বোরহান আজাদ
অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতাগণ এবং ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন যে, “যারা মধ্যপ্রাচ্যকে শাসন করে, দুনিয়াকে তারাই শাসন করে”। আসলেও সত্যি তাই। যার ফলে মধ্যেপ্রাচ্যে যেন দ্বন্দ সংঘাতের কোন শেষ নেই। সিআইএ র সাবেক মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রধান এবং Rand Corporation এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হলেন গ্রাহাম ফুলার, তিনি অ্যামেরিকার ফরেন পলিসি মেকারদের মধ্যে সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজ্ তিনি তার A world Without Islam নামক গ্রন্থে বলেছেন, পৃথিবীর পট পরিবর্তনকারী সকল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে হয়ে থাকে যার পুনরাবৃত্তি এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে এই কথার সত্যতা দেখতে পাই। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, মুসা (আঃ) এর ইবরানী সভ্যতা, হযরত ঈসা (আঃ) এর খ্রিস্টীয়ান সভ্যতা, এবং মুহাম্মাদ (সঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল এই মধ্যপ্রাচ্যই। যতদিন পর্যন্ত এই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ছিল তখন সমগ্র দুনিয়াতেই শান্তি ছিল। সর্বশেষ উসমানী খিলাফত ছিল বিশ্বশক্তির ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি।
কিন্তু ১৬৮৩ সালে উসমানী খিলাফত যখন ভিয়েনা আক্রমন করে হেরে যায় তখন থেকেই বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ মধ্যপ্রাচ্যে হামলে পড়ে চতুর্দিকে থেকে। তাদের উদ্দেশ্য পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা উসমানী খিলাফতে উৎখাত করার জন্য নানা রকম পরিকল্পনা করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে এই খিলাফতকে বিলুপ্ত করতে সক্ষম হয়।
১৯১৭ সালে বাইতুল মুকাদ্দাসকে দখল করে তাদের পরিকল্পনার প্রথম ধাপকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র ৩ টি দেশ বাতিত সমগ্র মুসলিম বিশ্ব উপনিবেশ হয়ে পড়ে। যে তিনটি দেশ নিজেদের স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পেরেছিল তারা হল, তুরস্ক, ইরান এবং আফগানিস্তান।
তাদের পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপকে বাস্তবায়ন করার জন্য শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে অনেকদূর এগিয়ে যায়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের বিজয় শক্তিরা ইয়াল্টা কনফারেন্সের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে তাদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং সম্পূর্ণ নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের যে মানচিত্র অঙ্কিত হয় বিশ্ব মোড়ল অ্যামেরিকা তা কোনদিন মেনে নেয়নি এই জন্য তারা নতুন করে মানচিত্র আঁকে এবং তা নব্বইের দশকে প্রকাশ করে।
সেই সময়ে ১৯৯২ সালে সর্বপ্রথম তুরস্কের তৎকালীন বিরোধীদল রেফাহ পার্টির নেতা প্রফেসর ডঃ নাজমুদ্দিন এরবাকান সকল যড়ন্ত্রের কথা সংসদে প্রকাশ করেন এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আজ যা হচ্ছে সেটার ব্যাপারে হুবুহু একটি বক্তব্য দেন। ১৯৯২ সালে সংসদের অধিবেশনে তার দেওয়া সে বক্তব্যে তিনি বলেন, “আমেরিকান এক সেনাপতি মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র হাতে নিয়ে বলেন, কুর্দিস্তান এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। যুদ্দ শেষ হবে সাদ্দাম চলে যাবে।
তিনি যখন এই সকল কথা বলছিলেন তখন উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরুই হয়নি। যুদ্ধ শুরূ হওয়ার পূর্বেই তিনি এই সকল কথা বলেন। সাদ্দাম যাওয়ার পরে ইরাকে কোন কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে না যার ফলে তখন ইরাকে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হবে। কুর্দিরা একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এই শুন্যতাকে পুরন করবে এবং তুরস্ক থেকেও তারা ভুমি চাইবে। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তুর্কি যদি না দেয়? তিনি উত্তরে বলেন; তখন তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। তুরস্ক সামরিক ভাবে শক্তিশালি একটি দেশ তাদের সাথে কিভাবে যুদ্ধ করবে? ইরান, ইরাক, সিরিয়া তুরস্ক কি এটা মেনে নিবে? তখন আমেরিকান ওই সেনাকর্মকর্তা বলেন সমস্যা নাই, খুব কম সময়ের মধ্যএই কুর্দিদের কাছেও অস্র থাকবে। সাদ্দাম যে সকল অস্র রেখে যাবে তা তাদের হাতে চলে যাবে। তুরস্কের অস্রের চেয়েও তাদের কাছে আধুনিক অস্র থাকবে। কোন সময় বলেছেন এই সকল কথা? উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্বে।
প্রিয় সংসদ সদস্য বৃন্দ হে জাতির সম্মানিত সন্তানেরা আমি আপনাদের সামনে যা পাঠ করলাম এখান থেকে কি বুঝা যাচ্ছে?
অ্যামেরিকা, ইস্রাইল এবং সাম্রাজ্য বাদীরা এই সকল কাজ পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে নিচ্ছে। তারা দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। তাদের পরিকল্পনা আছে আমাদের কেন কোন পরিকল্পনা নেই? কেন নেই? আমাদের কোন পরিকল্পনা না থাকার ফলে আমরা তাদের পরিকল্পনাকেই বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছি। তারা চায় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ সমূহের মধ্যে যেন কোন সম্পর্ক গড়ে না উথে। তুরস্ক যেন, সিরিয়া, ইরান,ইরাকের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়”।
তিনি যখন এই সকল কথা বলেছিলেন তখন তার এই সকল কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। তিনি আজ থেকে ২৫ বছর আগে যা বলেছেন তা আজ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তখন তাকে বলা হত সে সারাদিন ষড়যন্ত্র তত্ত্বনিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ কুর্দিশ সন্ত্রসী সংগঠন গুলোর (PKK, PYD) হাতে এমন এমন অস্র যা অ্যামেরিকা দিচ্ছে যা তুরস্কের কাছেও নেই। যার ফলে তুরস্ক বার বার অভিযান চালিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতার অংশ হিসাবে অ্যামেরিকা ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমন করে এবং তুরস্ক এই ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। আসুন দেখে নেই সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে আমেরিকার রাজনীতিবিদগণ কে কি বলেছিলেন,
* জর্জ ডাব্লিউ বুশ BBC তে প্রকাশিত একটি ডকুমেন্টারিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করে এই কথা গুলু বলেছিলেন ‘’সৃষ্টিকর্তার পক্ষ (GOD) থেকে দায়িত্ব পেয়েছি । আর এই জন্যই ইরাক এবং আফগানিস্তানে হামলা করেছি। আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘’নবম ক্রুসেড’’ শুরু করেছি।‘’
* যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইস Washington post পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ‘’তুরস্কসহ মরক্কো থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের ২২ টি দেশের মানচিত্র পরিবর্তন করব।‘’
* ডিক চেনী (DİCK CHENEY) আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা কালে অ্যামেরিকান ইন্সিটিউট কর্তৃক আয়োজিত এক সম্মেলনে বলেছিলেন ‘’প্রেসিডেন্ট বুশের ক্রুসেড শব্দকে আমরা সমর্থন করি। আমরা যদি ইরাক এবং আফগানিস্তানে হামলা না করতাম তাহলে তারা ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে ইসরাইলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলত।‘’
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে অ্যামেরিকার মুল টার্গেট হল এখানে শোষণ করা এবং তার পোষারাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের যে “বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য প্রকল্প” রয়েছে সেটাকে বাস্তবায়ন করতে সর্বাত্মক সাহায্য করা।।
আর এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তাদের সামনে যেটি সবচেয়ে বড় বাঁধা তা হল এই অঞ্চলে বড় শক্তিশালি কোন রাষ্ট্র। এই জন্য তারা বড় ও শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব না রাখার জন্য তুর্কিকে ৩ ভাগে ভাগ করেছে। ইস্তানবুল সহ তুরস্কের সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ অঞ্চলেকে আলাদা রাষ্ট্র করার পরিকল্পনা করে ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় মানচিত্রও প্রকাশ করেছে।
উত্তর কুর্দিস্তানের রেফারেন্ডাম ইসরাইলের জন্য একটি বড় বিজয়। এখানে আমি কুর্দি জনগনকে মোটেই দোষারূপ করি না। তাদেরকে আজকের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে সিরিয়া, ইরান, ইরাক এবং তুরস্ক। দীর্ঘ দিন ধরে তারা নির্যাতিত নিপীড়িত হওয়ার কারণেই তারা হয়ত এই পথ বেছে নিয়েছেন।
তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে যখন প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন করে ফেলছে তখন তুরস্ক যেন তার হুঁশ ফিরে পেয়েছে। দেরিতে হলেও তারা ইরাক এবং ইরানের সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। কিন্তু এই মহড়া যদি ৯২ সালে কিংবা ২০০৩ সালে দিত তাহলে হয়ত আজ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসই ভিন্ন হত। দেরিতে হলেও এই মহড়া আশা ব্যঞ্জক। এত হতাশার মাঝেও আমি আশাবাদী যে, ইনশাল্লাহ তুরস্ক, ইরান এবং মিশর এই তিনটি দেশ মিলে অ্যামেরিকা ও ইসরাইলের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সক্ষম হবে। কেননা এই তিনটি দেশ কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ ৮ টি সাগর এবং ৪ টি প্রনালীকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। এই ৩ টি দেশের সমৃদ্ধ অতীত এবং ইতিহাস প্রমান করে তারা এই কাজ করতে সক্ষম।।
বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য প্রকল্প কি? https://www.facebook.com/notes/884699764929514/
কুর্দি সমস্যা ও সমাধানঃ http://imbdblog.com/?p=6543 লেখাটি ২০১৫ সালে তৎকালীন সময়ে লেখা এখন অনেক পরিবর্তনযোগ্য।।
-ছবিতে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র এবং তুরস্কের নতুন মানচিত্র
পাঠক মন্তব্য
prithibirr..shov iitramii-derr..kothinn bisarr..hobeii..hobe..shaaraa..deshe..deshe.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন