আলফাজ আনাম
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয়ের পর এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই দেশ ভারত ও চীনের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে প্রথম অভিনন্দন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টেলিফোনে অভিনন্দন জানান। এর পর পরই চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন আসে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আমরা দেখছি রাশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, কাতার, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, এমনকি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত দাবি করেছে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে কোনো ধরনের দ্বিধা প্রকাশ করেনি।
বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্র্ণ দিকটি হচ্ছে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি জোরালো সমর্থন। এর মধ্য দিয়ে এশিয়ায় প্রভাবশালী দেশগুলোর মেরুকরণের নতুন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ দিয়েই সম্ভবত ভারত আর চীন এ অঞ্চলে ভারসাম্যমূলক সমান্তরাল অবস্থান নিতে যাচ্ছে। দু’দেশ এক সূরে কথা বলছে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল কিংবা মালদ্বীপে এশিয়ার এই দুই দেশের প্রভাব বিস্তারের যে লড়াই সম্প্রতি দেখা গেছে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান আমরা লক্ষ করছি। যা দু’দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও এশিয়ার এই প্রধান দুই শক্তির এক ধরনের গোপন সমঝোতা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। রোহিঙ্গাদের যখন বাংলাদেশে বিতাড়ন শুরু হয় তখন ভারত জোরালো প্রতিবাদ কিংবা নিন্দা করেনি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েও খুব একটা সারা পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে ভারত সমর্থন দিয়েছে। যদিও সম্পূর্ণ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে থেকে চীন ও ভারতের এক সুরে কথা বলা মূলত এশিয়ায় পশ্চিমা শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ দিতে না চাওয়া। চীন এবং ভারতের মধ্যে এই ঐক্য যদি চলমান থাকে তবে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সুচনা হবে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব এই অঞ্চলে অনেকটাই কমে আসবে।
শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত ও চীন পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এসব দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল একটি দেশের পক্ষপুটে চলে গেছে। এসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দু’দেশের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী অবস্থান গ্রহণ করেছে। মোটা দাগে চীনের বিনিয়োগের যেমন সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, তেমনি ভারতের নিরাপত্তা বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল তা দূর করতে নয়াদিল্লিকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে ঢাকা। এর আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের অঙ্গীকার করে ভারত। অবশ্য নানা শর্তের কারনে খুব কমই ব্যবহার করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্পর্ক যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ২০১৬ সালের চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপেং ঢাকা সফর করেন। এ সময় ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়Ñ যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২১ বিলিয়ন ডলার। প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্র“তি ছিল। চীনের এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে দেবে। পদ্মা সেতুসহ দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীনের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। আগামী দিনে এই সম্পর্ক যে আরো জোরদার হবে নতুন সরকারকে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তা খুবই স্পষ্ট। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসে বাংলাদেশের উন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের ধারবাহিকতা কেন দরকার তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে।
মনে রাখতে হবে ভারতের নেতিবাচক মনোভাব সত্ত্বেও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। এই সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় চীনের কনসাল মা ঝাংউ জানিয়েছিলেন যে চীনের বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি বুলেট ট্রেন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা আছে। এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন যে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগিতা পাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১০ বছর শুধুমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর ছাড়া চীনের সব ধরনের বিনিয়োগকে বাংলাদেশ উৎসাহিত করেছে।
বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ আছে। ভারত নিজেই যেখানে চীনা বিনিয়োগের প্রত্যাশী সেখানে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগে ভারতের প্রবল বিরোধিতার সুযোগ নেই। চীনের অপর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ জাপানের বিনিয়োগও বাংলাদেশে বেড়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ খাত ছাড়াও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জাপান বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। জাপানের আরেকটি বড় বিনিয়োগ প্রকল্প হচ্ছে ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট। এই প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে জাপানের বিনিয়োগ সুরক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া ছোট আকারে আরো নতুন কয়েকটি প্রকল্প শুরু করেছে জাপান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর বিনিয়োগ বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কমে আসছে। তবে বাংলাদেশের রফতানি খাতের প্রধান আয়ের উৎস পশ্চিমা বিশ্ব। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান রফতানি বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষণীয় দিক হলো বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তৃতীয় বিশ্বের নির্ভরতার কারণে এসব দেশের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের এক ধরনের খবরদারি ছিল। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীনের অবারিত বিনিয়োগ শুধু এশিয়া নয়, আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর ওপর চীনের প্রভাব বাড়ছে। পশ্চিমের ওপর নির্ভরতা কমছে। উদহারণ হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর মতো মেগাপ্রকল্পে যখন বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানে নানা ধরনের শর্ত আরোপ করছে তখন বাংলাদেশ সহজেই চীনা বিনিয়োগ পেয়েছে। ফলে প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার কোনো ঝুঁকি ছিল না।
বাস্তবতা হচ্ছে, গত এক দশকে এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দিন দিন কমে আসছে। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি এ প্রক্রিয়াকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র আর বিভিন্ন দেশে পুলিশের ভূমিকা পালন করবে না। সম্প্রতি আফগানিস্তান ও সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা এর বড় উদাহরণ। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো কৌশলগত নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তাতে খুব একটা সফল হয়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শেখ হাসিনা সরকারের জন্য রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে আগামী দিনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এশিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব কমে আসার দিকটি শেখ হাসিনা সরকার ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন। এ অঞ্চলে আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আরো বেশি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছে। বাংলাদেশের পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার বিপুল বিনিয়োগ আছে। ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক পরীক্ষিত এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গেও রাশিয়ার সামরিক সম্পর্ক বাড়ছে।
আঞ্চলিক ও পরাশক্তিগুলোর এই নতুন মেরুকরণে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। এর বিপজ্জনক কিছু দিক রয়েছে। নির্বাচনের পর ভারতের গণমাধ্যমে চীনের ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতের বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যেও একই সুর আছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা যত বাড়বে ভারতের মধ্যে এক ধরনের চীন ভীতি কাজ করতে পারে। ইতোমধ্যে ভারতে কিছুটা উসখুস শুরু হয়ে গেছে। এর প্রভাব আগামি দিনে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন