নানাবিধ দুশ্চিন্তা ও হতাশার কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়, এটাকে মানসিক চাপ বলে। মুসলমান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে মানসিক চাপসহ এমন কোনো রোগ নেই যার চিকিৎসা আল্লাহতায়ালা দেননি। মানসিক চাপ উত্তরণে ইসলামে রয়েছে অনেক দিকনির্দেশনা। যা মেনে চললে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়। তা হলো-
কোরআন তেলাওয়াত : কোরআনে কারিম তেলাওয়াত মানুষের অন্তরকে প্রফুল্ল করে, এটা মুমিনের প্রফুল্লতার অনন্য উৎস। শুধু তাই নয়, কোরআন তেলাওয়াতে মানসিক প্রশান্তি বাড়ে। কোরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ সব ধরনের দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে থাকে মুক্ত।
নামাজ : যেকোনো বিপদ-মুসিবত, পেরেশানির সময় নামাজের মাধ্যমে প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করা যায়। কেননা নামাজের মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর সাহায্য লাভ করেন। তাই মানসিক প্রশান্তি লাভে নামাজের ব্যাপারে যতœবান হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা করো। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।’ -সুরা বাকারা : ৪৫
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেকোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজ আদায় করতেন।’ -সুনানে আবু দাউদ
সাহাবায়ে কেরাম এ আমলে অভ্যস্ত ছিলেন। ছোট থেকে ছোট কোনো বিষয়ের জন্য তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও নামাজের মাধ্যমে সমাধান করতেন।
ইস্তেগফার : মানসিক চাপ সামলাতে বেশি বেশি ইস্তেগফারের কোনো বিকল্প নেই। যেসব কারণে মানুষ চাপে পড়ে, তন্মধ্যে অন্যায়-অপরাধ বেশি করা, অর্থকষ্টে থাকা, সন্তান-সন্তুতি না থাকা, জীবিকার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। এ সবের সমাধানে কোরআনের নির্দেশ হলো- বেশি বেশি ইস্তেগফার করা। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ -সুরা নুহ : ১০-১২
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে, আল্লাহতায়ালা তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন। তার সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ -সুনানে আবু দাউদ
দরুদ পাঠ : দরুদ পড়লে আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি রহমত নাজিল করেন। এ রহমত মানুষকে যাবতীয় মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখে। এটি আত্মপ্রশান্তি লাভের সহজ উপায়ও বটে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠ এমন একটি ইবাদত, আল্লাহতায়ালা তা কবুল করে নেন।
তাকদিরে বিশ্বাস : সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ সবকিছুর ক্ষেত্রেই মুমিন বান্দা তাকদিরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে। আর দুঃশ-হতাশা, অভাব-অনটন, বিপদ-আপদে তাকদিরের ওপর বিশ্বাস থাকলে কোনো মানুষই মানসিক চাপে ভোগে না। তাই মানসিক চাপের সময় মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাকদিরের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় রয়েছে মানসিক প্রশান্তি। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা মোচন করতে পারে না। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তার অনুগ্রহ পরিবর্তন করারও কেউ নেই।’ -সুরা ইউনুস : ১০৭
হতাশ না হওয়া : অনেক ক্ষেত্রেই হতাশা থেকে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। তাই দুনিয়ার জীবনে বিপদ-আপদে হতাশ না হওয়া ইমানদারের কাজ। যেকোনো সময়, যেকোনো ধরনের বিপদ-আপদ আসতে পারে এ মানসিকতা সব সময় পোষণ করা। ফলে তা মানুষকে বিপদে হতাশা থেকে রক্ষা করে মানসিক চাপমুক্ত রাখে। কোরআনে কারিমে এসব বিপদ-আপদ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তার কাছেই ফিরে যাব।’ -সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬
পরকালের কথা স্মরণ : মৃত্যুর স্মরণ মানসিক চাপকে একেবারেই মিটিয়ে দেয়। পরকালের কঠিন পরিস্থিতির কথা স্মরণ রাখলে দুনিয়ায় মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে মানুষের দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তখনই মানুষ থাকে মানসিক চাপমুক্ত। কারণ পরকালের তুলনায় দুনিয়ার বিপদ-আপদ একেবারেই নগণ্য। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে।’ -সুরা নাযিয়াত : ৪৬
আল্লাহর প্রতি ভরসা : মানসিক অশান্তি থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর প্রতি ভরসার কোনো বিকল্প নেই। কেননা তিনি বলেছেন, ‘যে আল্লাহর প্রতি ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ -সুরা তালাক : ৩
সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি ভরসা করতে জানে তার জন্য কোনো চিন্তা নেই। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ ঘোষণা করেন, আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ সহিহ বোখারি
দোয়া : মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত দোয়া করা। হাদিসে দোয়াকে ইবাদতের মূল বলা হয়েছে। দোয়া করলে, কোনো কিছু চাইলে মহান আল্লাহ খুশি হন। না করলে বরং অসন্তুষ্ট হন। তবে দোয়ার ক্ষেত্রে হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এমন একটি দোয়া সম্পর্কে জানি, কোনো বিপদে পড়া লোক যদি তা পড়ে তবে আল্লাহ সে বিপদ দূর করে দেন। সেটি হচ্ছে- আমার ভাই (হজরত) ইউনুস (আলাইহিস সালাম)-এর দোয়া। তাহলো, ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বালিমিন।’
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত।’ -তিরমিজি
এ ছাড়া চিন্তা ও পেরেশানির সময় অন্য দোয়াও করা যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন