মেরী জোবায়দা
বোরকা পরা বা হিজাব করার সাথে জামায়াত-শিবিরের কতটা সম্পর্ক, আমার জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিএস ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রব্বানী হিজাব’কে শিবিরের সাথে ব্যবহার করে আওয়ামীলীগের ক্ষতিই করেছে। তবে হিজাবের সম্পর্ক সরাসরি যার সাথে জড়িত, তা হলো ধর্ম হিসাবে ইসলাম এবং নারী স্বাধীনতার। হিজাব শিবিরের কোন লোগো নয়, এটি ইসলামের লোগো। গত ১৩ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলের গেটে ছাত্রলীগ নেতা রব্বানী কর্তৃক হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে উস্কানিপূর্ণ মন্তব্যের ভিডিও চিত্র দেখে হিজাবের সাথে জামায়াতের সম্পর্ক এবং হিজাবের সাথে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বিষয়ে নানা কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আমার ও আমার মতো আরো অনেকেরই।
যা যা মনে এসেছে তা হলো-
এক:
* হিজাব কোন রাজনৈতিক দলের ইউনিফর্ম নয়। এটি একটি ধর্মীয় ইউনিফর্ম, যদিও অনেকে তা পালন করেন না।
* হিজাব নারী স্বাধীনতার প্রতীক। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক দল যেখানে হিজাব পরিধানকারীদের মন্দ কথা বলে, সেখানে একজন নারীর হিজাব ধরে রাখাটা একটা মস্তবড় স্বাধীন মনের পরিচয়।
** কিছু নারীদের জন্য হিজাব তাদের সততার পরিচায়কও বটে। ধর্মীয় কারণে হিজাবের নির্দেশ উপেক্ষা না করে সামাজিক অসস্তির মুখামুখি দাঁড়িয়ে নিজের বিশ্বাস ও সততার উপর অনড় থাকা।
দুই:
* আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে হিজাব অফিসিয়ালি নিষিদ্ধ কি না?
* ছাত্রলীগ করা অবস্থায় কেউ হিজাব পরিধান শুরু করলে এ সংগঠনে তার অবস্থান কোথায় থাকে? তাকে কি পদে পদে নাজেহাল করা হয়, নাকি বরখাস্ত করা হয়, নাকি তার স্বাধীনতাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করা হয়?
* ছাত্রলীগ নেতা রব্বানীর এ ধরনের মন্তব্যের পরে যারা হিজাবী পরিবারের, যাদের আত্মীয় স্বজন হিজাব করেন, বা যাদের কাছের বন্ধুটি হিজাবী, তারা এ দলটিকে কিভাবে গ্রহণ করবে? তারা কি আর ছাত্রলীগে যোগ দিবে? ছাত্রলীগে ইতিমধ্যে থেকে থাকলে তারা কি আর এ দলকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতে পারবে?
* হিজাব যদি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অন্তরায় না হয়, ইসলাম ধর্মের এ নির্দেশ যদি দলের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, রব্বানীর এ মন্তব্যের কারণে তাকে কি পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কেউ সমালোচনা করেছে? বা নারী স্বাধীনতার বিশ্বাসী ছাত্রলীগ নেত্রীর কি তাদের সহপাঠীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নিন্দা জানিয়েছে?
* ছাত্রলীগ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে একি বৈষম্যকারী দল? ছাত্রলীগে কি নারী স্বাধীনতাকে সম্মান করা হয়, নাকি হয় না?
এবার আসি আমার নিজের ঘটনায়। আমি অনেক মানুষের চেয়ে কম ধার্মিক। ধর্মের সবকটা স্তম্ভ গুনে গুনে ঘড়ির কাটা ধরে পালন করায় আমার শাশুড়ীর সাত সীমানার মধ্যেও আমি নেই। কিন্তু হিজাব পরি। ১. ধর্মীয় কারণে। ২. নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসের কারণে।
অষ্টম শ্রেণীতে থাকা কালে আমি আমার বাবার কাছে এপ্রোন কিনে দিতে অনুরোধ করি। বাবা নারাজ। তিনি মনে করেছিলেন, এই চঞ্চল মেয়ে যে স্কুলের ছুটি শেষে সারাদিন বাইক চালিয়ে বেড়ায়, সে হিজাবের কি মর্যাদা বোঝে! এক সপ্তাহ পরে আলটিমেটাম দিলাম- এপ্রোন ছাড়া স্কুলে যাব না। বাবা বললেন দরকার নাই। এভাবে তিন সপ্তাহ স্কুল কামাই করার পরে বাবা এপ্রোন কিনে দিলেন। আর সেই এপ্রোন পরে আমি স্কুলে গেলাম। নারী হিসাবে হিজাব আমার সেই কম বয়সে দাবী আদায় করা অধিকার।
আমেরিকায় আসি ৯/১১এর দুই মাস পরে। রাজনৈতিক ভাবে সেই গরম সময়েও এ কাপড়ের টুকরোটা ধরে রাখি। তারপর পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করি এ হিজাব মাথায় রেখেই। এ দেশে কোন দিন কেউ আমাকে হিজাবের কারণে খাট করেনি। বরং সম্মান করেছে। যখন রাজনীতিতে নামা নিয়ে ভাবছিলাম, তখন সবাই এগিয়ে এসেছে সাহায্য করতে। আমার একই পদে নির্বাচন করবে বলে দু’জন তৈরি ছিলো- একজন সাদা এলজিবিটি পুরুষ, আরেকজন হিসপানিক খ্রিস্টান নারী। কথা বলে দু’জনেই আমাকে সমর্থন দিয়ে নিজেদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছে। হিজাব এখানেও কোন কু-প্রভাব ফেলেনি। অথচ, বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে হিজাব পরা নারীদের এতটা অসম্মান করে রাজনীতিতে কীভাবে টিকে থাকে একজন? এটা তো তার রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল।
এখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাবী নারীদের আনাগোনা বেড়েছে, এটা তো নারীদের উন্নয়নের লক্ষণ। ধর্মীয় উদরতার প্রকাশ।
হিজাব আগেও ছিল, এখনও আছে। আগে হিজাবীদের স্কুল গন্ডি পার হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে বিদেয় করা হতো। আর আজ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে পদচারণা করে। দেশ হিসাবে এটা বাংলাদেশের জন্য কত বড় নারী উন্নয়নে অগ্রগতি!
রব্বানীর উচিত, খুব দ্রুত হিজাবীদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। মানুষ ভুল করে। ক্ষমা চাওয়া ভুল ও ইচ্ছাকৃত অপরাধের মধ্যে পার্থক্য করে।
-মেরী জোবায়দা, সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার, টাইম টেলিভিশন, নিউ ইয়র্ক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন