ড. মো. নূরুল আমিন : দু’টি বিয়োগান্তক ঘটনা দিয়ে আজকের কলাম শুরু করছি। প্রথমটি হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রূপকার ইসলামী ঐতিহ্য ও পুনর্জাগরণের কবি আল মাহমুদের ইন্তেকাল। গত শুক্রবার রাত ১১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ এবং বহু প্রতিভার অধিকারী। ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্যের উপর তার ঈর্ষণীয় দখল ছিল এবং তিনি তার পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখতেন। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষার উপর তার ব্যুৎপত্তি ছিল প্রশংসনীয়। এগুলো তিনি অর্জন করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে। কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সাহিত্যে তার বিচরণ ছিল অবারিত। তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণেও অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। সাহিত্যের ইসলামীকরণে তার অবদান অনস্বীকার্য। ব্যক্তি জীবনে কবি আল মাহমুদের সাথে আমি প্রায় পাঁচ বছর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে একই কক্ষে পাশাপাশি বসে কাজ করেছি, আড্ডা দিয়েছি। আমার তৎকালীন সাথীদের মধ্যে সালাউদ্দিন জহুরী, জুলফিকার আহমদ কিসমতি এবং আমীর খসরু আগেই বিদায় নিয়েছেন। আল মাহমুদও বিদায় নিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের একজন মহিরূহ। আল্লামা ইকবাল ও কবি ফররুখ আহমদের পরেই তার স্থান। তার স্নেহ ভালবাসা এবং শিশুসুলভ আচরণের কথা আমি কখনো ভুলব না। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাভুত।
দ্বিতীয় বিয়োগান্তক ঘটনাটি হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ। পদত্যাগপত্রে তিনি দু’টি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, জামায়াত ’৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি এবং একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে নিজেদের সংষ্কার করতে পারেনি। তিনি বলেছেন, ‘আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেই। অন্যকোন বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমার তিন দশকের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে... এই ক্রমাগত ব্যর্থতা জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী দল হিসাবে গণ্য করতে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। তিনি আরো লিখেছেন, ‘এর ফলে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশবিমুখ দলে পরিণত হয়েছে। জামায়াতে যোগদানের পর দলের ভেতর থেকেই সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানিয়ে জনাব রাজ্জাক আরো বলেন, দলের কাঠামোগত সংস্কার, নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, জামায়াতের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিতে আমূল পরিবর্তন আনতে তার প্রস্তাবগুলো গত ৩০ বছরে ইতিবাচক সাড়া পায়নি।
জনাব রাজ্জাকের পদত্যাগে জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল. ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ব্যারিস্টার রাজ্জাকসহ আমরা দীর্ঘদিন একই সাথে কাজ করেছি। তিনি জামায়াতের সিনিয়র পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন। দলে তার সব অবদান আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যে কোন সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি, তিনি যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ডা. শফিকের বিবৃতিটি সংক্ষিপ্ত এবং শালীন। এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ও আন্দোলনের নিবিড় পর্যবেক্ষক বিশিষ্ট গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জনাব শাহ আবদুল হান্নান বলেছেন, জামায়াতের মধ্যে কোন সংস্কার হয়নি মর্মে বক্তব্যটি সঠিক নয়। এর মধ্যে জামায়াতের কার্যক্রমে অনেক সংস্কার ও অগ্রগতি হয়েছে। জামায়াত নারীদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছে। উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেছে অনেককে। জামায়াতের নারী সদস্যের সংখ্যা এখন পুরুষের অর্ধেকের কাছাকাছি। মেয়েদের রুকন করার ব্যাপারে কড়াকড়ি অনেক শিথিল করা হয়েছে। দলে সংখ্যালঘু সদস্য করা হয়েছে ৮০ হাজারের কাছাকাছি। সামনে এ সংখ্যা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
জনাব শাহ হান্নান পাকিস্তান জামায়াত ও বাংলাদেশ জামায়াত এক নয় বলে উল্লেখ করে বলেন যে, বর্তমান জামায়াতে ইসলামী ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার সময়ের ভূমিকার জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়। এরপরও জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম উচ্চ আদালতের রায়ে নাগরিকত্ব ফিরে পাবার পর বায়তুল মোকাররমে এক বিশাল জনসভায় ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
জামায়াতের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে শাহ আবদুল হান্নান বলেন, রাজনৈতিক দলের কিছু ঐতিহাসিক নাম রয়েছে, যেমন মুসলিম লীগ ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রয়েছে। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীও ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাতে রয়েছে। ১৯৭৯ সালে এখানে যে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি নতুন জামায়াতে ইসলামী। এই জামায়াতে একেবারেই স্বল্পসংখ্যক লোক রয়েছেন যারা স্বাধীনতাপূর্ব জামায়াতের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, রাজনৈতিক বাস্তবতা এসব কিছু মেনে নিয়েই জামায়াত এখানে কাজ করছে। জামায়াতের বিলুপ্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অগ্রজপ্রতীম জনাব হান্নানের সাথে একমত।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক প্রতিভাবান, বিচক্ষণ একজন মানুষ, সিনিয়র একজন আইনজীবী। তিনি দীর্ঘদিন জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তারও আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ইসলামী আন্দোলনের মূখ্য কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় তিনি জামায়াতের একজন আইনজীবীও ছিলেন। ঐ নাগরিকত্ব মামলায় ’৭১’র গণহত্যার জন্যও অধ্যাপক গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং জেনারেল টিক্কা খানের সাথে তার সাক্ষাৎকে প্রমাণ হিসাবে সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। অর্থাৎ অধ্যাপক গোলাম আযম ও তৎকালীন জামায়াত ’৭১ এর গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত ছিলেন না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী তৎপরতার জন্য দায়ী বক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমিটির রিপোর্টে যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত হয়েছিল তার মধ্যে জামায়াতের কেউ ছিল না। ঐ সময়ে জামায়াতের কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগও ছিল না। হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাদের মধ্যে জামায়াতের কেউ ছিল না। ৪৭ বছর পর আওয়ামী লীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যে অভিযোগ এনেছে তা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে দেশবাসী মনে করে।
আমি একাত্তরের ভূমিকার কথা বলছিলাম। এই ভূমিকার দুটি অংশ- একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তজনিত, আরেকটি অপরাধজনিত। জামায়াত কোনও অপরাধ করেনি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অভিযোগ, গ্রেফতার, মামলাই তার প্রমাণ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৯৪ সালের ২৩শে জুন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তার বক্তব্যে জামায়াতের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন- ‘রাজনৈতিক ময়দানে যারা কাজ করেন, বিভিন্ন দলের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং এই পার্থক্যের কারণে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও ভিন্ন ভিন্ন হয়। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয় এবং এক দলের সিদ্ধান্ত আরেক দলের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমাদের যদি কোন ভুল হয়ে থাকে, ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের এবং জনগণের ক্ষতির চেষ্টা আল্লাহর রহমতে কোন দিন আমি করিনি। যা আমরা ভাল বুঝেছি, দেশের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য করেছি। এরপরও মানুষের ভুল হতে পারে। কেউ আমাদের কাজকে ভুল মনে করতে পারেন। তার জন্য তাদের আমি দোষী বলবো না। নবী ছাড়া কে দোষী নয়? দোষ কমবেশি সবারই আছে। তাই যারা আমাদের কাজকে ভুল মনে করেছেন, কোন কাজে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, কোন কাজে ব্যথিত হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন, তাদের সবার কাছে জানাচ্ছি আপনাদের এই বেদনার সাথে আমি শরিক, আমিও দুঃখিত।’
বাংলাদেশে ভিন্ন দলের রাজনীতিক যারা জামায়াতের অস্তিত্ব সহ্য করতে পারেন না, জনাব রাজ্জাকের পদত্যাগে তারা উল্লসিত। পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলসমূহ এখন তাদের উল্লাসে মুখরিত। অনেকে জামায়াতের আসন্ন ভাঙন, এমনকি জামায়াত আমীরের পদত্যাগের প্রস্তুতির কথা বলছেন। অপপ্রচার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রচারে মোড় নেয় এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। সত্যাদর্শী কোনও দল এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
ব্যারিস্টার রাজ্জাককে আমি শ্রদ্ধা করি। তিনি পদত্যাগ করায় নেতৃত্ব সংকটে জর্জরিত জামায়াত ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা সময়ই তা বলে দিবে। তার বক্তব্যের ব্যাপারে আমার সামান্য কিছু মন্তব্য আছে।
জনাব রাজ্জাকের ন্যায় অথবা তার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান সুশিক্ষিত, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরাই জামায়াতের জনশক্তি। কেয়ারটেকার আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, জনকল্যাণ, মানবাধিকার ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যত উদ্ভাবন ও সাফল্য তার অধিকাংশই জামায়াতের। ১৯৭৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতের ভোট প্রাপ্তির যে হারু তা দলটির বর্ধিষ্ণু জনপ্রিয়তারই পরিচায়ক। মহিলা অঙ্গনে তার সাফল্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। জামায়াতের অফিসগুলো বন্ধ। জামায়াত তো শুধু ক্লারিক্যাল কাজ করে না। মাঠ ময়দানই এখন তাদের অফিস এবং গত দশ বছরে তাদের উপর যত নির্যাতন হয়েছে, তাদের কাজের পরিধিও তত বেড়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে। রাজ্জাক সাব দীর্ঘদিন দেশে থাকেন না বলে সম্ভবতঃ তা জানেন না। প্রতিপক্ষের টার্গেট জামায়াতের নাম নয়, তার আদর্শ। এই বিষয়টি জানা আবশ্যক যে, জামায়াত তার আদর্শ পরিবর্তন না করলে হাজার বার নাম পরিবর্তন করলেও তারা শান্ত হবে না। জনাব রাজ্জাক জামায়াত বিলুপ্ত করে তিউনিশিয়ার আন নাহদা ও তুরস্কের একে পার্টির ন্যায় দল করার পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের পরিবেশ এবং তিউনিশিয়া ও তুরস্কের পরিবেশ এক নয়। যে নামে যে কাঠামোতেই এখানে পার্টি তৈরি হোক তাতে যদি ইসলামের শক্তিশলী উপস্থিতি থাকে এবং রাজনৈতিক ময়দানে শক্তিশালী অবস্থান পায়, তাহলে সে পার্টিও জামায়াতের মতোই বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। আজ জামায়াত যদি তার আদর্শ ত্যাগ করে এবং রাজনৈতিক ময়দানে গণনার মধ্যে না আসে, তাহলে জামায়াত নিয়েও কথা উঠবে না, যেমন কথা উঠছে না মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দল নিয়ে যারা একাত্তরে জামায়াতের চেয়ে অনেক বড় ভূমিকায় ছিল। আর একামতে দ্বীনের আদর্শই যদি ছাড়তে হয় তাহলে ক্ষমতায় যাবার জন্য নতুন দল করার প্রয়োজন কি। দলতো অনেক আছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। আরও আলোচনা দাবি রাখে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন