আমীন আল রশীদ
বাংলাদেশ তো বটেই, সম্ভবত বিশ্ব রাজনীতিতেই এইচ এম এরশাদ সেই বিরল শাসকদের একজন, যিনি বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখলের পর গণআন্দোলনের মুখে গদিচ্যুত এবং দীর্ঘদিন কারাবরণের পরও মূলধারার রাজনীতিতে বহাল তবিয়তে আছেন।
দ্বিতীয়ত এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি (জাপা) সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী একটি দল, যারা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একইসাথে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছে; যাদের কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘সরকারি বিরোধী দল’ শব্দটি নতুন মাত্রা পেয়েছে।
বয়স বেড়ে গেলে অনেক কিছুরই খেই থাকে না। আবার আমাদের দেশে যেহেতু রাজনীতিবিদদের অবসরে যাওয়ার রেওয়াজ নেই বা মৃত্যু পর্যন্ত তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার বৃত্তে থাকতে চান, ফলে মানুষ তাদের নিয়ে যত হাসাহাসিই করুক না কেন, তারা এগুলো আমলে নেন না বা নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না।
নিয়মিত বিরতিতে জাতীয় পার্টি দেশের রাজনীতিতে যেসব ঘটনার জন্ম দেয়, তাতে এই দলটিকে এখন ‘অস্থির পার্টি’ বলেও অভিহিত করা যায়; যে অস্থিরতার সবশেষ উদাহরণ সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদেরকে সরিয়ে দেয়া।
এই সিদ্ধান্তের আগের দিন তাকে দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়। সাংগঠনিক ওই নির্দেশনায় জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে সংগঠন পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ আনেন এরশাদ। তবে চিঠিতে এও উল্লেখ করা হয় যে, জি এম কাদের দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য থাকবেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঘন ঘন অবস্থান বদলানোর কথা দেশবাসীর মনে থাকার কথা। রাজনীতিতে ডিগবাজি কী জিনিস, সেটির চমৎকার দৃশ্যায়ন হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেও জাতীয় পার্টিতে চরম অস্থিরতা দেখা দিলে ভোটের দুদিন পর এরশাদ এক বিবৃতিতে জানান, তার অবর্তমানে ভাই জি এম কাদেরই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন এবং কাউন্সিলে তিনিই হবেন চেয়ারম্যান।
এর আগে ২০১৬ সালেও দলে কো-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে সেখানে জি এম কাদেরকে বসিয়ে এরশাদ বলেছিলেন, তার অবর্তমানে কাদেরই দলের হাল ধরবেন। কিন্তু এ নিয়ে দলের মধ্যে কোন্দল শুরু হলে স্ত্রী রওশন এরশাদকে ভাইয়ের উপরের স্থানে রাখতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে তাকে সেই পদে বসান এরশাদ।
দশম সংসদে একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকলেও একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টি সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনেই বসে এবং দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ হন বিরোধী দলীয় নেতা এবং তার ভাই জি এম কাদের উপনেতা। কিন্তু কাদেরকে উপনেতার পদ থেকে সরানোর পরদিনই স্পিকারকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, এখন থেকে সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার আসনে বসবেন রওশন এরশাদ—আগের সংসদেই যিনি ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা।
এবার জি এম কাদেরকে এভাবে সরিয়ে দেয়ার নেপথ্যে যে দলীয় কোন্দল, বিশেষ করে দলে যে চেয়ারম্যান এরশাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটিই প্রমাণিত হয়। কারণ জি এম কাদেরকে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং এরশাদ এবং তার দুই মাসের মাথায় তাকে এই পদ এবং তারপরদিনই সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকেও সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত যে তিনি নিজে নিয়েছেন, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
জাতীয় পার্টি সম্পর্কে যারা মোটামুটি খোঁজ-খরব রাখেন তারা জানেন এখানে এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশন এরশাদের বিরোধ প্রকাশ্য। দলের নেতাদের প্রভাবশালী অংশটিই মূলত রওশনের সঙ্গে আছেন বলে শোনা যায়। কিন্তু জি এম কাদের রওশনপন্থি নন। তিনি ভাইয়ের প্রতি অনুগত। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে বিতর্কিত ও সমালোচিত রুহুল আমিন হাওলাদারকে দলের মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটে জি এম কাদেরকে নিজের অবর্তমানে দলের কাণ্ডারি হিসেবে মনোনীত করেন এরশাদ।
ব্যক্তিজীবনে সৎ-সজ্জন ও ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিতি জি এম কাদেরকে দলের সিনিয়র নেতাদের একটি বড় অংশই মানছিলেন না। বলা ভালো, মি. কাদের যেভাবে দল পরিচালনা করতে চাচ্ছিলেন, অন্য নেতাদের সেই তরিকা পছন্দ নয়। যাদের অনেকের কাছেই ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়ী স্বার্থই প্রধান। ফলে তারা জিএম কাদেরের বিষয়ে দলের চেয়ারম্যানের কান ভারী করা এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
আবার দলের ভেতরে এরশাদের যেহেতু একক নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে কাদেরকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া এরশাদের সামনে কোনো পথ ছিল না—এমনটিও বলা হচ্ছে। তবে এই ঘটনায় এটি আরও একবার প্রমাণিত হলো যে, রাজনীতিতে ভদ্রলোকেরা বরাবরই সংখ্যালঘু। এখানে টিকে থাকার একটি বড় অস্ত্র ষড়যন্ত্র, ল্যাং মারা এবং নিজে দুর্নীতি করে অন্যদের সেই দুর্নীতির চক্রে বেঁধে ফেলা।
জাতীয় পার্টি এই যে কিছুদিন পরপরই একেকটা কর্মকাণ্ড করে সংবাদ শিরোনাম হয়, তাতে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম এই দলটির সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা ক্রমশ আরও শক্ত হয়। এরশাদ এখন সবচেয়ে প্রবীণ জীবিত রাজনীতিবিদ, কিন্তু রাজনীতিতে সবচেয়ে হাস্যকর চরিত্রও বটে।
বয়স বেড়ে গেলে অনেক কিছুরই খেই থাকে না। আবার আমাদের দেশে যেহেতু রাজনীতিবিদদের অবসরে যাওয়ার রেওয়াজ নেই বা মৃত্যু পর্যন্ত তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার বৃত্তে থাকতে চান, ফলে মানুষ তাদের নিয়ে যত হাসাহাসিই করুক না কেন, তারা এগুলো আমলে নেন না বা নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না।
অনেকের মনে এমন প্রশ্ন আছে যে, এরশাদ কেন বারবার ভোল পাল্টান? এর প্রধান কারণ সম্ভবত তার জেলভীতি। গণআন্দোলনের মুখে নব্বইয়ে ক্ষমতা ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিএনপি শাসনামলের পুরোটা সময় জেলে কাটান সাবেক এই সেনা প্রধান। তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি যতদিন এরশাদকে কাছ থেকে দেখেছি, মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে জেলের চেয়ে বেশি ভয় সে আর কিছুকে পায় না। ’
শেখ হাসিনার কারণে তার দল ভেঙে গেছে, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা জাতীয় পার্টি করেছে- এ নিয়ে তার যতটা রাগ, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্রোধ জেলে নেওয়ার কারণে। একই কারণে তার রাগ দেখেছি খালেদা জিয়ার প্রতিও। জীবনে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি সময় জেল খেটেছে সে তার কারণে।
এরশাদের এই জেলভীতিকে কাজে লাগিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দু দলই। অর্থাৎ এরশাদ যখনই বেঁকে বসেছেন তখনই তার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো চাঙ্গা করা হয়েছে। আবার এরশাদ যখন বাগে এসেছেন, তখন মামলার ফাইল চাপা দেওয়া হয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এরশাদকে বশে আনতে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হলেও বর্তমানে যে দুটি মামলা চলমান, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মঞ্জুর হত্যা মামলা। এই মামলায় এরশাদসহ মোট পাঁচজনের বিচার চলছে। এর মধ্যে এরশাদ অভিযোগপত্রভুক্ত প্রধান আসামি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে এরশাদের নির্দেশে কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
ফলে শেষ বয়সে এসে এরশাদ আর জেলে যেতে চান না। চান না বলেই তিনি বারবার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন। সেইসাথে দলের ভেতরে যেহেতু ঐক্য নেই এবং খোদ স্ত্রীর সঙ্গেই তার বিরোধ তুঙ্গে, ফলে তিনি সকালে যা বলেন, দুপুরে তা বদলে ফেলেন; বিকেলে আরেকটা বলেন এবং রাতে বলেন ঠিক তার বিপরীত।
লেখক : সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন