ বাণিজ্য করার খবরটি ৬ মে প্রকাশ পেলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরপর মন্ত্রণালয় ইউজিসির সিনিয়র সদস্য ড. মোহাম্মদ আলমগীরকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। শনিবার কমিটি দিনভর রাবিতে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে। কমিটির সদস্য ইউজিসির মেম্বার প্রফেসর আবু তাহের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. জাকির হোসেন আখন্দ ও ইউজিসির পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে তদন্তে ড. সোবহানের বিরুদ্ধে ২৫টি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, সেই কমিটির প্রধান ছিলেন ইউজিসির সিনিয়র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজ বেগম। রাবিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সদ্যবিদায়ি ভিসির কর্মকাণ্ডে আমরা শিক্ষকসমাজ খুবই লজ্জিত। আমরা অনেক সময় নিয়ে ড. সোবহানের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করেছিলাম। প্রায় সাত শ পাতার তদন্ত প্রতিবেদনে তাকেসহ তার পুরো প্রশাসনকে অপসারণের সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু কেন মন্ত্রণালয় তাকে রেখে দিয়েছিল, সেটা আমাদের কাছেও রহস্য।
অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. মুহাম্মদ আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন গিয়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে তদন্তের কাজ শেষ করেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিব। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন