মাহবুব আজীজ
প্রায় সাড়ে চার বছর ছাত্র রাজনীতিমুক্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বর্তমানে রাজনীতির প্রশ্নে আবারও আলোচনায়। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ ৭০/৮০ নেতাকর্মী বুধবার মধ্যরাতে ওই ক্যাম্পাসে সমাগমের পর থেকে সাধারণ ছাত্রছাত্রী এর প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করেন। বুয়েটের যে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের ছাত্রত্ব বাতিলসহ বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগের দাবিসহ পাঁচ দফার আন্দোলন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগ অভিযোগ অস্বীকার করে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির পক্ষে দাবি তুলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছে, তারাও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে এখন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ মুখোমুখি অবস্থানে।
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এ দেশের বিবেকি মানুষকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরে হলের সিসিটিভি থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে এ ঘটনা স্পষ্ট বোঝা যায়। দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০২১ সালে আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর ২০ জন প্রাণদণ্ডে ও ছয়জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হন। বুয়েটে অপছাত্র রাজনীতির শিকার হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু আগেও হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে নিহত হয়েছিলেন বুয়েট ছাত্রী সাবেকুন্নাহার সনি।
আবরার হত্যার পর ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে বুয়েট ক্যাম্পাসে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির সদলবল মহড়ার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে, আবরার হত্যাকাণ্ডের ক্ষত আজও দগদগে; তারা ক্যাম্পাসে সামগ্রিক ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগ থেকে বলা হয়, মৌলবাদী গোষ্ঠীর কালোছায়া থেকে মুক্ত করে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে এবং বুয়েট কর্তৃক গৃহীত অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি, শিক্ষাবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় প্রতিবাদী সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, ‘আমরা যে কোনো মূল্যে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি দেখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কথা বলার কারণে ১৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার কারণে আজকে বুয়েটের একটি পক্ষ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে, নিপীড়ন করছে, মানসিকভাবে নির্যাতন করছে। তাদের বিরুদ্ধে বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’ (ডেইলি স্টার, ৩০ মার্চ, ২০২৩)।
০২.
ছাত্র রাজনীতিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে দাবি করে তা আদায়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন ছাত্রলীগ নেতৃত্ব। নিঃসন্দেহে রাজনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার, ছাত্র রাজনীতিও তাই। তবে পরিস্থিতি কত প্রতিকূলে পৌঁছালে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে একাট্টা হয়, সেটিও ভেবে দেখতে হবে। আবরার হত্যাকাণ্ড এক রাতের আকস্মিক ঘটনামাত্র নয়; ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও সন্ত্রাস সমস্ত যুক্তি ও নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো করে হল ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছিল বলেই শিবির সন্দেহে টগবগে মেধাবী আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলার স্পর্ধা দেখায় ছাত্রলীগ কর্মীরা। শিবির বা যে কোনো সংগঠনের কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার এখতিয়ার রাখে না ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো সংগঠন– রাজনীতির এই মৌল পাঠ নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির অংশ।
ছাত্রলীগ সভাপতিসহ নেতৃবৃন্দের কথাবার্তায় পরিষ্কার যে, বুয়েটে মৌলবাদী শক্তির কালোছায়া বর্তমান। তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত কথা বললেই সেটি মৌলবাদী শক্তি হয়ে ওঠে, এই কাকতাড়ুয়া যুক্তি বরাবরই ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের পছন্দ। আপনি যদি আপনার সংগঠনের মতামত, আদর্শ চর্চা করতে পারেন; তবে অপরাপর ব্যক্তিবর্গও প্রত্যেকে তাদের মত ও আদর্শ চর্চা করতে পারেন। আপনার বিপরীতে দাঁড়ালেই সে অপশক্তি, মৌলবাদী– এটি যুক্তির কথা হতে পারে না। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল চিহ্নিত করার দায়ভার ছাত্রলীগের নিজের কাঁধে নেওয়ার প্রয়োজন নাই; এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ দেশে আছে।
নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির আওতায় অবশ্যই সব মত ও পথের পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সহাবস্থান জরুরি– এই ন্যূনতম নৈতিক অবস্থান গত দেড় দশকে ছাত্রলীগ বুয়েটে তো বটেই, দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখাতে পারেনি বা চায়নি। বুয়েটে ছাত্রলীগ কখনও ছাত্র সংসদ নির্বাচন চেয়েছে? গত দেড় দশকে? ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক বা প্রাসঙ্গিক কোনো সমস্যায় সমাবেশ করেছে? কখনও? নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জোর করে মিছিলে নেওয়া, র্যাগিং থেকে বিভিন্ন বাণিজ্যের ঘেরাটোপে আটকে ছিল ছাত্রলীগের রাজনীতি। বুয়েট ছাত্রদের পরিচালিত ‘ইউরোপোর্টার’ নামে ওয়েবপেজ জানাচ্ছে, ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বুয়েটে কমপক্ষে ১৬৬টি র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। ওয়েবপেজ আরও তথ্য দিচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বুয়েটে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি বা র্যাগিং কিংবা ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে জোরপূর্বক অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করা হয়নি।
০৩.
নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. আবুল কালাম লালপুর উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এবার সংসদ নির্বাচনে আমার ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এইটা আমি তুলব। যেভাবেই হোক।’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের শীর্ষ ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে নিয়মিত অভিযোগ, তাদের প্রধান আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারবাজিতে! অর্থাৎ, নাটোরের সংসদ সদস্যের রাজনীতির মতো ছাত্র রাজনীতিরও একই হাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হল থেকে আরেক হলে সরকারি সমর্থনপুষ্ট ছাত্রনেতাদের আধিপত্য তৈরির মহড়া, ছাত্রনেতাদের শক্তি প্রদর্শন দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈমিত্তিক ঘটনা। তাহলে কি বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েই থাকবে?
একজন ছাত্রের প্রতি তাঁর পরিবারের পাশাপাশি দেশেরও কিছু প্রত্যাশা থাকে। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীলতা চর্চায় ছাত্র রাজনীতি যেমন প্রয়োজনীয় ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করে, তেমনই শানিত করে ছাত্রছাত্রীর নৈতিক যুক্তি ও ঔচিত্যবোধ। কূপমণ্ডূক ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ছাড়িয়ে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা নিজ দেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিবিমুখ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসবে, তা বিবেকবান কেউই সমর্থন করতে পারেন না। আবার সেই বুয়েটে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর লাঠিপেটায় নির্মমভাবে নিহত হবে তরুণ তাজা প্রাণ; তাও গ্রাহ্য হতে পারে না।
মূল রাজনৈতিক দলে আদর্শহীনতা প্রকট হয়ে দেখা দিলে সেই দলের ছাত্র সংগঠনেও একই ধারা বহমান থাকে। ছাত্র রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ হওয়ার মতো বিষয়ে পরিণত হয়। এ দেশে রাজনীতি আলাদিনের জাদুর চেরাগ, অল্প সময়ে কম পরিশ্রম ও মেধায় সম্পদ অর্জনের অলৌকিক হাতিয়ার। পেশিশক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা সব শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে বলেই বুয়েটসহ সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একই চেহারা, একই কর্মপরিধি– জোরজবরদস্তি, সওদাগরি! মূল রাজনৈতিক সংগঠনের আদর্শগত চিন্তা, সৎ ও দায়িত্বশীল আচরণ ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক মানসিকতাই কেবল পারে বুয়েটসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির চর্চা চালু করতে! হুমকি-ধমকি, পেশিশক্তি বা ক্ষমতার আস্ফালন সাময়িক স্ফুর্তি দিতে পারে, দীর্ঘস্থায়িত্ব ও জনভিত্তির প্রশ্নে নৈব নৈবচ।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন