আমি তাকে দেখছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে, মনের অনেক কোণ থেকে। তার কাব্যিক চাহনী অথবা নাটকীয় অবয়ব। এখনো অনাস্বাদিত সেরা কোন ওয়াইনের মতো টানছে আমাকে। কোমল ও তাজা, কচি ও আদুরে এবং অবশ্যই রাজকীয়। আপাতত গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছি। প্রতিটা চুমুকে আমার দৃষ্টিক্ষেপ আরো সতেজ আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। সেই সাথে কিছুটা উত্তপ্ত।

একাকী মনটা মাঝে মাঝে বিবাগী হতে চাইলেও আমি মানুষটা বরাবরই তার বিপক্ষে। তবুও সে ফাঁক পেলেই উড়াল দেয়। বড়জোর কয়েকশ’ মিটার। হেঁচকা টানে নামিয়ে আনি। ধীরে বৎস, ধীরে। তোমার স্বপ্নের কথা ভুলে গেলে! এতকালের আরাধনা! একটা সুন্দর গুছানো সংসার, স্বপ্নময় সাবলীল দাম্পত্য!

কিন্তু ইদানিংকার ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। প্রতিদিন অফিস শেষে, এই ক্যাফেতে এসে এক পেয়ালা কফির অর্ডার দিই। হালকা হয়ে আসে দিনশেষের শ্রান্তি। তারপর চলে যাই বাসায়। এফ স্ট্রীটে - দশ মিনিটের পথ। হেঁটে হেঁটে, দু’একটা সুর ভাজতে ভাজতে। মেয়েটাকে দেখছি এক সপ্তাহ ধরে। আমি এসে দেখি বসে আছে, প্রতিদিন, একই টেবিলে। একেকদিন একেক সাজে, একেক রঙে। হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেবার মতো অনুভূতি, কিংবা ঘেমে নাইবার মতো। খুব সম্ভবত আমি তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। নাহ্‌, ভুল বললাম। নিশ্চিতভাবেই আমি তাকে পছন্দ করে ফেলেছি।

এটাকে প্রেমপিয়াসী তরুণ-মনের আকুতি বলা চলে না। বরং পঁয়ত্রিশে পড়া এক যুবকের দাম্পত্য সূচনার অভিপ্রায় বলাই ভালো। আমি কি কথা বলবো, নাকি অপেক্ষা করবো? ক-ত-দি-ন ধরে বসে আছি একটা শুভ পরিণতির জন্য! একটা নিখুঁত/সত্য পারিবারিক আবহ, যার ছোঁয়া আমি কোনদিন পাইনি।

জীবনের প্রথম বারোটা বছরই কেবল বাবা-মা’র সাথে কেটেছে। যখন থেকে নরক শব্দটার মানে বুঝেছি, এটাও বুঝেছি আমি একটা নারকীয় পরিবেশে বড় হচ্ছি। প্রতিদিন ঝগড়া, কুৎসিত গালাগালি, এমনকি মারামারি পর্যন্ত। বাবাকে দেখেছি মাকে বেঁধে পেটাতে। মা-ও একবার ফুলদানী ছুঁড়ে বাবার কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিলো। বেশিদিন থাকতে হয়নি এই যন্ত্রণায়। বাবা একদিন চলে গেলো মাকে ছেড়ে। এলিসিয়া নামের এক নার্সকে বিয়ে করলো। সে ছিলো লম্বা, মোটা এবং বিশালদেহের এক মহিলা। অনেক উইকএন্ড আমি তাদের সাথে কাটিয়েছি। মন্দ নয়। মা-ও বিয়ে করলো, ঝাঁকড়াচুলো মোছওয়ালা এক স্প্যানিশ কসাইকে। সে ছিলো একজন বোকাসোকা ভালো মানুষ। ওরা সবাই মোটামুটি সুখেই ছিলো। কিন্তু কেউ আমার ছিলো না।

এখনো আমি নিঃসঙ্গ, মহাসমুদ্রের মাঝে একটা জনহীন দ্বীপের মতো। এ দ্বীপে আমি একটা প্রাসাদ বানাতে চাই। স্বপ্নের সেই প্রাসাদে থাকবে আমার স্বপ্নের হরিণী। কিন্তু কোথায় সে? সামনের মেয়েটা? ওকি এসে দাঁড়াবে আমার খোলা দরজায়! নাহ্‌, ওর সাথে পরিচিত হওয়া দরকার।

আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো, অবস্থার কোন পরিবর্তন ছাড়াই। আমার স্বপ্নের বাগানে ততদিনে কুঁড়ি থেকে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে দখিনা বাতাস এসে দোল দিয়ে যায়। পরিচয়টা এখন জরুরী হয়ে উঠেছে।

আরো ক’দিন পর, ফেব্রুয়ারীর এক সন্ধ্যায় সর্বাত্মক মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাফেতে ঢুকলাম। মেয়েটা বসে আছে। আমি ওকে দেখতে লাগলাম কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে। বাদামী চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে কাঁধের নিচে, প্রশস্ত কপাল, ধূসর দু’চোখে যেন আশ্রয় নিয়েছে রাজ্যের স্বপ্ন। রক্তিম দুই কপোলের মাঝে উন্নত নাসিকা, আর তার নিচে চুম্বকের মতো আকর্ষনী দু’ঠোঁট। অসাধারন এক মুখশ্রী, অদেখা এক অভিব্যক্তি। উদোম গলার নিচে আটলান্টিকের জলোচ্ছ্বাস ধরে আছে স্ফীত বক্ষ, যেন তীরে আছড়ে পড়ার অপেক্ষায়।সে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো (যেরকম গত কয়েকদিন ধরেই করে আসছে), তবে খুব মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে হলো না। আমাকে অবাক করে দিয়ে এক চিলতে রোদ্দুরের মতো হাসি উপহার দিয়ে উঠে গেলো। এটা ছিলো অপ্রত্যাশিত এক উপহার যার জন্য আমি স্রষ্টাকে তত্‌ক্ষণাত্‌ ধন্যবাদ জানাতে ভুললাম না। হঠাত্‌ই নেয়া এক সিদ্ধান্তে আমি তার পিছু নিলাম।

সে রাস্তার পাশ দিয়ে দৃঢ়, ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে। আমি অনেকটা পেছন থেকে তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। সে একবার পেছন ফিরে আমাকে দেখলো এবং হাসলো। আমি কি ভুল দেখলাম! না, না, তা কি করে হয়! তবে কি সেও আমাকে......? আমার এতদিনের স্বপ্ন কি তাহলে সত্যি হতে যাচ্ছে! সে হাঁটছে। আরেকবার তাকালো পেছনে এবং আবার সেই হাসি। এবার আর কোন সন্দেহ রইলোনা। ওহ্‌ স্রষ্টা, তোমাকে ধন্যবাদ, আবারো।

কিছুদূর এগিয়ে একটা বাসস্টপ। সে সেখানে পৌঁছাতেই একটা বাস এসে দাঁড়ালো। আমার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়ে সে বাসে চেপে বসলো। আমি দ্রুত দৌড়ে কোনমতে বাসটা ধরলাম। এবং সে পেছনে তাকিয়ে দেখলো। নাকি নিশ্চিত হলো আমি উঠেছি কিনা? ওর দু’তিন সারি পর বসার একটা জায়গা পেলাম। বাসটা চলছে, ছন্দময় গতিতে। বাইরে তাকালাম। একের পর এক দোকান আর বাড়িগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিচিত শহরটাকে এর আগে কখনো এত সুন্দর মনে হয়নি। মেট্রোবাসগুলো কি এর আগে কখনো এভাবে চলেছে? রাস্তাগুলো কি কখনো এর আগে এত মসৃণ ছিলো। শহরের বাতাসটা কি কখনো এত স্বাস্থ্যকর মনে হয়েছে? জীবনটাকে কি কখনো এতটা অর্থবহ মনে হয়েছে? কই, না তো! কখনো তো অনুভব করিনি!

মিনিট বিশেক পরে বাস থেকে নেমে পড়লো সে। আমিও। আমি এখন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, চলছি অন্য কারো অদৃশ্য ইশারায়। হাঁটতে লাগলাম ওর পেছন পেছন। তিনটা বাড়ি পর, একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। চাবি বের করে দরজা খুলতে লাগলো। আমি পেছনে এসে দাঁড়ালাম।

‘এসো, ভেতরে এসো’ প্রথম কথা, প্রথম আহ্বান। এর চেয়ে মধুর স্বর কি আমি কখনো শুনেছি? না, এবং এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। সুন্দর, ছিমছাম ঘর। সে দরজাটা বন্ধ করলো।
‘বসো’
আমি বসলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নার্ভাস কন্ঠে বললাম ‘রোয়ান......আ-মি রোয়ান’
‘আমি স্কসিয়া’ হেসে বলল। তারপর আমার পছন্দের পানীয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলো। দুমিনিটের মধ্যে মার্টিনি নিয়ে হাজির হলো। একটা গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিলো।
‘তুমি একাই থাকো?’
‘হা, দু’মাস হলো এখানে এসেছি’

টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিলো। দু’জনেই যখন প্রথম গ্লাস শেষ করলাম। সে উঠে দাঁড়ালো। ‘এবার আমরা আমাদের বিজনেস শুরু করতে পারি।’ বলেই জামার বোতাম খুলতে লাগলো। হতচকিত হয়ে গেলাম। সে যখন পুরো জামাটাই খুলে ফেললো, আমার স্বপ্নপ্রাসাদ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। এরপর সে ব্রেসিয়ারে হাত লাগালো। আমাকে নিরব দেখে অবাক হলো, ‘কি, অপ্রয়োজনীয় পোশাকগুলো খুলে ফেলো!’ সে ততক্ষণে তার ব্রেসিয়ার খুলে ফেলেছে। চূড়ার দীপ্তিবলয়ে হাত রাখলো, ‘বেশি না, মাত্র ৫০০ ডলার। সারারাত, যেভাবে খুশি, যতবার। আমি কিছু মনে করবো না।’

ততক্ষণে আমার প্রাসাদ গুঁড়ো হয়ে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ৫০০ ডলার বের করে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলাম। ‘আসলে আমি একজন স্ত্রী খুঁজছিলাম, যে আমার জীবনের সঙ্গী হবে, আমার সন্তানের মা হবে। আমি দুঃখিত, তোমাকে বিব্রত করলাম।’

ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে এলাম। হাঁটতে লাগলাম একাকী, নিঃসঙ্গ - আগে যেমন ছিলাম, ঠিক তেমনি। এতটা বোকা আমি কি করে হলাম! শহরটাকে এর আগে কখনো এতো বিচ্ছিরি মনে হয়নি।