মিনার রশীদ
যখন কোনো যন্ত্রণা নিয়ে লিখতে বসি তখন নতুন যন্ত্রণা দুয়ারে এসে হাজির হয়। সেই সব অব্যক্ত যন্ত্রণার কোনো শিরোনাম দেয়া সম্ভব হয় না। চারপাশের আলামত দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি আবার সেই ১৯৪৭ সালের আগে ফিরে যাচ্ছি? জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও বিপক্ষ শক্তি হিসাবে ভাগ করে এই দেশটি শাসন করবে ভিন্ন নামের সেই জমিদার ও সেই কোতোয়ালগণ? এই জমিদারদের আগলে রাখবে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে আতঙ্কগ্রস্ত কিছু লুটেরা এবং ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত কিছু সুশীল ও মোসাহেবের দল? শুদ্ধ উচ্চারণে ‘আসসালামু আলাইকুম’ শুনেও শিক্ষক নামের এই মূর্খরা কেঁপে ওঠে!
কষ্টের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে মাঝখানে একটু হাসতে পারলে ভালো হয়, মগজ নাকি একটু ক্লিয়ার হয়। কাজেই একটা গল্প বলে নেই। জাহাজে চাকুরিকালীন জুনিয়র লাইফের গল্প। একবার আমাদের এক সিনিয়র ভাইয়ের উপর দায়িত্ব পড়ে দোভাষীর। এখন অনেক শিক্ষিত ছেলে জাহাজে নাবিক হিসাবে যোগদান করলেও আগেকার সময়ের অধিকাংশই ছিলেন বকলম বা স্বল্প শিক্ষিত। ইংরেজি তো দূরের কথা শুদ্ধ বাংলা বা তার কাছাকাছি উচ্চারণ করা এদের অনেকের পক্ষে কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ত। সেই বড় ভাই ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলেন, সুকানি সাব বলেন আপনার কী সমস্যা? সুকানি শুরু করে, “প্রথমে ব্যথাটা ধড়ফড়াইয়া নিচ থাইক্যা উপরের দিকে উঠে, তারপর চিনচিনাইয়া মাঝখান থাইক্যা হিরহির মাইরা ভনভন কইরা উঠে!” সেই বড় ভাই জাহাজি আড্ডায় আরো কিছু শব্দ বলেছিলেন। সবগুলো এখন স্মরণে আসছে না। ধড়ফড়ানো, ভনভন, হিরহির, চিনচিনানো ইত্যাদি শব্দগুলো নিয়ে বেচারা মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন! এসবের কী ইংরেজি করবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। রোগীর ব্যথার চেয়েও দোভাষীর অনুবাদের কষ্ট ডাক্তার সাবও ঠাহর করে ফেললেন। দোভাষীর অনুবাদের চেয়ে রোগীর মুখের কথাই ডাক্তার বেশি বুঝে ফেললেন।
ব্যথা বা বেদনা প্রকাশে এই চিনচিনানি, ভনভন, হিরহির, ধড়ফড়ানি শব্দগুলিকে আমার কাছে অতুলনীয় মনে হয়। জাতির নানা ব্যথা প্রকাশে এই ধরণের আরো কিছু শব্দ থাকলে খুবই আরাম পাওয়া যেতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ও খবর ভাইরাল হয়েছে। সেই ছবিটি থেকে জাতির মনে এমনই চিনচিনানি ব্যথা উঠলেও তা ভদ্র ভাষায় অনুবাদ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অভিষেক দাস নামক এক উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাহাদুর নায়কের ভঙ্গিতে হাত দুটি বুকের উপর ও পা দুটি আগে পিছে রেখে বিশেষ স্টাইলে দাঁড়িয়েছেন। পাশে মুসলিম নামধারী গোপালী ওসি চামচার মত আনকুথ ভঙ্গিতে হাত কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে অভিযুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক কিংবা মোতাওয়াল্লীদের কেউ এবং আশেপাশে উৎসাহী কয়েকজন তালেবে এলেম। দৃশ্যটির বাস্তব দৃশ্যায়ন ঘটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরে। উক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক একটি গর্হিত কাজ করেছেন। তিনি জাতীয় সঙ্গীতের সুরে একটি ইসলামী সঙ্গীতের সুর করেছেন। উক্ত অপরাধে সেই মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছেন সেই উপজেলার মহা ক্ষমতাধর নির্বাহী অফিসার অভিষেক দাস।
বর্তমানে দাস/সাহা শব্দ শুনলেই অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। আবার সেই দাস/সাহা যদি হন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কিংবা ডিসি তাহলে তো কথাই নেই। সমমর্যাদার একজন সংখ্যালঘু অফিসার ধর্মনিরপেক্ষ ইন্ডিয়ায় বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। যদিও সেখানে অফিসিয়ালি শতকরা বিশ ভাগ মুসলিম এবং আনঅফিসিয়ালি এই সংখ্যা শতকরা ত্রিশ ভাগ। বাম শাসিত পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের সংখ্যা ত্রিশ ভাগ হলেও সরকারী চাকুরিতে মুসলিম ডেমোগ্রাফিক প্রতিনিধিত্ব মাত্র দুই-তিন শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এই সংখ্যা আরো শোচনীয়। তারপরেও অগত্যা ক’জন পাওয়া গেলেও এই দাস মহাশয়ের মত একই কিসিমের কাজ করার হিম্মত কি আসলেই দেখাতে পারতো? শেখ-টেক নামের কয়েকটা কুলাঙ্গার লুটেরাকে সামনে রেখে দেশটিকে শাসন করছেন এই দাস/সাহারা?
কাজেই এই যন্ত্রণার কোনো শিরোনাম নেই, এই যন্ত্রণা লাঘবের কোনো উপায় সামনে নেই। এই সাহারা একেক জন অতি পরাক্রমশালী জমিদার হয়ে পড়েছেন। রহিম-করিম নামের জমিদারও রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু কিছু অভিষেক দাস ও প্রদীপ কুমারদের উৎসাহ চোখে পড়ার মত। দেশীয় আইন ধরে আনার কথা বললে এরা বেঁধে নিয়ে আসে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য অভিষেক সাহাকে সাম্প্রদায়িকভাবে স্পর্শকাতর এই কাজটি করতে একবারও চিন্তাভাবনা করতে হয় নাই। অথচ এটি নিয়ে লিখতে আমার মত রহিম-করিম আব্দুলকে শতবার চিন্তা করতে হচ্ছে। কোন শব্দটি সরিয়ে কোন শব্দটি বসালে সাম্প্রদায়িক গন্ধ মুক্ত হবে তাতে মগজ মনে হয় অর্ধেক খালি হয়ে গেছে।
অভিষেক সাহাদের সুবিধা হলো ওরা নিজেদের সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে চেতনার ক্যাপসুলে লুকিয়ে ফেলে। কিছুদিন আগে বাঙালী সংস্কৃতির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেম সাহেব এক কুকুরের গায়ে আমাদের জাতীয় পতাকা জড়িয়েছিল। তখন কোনো অভিষেক সাহার শরীরে বা মনে কোনোরূপ আঘাত লাগে নাই। আজ জাতীয় সঙ্গীতের সুরে হামদ গাওয়াতেই চেতনার ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। বাঙালী চেতনার ঐ মেম সাহেব যদি তার প্রিয় কুকুরের গায়ে প্রিয় জাতীয় পতাকা জড়াতে পারে তবে এক মাদ্রাসা শিক্ষক তার বিশ্বাস ও আবেগের জায়গা থেকেই জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মানিত করতেই পারে।
জাতীয় সঙ্গীতের এই সুরটিও রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব সুর নয়। সেই সুরটিও তিনি নিয়েছেন গগন হরকরা নামক এক কবিয়ালের গান থেকে। সেই সুর নকল করে রবীন্দ্রনাথ অন্যায় করেন নাই। বরং একই কাজ করে ঐ মাদ্রাসা শিক্ষক এমন মারাত্মক অন্যায় করে ফেলেছেন যে পুরোদমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিই বন্ধ করে দিতে হবে। এই গানের সুর নকল করা যদি অপরাধই হয় তবে ঐ নকলকারীকে অন্য শাস্তিও দেয়া যেত। তা না করে এভাবে একটা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে? অভিষেক সাহাদের এই অতিরিক্ত উৎসাহটুকু সত্যিই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই অভিষেক সাহারা উক্ত অপরাধে দেশের সকল মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে পারলেই খুশী হতেন।
প্রিয় পাঠক, জানি না মনের যন্ত্রণাটুকু কতটুকু প্রকাশ করতে পেরেছি। আমি মনেপ্রাণে কখনোই সাম্প্রদায়িক নই। কোনো সম্প্রদায়কে কখনোই হীন চোখে দেখি না। যে কাজটি করি তাহলো নিজের সম্প্রদায়ের উপর অবিচার ও জুলুমটিকে অন্যান্যদের মত মেনে নিতে পারি না।
অসহায় হিন্দুদের উপর অবিচার হয় সেটাও স্বীকার করি। তা দেখে বেদনার্ত হই, মনে আঘাত পাই। স্কুলে থাকতে সমবয়সী ও দুষ্টু প্রকৃতির এক চাচার উৎসাহে পাশের হিন্দু বাড়িতে বড়ই কুড়াতে যাই। আমার সেই চাচা গাছে উঠে ঝাঁকি দেয়। তাতে পাকা পাকা বড় বড় বড়ই দিয়ে পুকুর পাড় ভর্তি হয়ে যায়। বাড়ির মালিকের ছেলে আমাদেরকে দেখে হঠাৎ চুপ করে যায়। আমরা ছিলাম গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী। হিন্দু লোকটির অসহায় চোখ দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। সঙ্গী চাচাকে ধমক দিয়ে আমি সবগুলি বড়ই ফিরিয়ে দিয়ে আসি। এটাই আমার প্রথম ও শেষ এডভেঞ্চার। মেরিন একাডেমিতেও এধরণের এডভেঞ্চারার ছিল রাতের বেলা কোয়ার্টার মাস্টার ও মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে খেজুরের রস ও ডাব খাওয়া। সম্ভবত সেই স্মৃতি বা অপরাধবোধ থেকেই পরবর্তীতে এই ধরণের এডভেঞ্চারে অংশ গ্রহণ করতে পারি নাই। একাডেমির বন্ধুরা/এডভেঞ্চাররা আজ যারা এই লেখা পড়ছেন, তারাও বোধহয় উল্টা সাক্ষী দিবেন না।
আমার ছেলেকে আমার স্ত্রী বলেন আমার চরিত্রের ডুপ্লিকেইট। আমার স্ত্রীর জন্য তাতে কিছু সুবিধা হয়েছে। বাসা নোংরা করা বা এই কিসিমের অনেক ত্রুটির জন্য এক ধমক দিলে দুজনের জন্যই প্রযোজ্য হয়ে যায়। এই ছেলেকে নিয়ে আমরা এক আজব সমস্যায় ভুগেছি। শারীরিক গঠনে সমবয়সী সবার চেয়ে বড় হলেও পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চারা স্কুলে তাকে মারতো। কোনো কোনো স্কুলে সেই টেররদের ভয়ে ক্লাসে যেতে চাইতো না। তার মা উপদেশ দিতেন, টিট ফর ট্যাট পলিসির। সেটা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এতে ওর মা কপাল চাপড়াতো। মা-ছেলের সমস্যা দেখে আমি মিটিমিটি হাসতাম। ছেলে মন থেকেই কামনা করতো, ওর বন্ধুগুলি ভালো হয়ে যাক, ওকে আর না মারুক।
ছেলের মত বাবারও কামনা। অন্য সম্প্রদায় বা দেশ আমার নিজের সম্প্রদায় বা দেশের উপর জুলুম, অবিচার বা খবরদারি বন্ধ করুক। কোনো সম্প্রদায়ের উপরই অন্যায়, অবিচার চাই না। সবকিছু হোক ন্যায্যতার ভিত্তিতে। আমার নিজের সম্প্রদায়ের উপর মানসিক, আর্থিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক, নিপীড়ন ও জুলুম বন্ধ হোক। নিজে সাম্প্রদায়িক না হয়ে এই বিষয়টি কিভাবে অর্জন করা যায় সেই রাস্তাটিই খুঁজে পাচ্ছি না।
এই না পাওয়ার যন্ত্রণাটিই আজ শিরোনামহীন যন্ত্রণা হয়ে বিঁধছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন