কে এন দেয়া
সব মানুষই সমান, তবে কোনো কোনো এমপি’র কন্যা একটু বেশি সমান। সেটাই দেখা গেল বগুড়ার একটি ঘটনায়। দেশজুড়ে প্রতিদিন ঘটে যায় চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা, কিছু আমাদের ভাবায়। কিছু হয়তো আমাদের মনোযোগ হারায় যেভাবে হাঁসের শরীর থেকে পানি ঝরে যায় নিমিষেই। আবার কিছু ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়, অথবা ধামাচাপা দেওয়া হয়। চাপা দেওয়ার জন্য তখন দরকার হয় ক্ষমতাশালী কোনো ‘ধামা’।
দেশের তিনটি বিভাগে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেল এই শুক্রবার। বগুড়ার এক কেন্দ্র থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারে জালিয়াতির অভিযোগে আটক করা হয় কতিপয় পরীক্ষার্থীকে। তার মাঝে একজন আবার সাংসদের সন্তান! এমন মানুষের কন্যা তো অধরা, তাঁদের ধরা যায় না। তাই অন্যদের বেলায় মামলা করা হলেও তাঁর বেলায় ছাড়। শুধু তাই নয়, তাঁকে ‘সসম্মানে’ আবার বাড়িও পৌঁছে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ উভয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বিসিএসের মতো অতটা লোভনীয় না হলেও প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়ারও একটা আকর্ষণ আছে ভীষণ কঠিন এই চাকরির বাজারে। এতে উত্তীর্ণ হতে দেশজুড়ে অসংখ্যা মানুষের প্রচেষ্টা থাকে প্রতিবারই। মাসের পর মাস এর জন্য প্রস্তত হয়ে থাকেন পরীক্ষার্থীরা। নিজের মেধার ওপর ভরসা না থাকায় অনেকেই জালিয়াতির সুযোগ নেন, সেটাও বেশ ডালভাত ব্যাপার হয়ে গেছে। তবে জালিয়াতি করে ধরা পড়া, আবার সাংসদ পিতার প্রভাবে সসম্মানে ছাড়া পাওয়া— ব্যাপারটা এখনো নির্লজ্জতার নিদর্শন বলেই মনে হয় বই কী!
‘প্রভাব’— বড়ই মোক্ষম একটি ধারণা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনসভার সদস্যের রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে, তিনি সে প্রভাব খাটাবেন, দিনে-রাতে খাটাবেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধাপে খাটাবেন—এমনটাই দেখা যাচ্ছে। ফলে তাদের সন্তানরাও জেনে যায়, প্রভাব আছে, প্রয়োজনমতো প্রভাব খাটানো হবে। তাই রাষ্ট্রের নিয়মনীতি মেনে না চলার ঝক্কি তাদের না নেই। কী আসে যায়! এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। হাতের মোবাইলে গুগল খুলে সার্চ করুন ‘এমপি পুত্র’ বা ‘এমপি কন্যা’ লিখে; রাজনৈতিক প্রচারের পাশাপাশি তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের খবর উঠে আসবে। এ সবের মূলেই সেই অপ্রতিরোধ্য ‘প্রভাব’।
বগুড়ার খবরটা [সমকাল, ০৩.০২.২৪] খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। উম্মে হামিদা বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবর রহমান মজনুর সৎমেয়ে। হামিদা ১১০৭ নম্বর কক্ষে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। কেন্দ্রের বাইরে হামিদার মা শিল্পী বেগমও ছিলেন। হামিদাকে আটক করলে মা শিল্পী বেগম ডিবি কার্যালয়ে যান। পরে রাত ১০টার পর হামিদাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে আবারও কেন্দ্রে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। সেখান থেকে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় হামিদার মা শিল্পী বেগম বলেন, ‘ওরা না বুঝে হয়তো মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। পরে স্যরি-টরি বলে মাফ চেয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’ মজিবর রহমান মজনু এমপি বলেন, ‘ঘটনা ঘটে থাকলেও জানা নেই।’
একই কেন্দ্র থেকে মোবাইল ফোনে জালিয়াতির অভিযোগে আটক করা হয় চারজনকে। এমপি কন্যা উম্মে হামিদাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, রইল বাকি তিনজন। একই অপরাধে আটক, অথচ একজনের ওপর কোনো আঁচ লাগলো না, বাকিরা হয়ে রইলেন কয়েদখানায় আটক – নেহায়েতই প্রভাবের অভাবে।
সাধারণ মানুষের কাছে এহেন প্রভাব স্বপ্নের মতোই বটে। তাই এমন সব সংবাদ দেখে একটা হাস্যরস মাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়েই যায়, ‘আহা, হতাম যদি এমপি কন্যা!’ অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতাম ‘সসম্মানে’। খেটে খাওয়া, পরিশ্রমী মানুষগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতাম কোনো কষ্ট না করেই! মাগনা পেলে বাঙালী আলকাতরাও খায়, খাটুনি ছাড়াই সাফল্য হাতছাড়া করবে কোন পাগলে?
এক সময়ে মানুষের আদর্শবোধ বেশ টনটনে ছিল। ‘আমার সন্তান ভালো মানুষ হবে,’ নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব বাবা-মায়ের ছিল একই কথা। আর এখন? সন্তানকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করানো থেকে শুরু হয় বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার, এমনকি ঘুষের কারবার। পুরো শিক্ষাজীবন জুড়েই চলে এর ধারাবাহিকতা। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা, বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় মাঝে মাঝে। এসব ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কেনেন কারা? অভিভাবকরাই কেনেন।
পরিবার থেকেই যেখানে দূর্নীতির শিক্ষা, সেখানে ‘ভালো মানুষ’ তৈরি হবে কী করে? তারা তো ভেবেই নেবে প্রভাব খাটালে সব কাজ হাসিল হয়ে যায়, তা হোক রাজনৈতিক প্রভাব, অথবা আর্থিক। সে দিন এলো বলে, যখন যোগ্যতার প্রমাণ দিতে গিয়ে হাসির পাত্র হতে হবে, যদি না আপনার ‘প্রভাব’ থাকে। তখন এমপি বাবার ছত্রছায়ায় থাকা কন্যাটিই হবে সবার ‘স্ট্যান্ডার্ড।’
কে এন দেয়া: সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন