আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। এ মাসে তাঁর রহমত, বরকত ও মাগফিরাত
লাভে আমাদের সামনে বিরাট সুযোগ রয়েছে। এ মাসেই আমরা পবিত্র কুরআনকে পেয়েছি। আবার এ মাসেই আমরা বদরের সেই মহান যুদ্ধে, সেই সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী মহাসংগ্রামে বিজয় লাভ করেছি। প্রতি বছর এই রমজানে আমরা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি– সিয়ামকে পরিপূর্ণভাবে আদায় করার সুযোগ পাই। ঈমান আনার পর বাকি চারটি স্তম্ভের মধ্যে কেবল নামায ও রোযা সবাই পালন করতে পারেন। হজ্জ ও যাকাতের জন্য সামর্থ্য থাকতে হয়। তাই সেটা সবার জন্য ফরয নয়। এজন্য নানান দিক থেকেই এ মাসটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই গুরুত্বকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে রমজানের গুরুত্ব কমবে না ঠিক, কিন্তু আমাদের যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়।
হযরত আব হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, একবার রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে ওঠার সময় তিনবার বললেন, ‘আমিন’। তাঁকে বলা হল, ‘ইয়া রাসূলল্লাহ! আপনার তিনবার এভাবে আমিন বলার কারণ কী?’
তিনি বললেন, জিবরাঈল আমাকে বললেন, সেই বান্দার নাক ধুলোমলিন হোক, যে রমজান পেল কিন্তু
ক্ষমাপ্রাপ্ত হল না। তখন আমি বললাম, আমিন। তিনি এরপর বললেন, সেই বান্দার নাকও ধুলোমলিন
হোক, যার সামনে আপনার স্মরণ করা হল, কিন্তু সে আপনার ওপর দরূদ পড়ল না। আমি বললাম, আমিন। তিনি আবার বললেন, সেই বান্দার নাকও ধুলোমলিন হোক, যে নিজের পিতামাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল, কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। আমি বললাম, আমিন। (সহীহ ইবন হিব্বান, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, ইবন খুযায়মা)
উক্ত হাদীসসহ অসংখ্য হাদীসে পবিত্র রমজানের অকল্পনীয় গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়। তাই এই ত্রিশ অথবা ঊনত্রিশ দিন হেলায় হারানো ঠিক নয়। এ মাসে একজন মুমিনের কর্মপন্থা তাই নিম্নরূপ হওয়া উচিত–
১. ইখলাসের সাথে সবগুলো রোযা রাখা : যেকোন আমলের ক্ষেত্রে ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা মুখ্য। এজন্য রমজানের সবগুলো রোযা ইখলাসের সাথে রাখতে হবে। তবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে এবং নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভবতী হলে অথবা সফরে থাকলে আল্লাহ তায়ালা ইখতিয়ার দিয়েছেন। এছাড়া সর্বাবস্থায় রোযা রাখাই উত্তম। কারণ রমজানের একটি ফরয রোযা ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি আসলে সারা বছর নফল রোযা রাখলেও পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
نوقتت مكلعل مكلبق نم نيذلا ىلع بتك امك مايصلا مكيلع بتك اونمآ نيذلا اهيأ اي
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।” (সূরা বাকারা: ১৮৯)
২. জামায়াতের সাথে নামায আদায় : রমজানে অনেক রোযাদারকে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ে অলসতা করতে দেখা যায়। কেউ কেউ তারাবিহ পড়ে সাহরি খাওয়ার জন্য সারারাত জেগে থাকেন অথবা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। এরপর তন্দ্রাগ্রস্থ হয়ে ফজরের নামাযটিই কাজা করে ফেলেন। অথচ নামায ও রোযা উভয়টিই ইসলামের রোকন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
نيتناق لِل اوموقو ىطسولا ةلَصلاو تاولصلا ىلع اوظفاح
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াও।” (সূরা বাকারা: ১৮৯)
৩. কুরআনে কারিমকে আঁকড়ে ধরা : রমজান মাস প্রকৃতপক্ষে কুরআনের মাস। এই মাসেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
ناقرفلاو ىدهلا نم تانيبو سانلل ىده نآرقلا هيف لزنأ يذلا ناضمر رهش
“রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়ে মানুষের হিদায়েতের জন্য এবং হিদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানে জিবরাঈল (আ.) কে একবার পুরো কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাতেন। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ রমজানে তিনি দুবার তিলাওয়াত করে শুনিয়েছিলেন। এটা ছিল তাঁর আসন্ন বিদায়ের একটি ইঙ্গিত।
এজন্য সালাফে সালেহীন কুরআন চর্চার জন্য এ মাসটিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতেন। ইমাম মালিকের (র.) ব্যাপারে বর্ণিত আছে, রমজান মাস আসলেই তিনি অন্যান্য কিতাবাদি বন্ধ করে কুরআন নিয়ে মসজিদে বসে যেতেন। এ সময় তিনি কোন ফতোয়া দিতেন না, দরস দিতেন না, মাসআলামাসায়েল আলোচনা করতেন না। বলতেন, ‘এটা তো রমজান মাস, এটা তো কুরআনের মাস।’ রমজান মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা জারি থাকতো।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.) রমজান মাস আসলেই মসজিদে ঢুকে পড়তেন এবং তাসবীহ, তাহলীল, ইসতেগফারে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। যখনই অযু চলে যেত, দ্রুত আবার অযু করে নিতেন। খাওয়া, ঘুমানো ইত্যাদি অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি ছাড়া বাসায় যেতেন না।
ইমাম বুখারী প্রতি রমজানে ষাট বার কুরআন খতম দিতেন, রাতে এক খতম এবং দিনে এক খতম। অথচ আমাদের অনেকেই এক খতম কুরআন পড়ার সুযোগ হয় না।
এজন্য রমজানে আমাদেরকে যথাসম্ভব কুরআনকে আঁকড়ে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু তিলাওয়াতই যথেষ্ট নয়, বরং অর্থ বুঝে তিলাওয়াত করা এবং কুরআনের আদর্শ নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যারা হাফিজ হতে চান, এই মাস তাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। পৃথিবীতে বহু মানুষ এক মাসে হাফিজ হয়েছেন। তাই এটা আল্লাহর রহমতে অসম্ভব কিছ নয়।
৪. তারাবীহর নামায পড়া : তারাবীহর নামায আদায় করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। অনেককে তারাবীহ আট রাকায়াত নাকি বিশ রাকায়াত তা নিয়ে ঝগড়া করতে দেখা যায়। এরা মূলত ফিতনাবাজ। কারণ হযরত উমর (রা.) এর সময় থেকে সকলেই বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়ে আসছেন। এর উপর উম্মতের এক ধরনের ইজমাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মুসলিমদের প্রাণকেন্দ্র মক্কা ও মদীনায় ১৪০০ বছর ধরে এখনও বিশ রাকায়াত তারাবীহ প্রচলিত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ নামাযের ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন,
هبنذ نم مدقت ام هل رفغ اباستحاو اناميإ ناضمر ماق نم
“যে রমজানে ঈমান সহকারে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় (তারাবীহর) নামায পড়বে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
৫. তাহাজ্জুদের নামায পড়া : তাহাজ্জুদ নামাযের এত ফযিলত রয়েছে যে তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
ادومحم اماقم كبر كثعبي نأ ىسع كل ةلفان هب دجهتف ليللا نمو
“আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করুন, এটা আপনার জন্য অতিরিক্তি। আশা করা যায় আপনার রব আপনাকে প্রশংসিত স্থানে অধিষ্টিত করবেন।” (সূরা ইসরা: ৭৯)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজানের রোযার পর সবচেয়ে উত্তম হল আল্লাহর মাস মহররমের রোযা এবং ফরয সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো রাতের সালাত।” (মুসলিম)
৬. তাওবা নবায়ন ও ইসতেগফার করা : মহান আল্লাহর গাফফার, গাফুর, তাওয়াব ইত্যাদি নামের প্রকাশ ঘটে এই মাহে রমজানে। এজন্য জিবরাঈল (আ.) এর দুআ করেছেন– ‘রমজান মাস পেয়েও যে নিজের পাপ ক্ষমা করাতে পারল না, তার নাক ধুলোমলিন হোক।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দুআয় আমিন বলেছেন। তাই পাপের গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য এ এক বিরাট সুযোগ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
هبنذ نم مدقت ام هل رفغ اباستحاو اناميإ ناضمر ماص نم
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানে রোযা রাখবে, আমি তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবো।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে,
رانلا نم قتع هرخآو ،ةرفغم هطسوأو ،ةمحر ناضمر رهش لوأ
“রমজানের প্রথমভাগ রহমত, দ্বিতীয়ভাগ ক্ষমা ও তৃতীয়ভাগ জাহান্নাম থেকে মুক্তির।” (ইবন আসাকির, ইবন আবিদ দুনিয়া প্রমুখের বর্ণনা)
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
بنتجا اذإ نهنيب ام تارفكم ناضمر ىلإ ناضمرو ةعمجلا ىلإ ةعمجلاو سمخلا تاولصلا رئابكلا
“পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমআ থেকে আরেক জুমআ এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান এর মধ্যকার গুনাহসমূহের জন্য কাফফারা স্বরূপ, যখন কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।” (সহীহ মুসলিম)
রমজান সাধারণ ক্ষমার মাস, আমভাবে মুক্তির মাস। তাই আমাদেরকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
৭. দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে না কাটানো : সাহরির জন্য রোজাদারকে ফজরের অনেক আগে উঠতে হয়। এজন্য দিনের বেলাতে স্বাভাবিক নিয়মে তার কিছ ঘুমের প্রয়োজন, তা ঠিক। কিন্তু সেজন্য সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানো ঠিক নয়। এতে রমজানের আস্বাদ থেকে রোজাদার বঞ্চিত হয়। কেউ কেউ ফজর থেকে যুহর এবং যুহর থেকে আসর পর্যন্তই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। এতে দিনের বেলায় কোনো ইবাদত বন্দেগি করার সুযোগ হয় না।
৮. রোযার হাকিকত উপলব্ধি : রোযা আমাদেরকে ত্যাগের শিক্ষা দেয়। কিন্তু অনেককে দেখা যায় রমজানে প্রবৃত্তিপরায়নতা বাড়িয়ে দিতে। তারা রমজানে এত বেশি খান যা বছরের অন্যান্য সময়ে খাওয়া হয় না। কেউ আবার রোযা অবস্থায় বেশি খেতে পারবেন ভেবে একাই পাঁচজনের খাবার রান্না করেন, যা পরে ফেলে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কেউ কেউ ইফতারির নানা পদ যোগাড় করতে গিয়ে দিনের বেলায় ইবাদতের মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করে ফেলেন। অনেকে পরিবারের নারী সদস্যদের উপর বাড়তি রান্নাবান্নার বোঝা চাপিয়ে
দেন। একাধিক ইফতারির আইটেম তৈরি করতে গিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়টি তাদের রান্নাঘরে কাটিয়ে দিতে হয়, জায়নামাযে দাঁড়ানোর সুযোগ হয় না। অথচ রমজানের নিয়ামত হাসিল করা নারী পুরুষ সবার জন্যই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
৯. উমরা পালন : সামর্থ্য ও সুযোগ থাকলে রমজান মাসে উমরা পালন করা উচিত। এতে মাকবুল হজ্জের সওয়াব পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
ةجح ناضمر يف ةرمع نإف
“নিশ্চই রমজানের উমরা একটি হজ্জ।” (বুখারী)
অনেকেই শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে যাওয়ার নফল হজ্জ করার সুযোগ পান না। রমজানের এই সুযোগ তাদের কাজে লাগানো উচিত।
১০. যথাসম্ভব দান-সদকা করা : রাসূলুল্লাহ (সা.) সবসময় অত্যন্ত উদার ও দানশীল ছিলেন। কিন্তু রমজান আসলে তাঁর দানের পরিমাণ অত্যন্ত বেড়ে যেত। হাদীসে এসেছে, তখন ঝড়ো বাতাসের মতো দিনি দুহাতে মানুষকে দান করতে থাকতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
نوملظت لا متنأو مكيلإ فوي اللّ ليبس يف ءيش نم اوقفنت امو
“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যা ব্যয় করবে, তা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না।” (সূরা আনফাল: ৬০)
১১. ইতেকাফ করা : রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। (বুখারী)
এর ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত আছে। যেমন আঈশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
هبنذ نم مدقت ام هل رفغ اباستحاو اناميإ فكتعا نم
“যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় ইতেকাফ করবে, তার পূর্ববতী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (দায়লামী)
১২. শবে কদর অনুসন্ধান : শবে কদর অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। উম্মতে মুহাম্মদির জন্য শবে কদর এক বিরাট নেয়ামত। মহান আল্লাহ বলেন,
رهش فلأ نم ريخ ردقلا ةليل
“নিশ্চই লাইলাতুল কদর এক হাজার রাত্রির চেয়েও উত্তম।” (সূরা কদর: ৩)
এ মহিমান্বিত রাতটির গুরুত্ব বিবেচনা করে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং এ রাতটি অনুসন্ধানের জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,
ناضمر نم رخاولأا رشعلا يف ردقلا ةليل اورحت
“তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।” (বুখারী)
এই রাতটি ইবাদত-বন্দেগি ও দুআ-দরূদ পাঠের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করা উচিত। বিশেষ করে এই দুআ পড়া উচিত : ينع فعاف وفعلا بحت وفع كنإ مهللا অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাই আপনার প্রিয়। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (তিরমিযি)
১৩. ঈদের আগের রাতে ইবাদত করা : দু’ ঈদের রাতে জেগে জেগে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেয়ার বিরাট ফজিলত রয়েছে। সলফে সালেহীন এটাকে মুস্তাহাব মনে করতেন। ইমাম নববী বলেন, “দুই ঈদের রাত্রি জাগরণের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গীরা একমত।” (মাজমু)
এই রাতে বেশি বেশি তাওবা ইসতেগফার, সালাত, সালাম পাঠ করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীসে বলা হয়েছে
بولقلا تومت موي هبلق تمي مل ىحضلأا ةليلو رطفلا ةليل ايحأ نم
“দুই ঈদের রাত যে আল্লাহর প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় জেগে থাকবে, যেদন হৃদয়সমূহ মৃত্যুবরণ করবে, সেদিনও তার হৃদয় মরবে না।” (তাবরানী)
১৪. অন্য রোজাদারকে ইফতারি করানো : একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ হল অপরকে সালাম দেয়া এবং খাবার খাওয়ানো। রোযাদারকে খাওয়ানো আরও ফজিলতের বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে কোন রোযাদারকে খাওয়াবে, সে রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, রোযাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।” (তিরমিযি, ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান)
এজন্য রমজান মাসে একে অপরকে খাওয়ানোর ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করা উচিত। বিশেষ করে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, তারাও যেন রমজানের উসিলায় ভালো ভালো খাবার খেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা আল্লাহ তায়ালার রেযামন্দি হাসিলের এক বিরাট সুযোগ।
১৫. আগের রমজানের সাথে প্রতিযোগিতা করা : রমজানের নিয়ামত হাসিল করার জন্য আমাদের সালাফগণ যেভাবে পরিশ্রম করতেন, আমরা তার সিকিভাগ করতেও সক্ষম হই না। এজন্য রমজানে গতানুগতিক অভ্যাসের উপর নির্ভর করে বসে থাকা যাবে না। যার প্রতিদিন এক পারা কুরআন পড়ার অভ্যাস রয়েছে, তিনি চেষ্টা করবেন দু পারা পড়তে। অনুরূপ যার পাঁচ পারা পড়ার অভ্যাস আছে, তিনি দশ পারা পড়ার চেষ্টা করতে থাকবেন। এভাবে গোটা রমজান জুড়ে নিজের সাথে প্রতিযোগিতা করে যেতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে হবে এই রমজান যেন পূর্বের রমজানের চেয়েও উত্তম হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
نيقتملل تدعأ ضرلأاو تاوامسلا اهضرع ةنجو مكبر نم ةرفغم ىلإ اوعراسو
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমা হচ্ছে আসমান ও যমীন এবং যা প্রস্তুত করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩)
উপরে সূরা বাকার আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, রমজানে রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা তথা মুত্তাকী হওয়া। এজন্য রমজান জুড়ে প্রতিযোগিতায় আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমল করতে হবে।
১৬. রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো : রমজান মাসেও সারাদিন অবসর পাওয়া যায় না। অনেকের অফিস করতে হয়। নারীদেরকে রান্নাঘরে প্রচুর সময় ব্যায় করতে হয়। এ সময়টুকু যদি আল্লাহর যিকর করা, দরূদ শরীফ পড়া, কুরআনের মুখস্থ অংশের তিলাওয়াত করা অথবা তিলাওয়াত শোনার মধ্যে অতিবাহিত করা যায়, তাহলে সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে।
১৭. বাকি বছর রমজানের কর্মপন্থা চালু রাখা: রমজানে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ চলে। মাসব্যাপি সিয়াম সাধনা ও আত্মসংযমের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আসলে সারা বছর ভালোভাবে চলার অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব। এজন্য রমজানে ইবাদত-বন্দেগি ও আত্মসংযমের অভ্যাস সারা বছর জুড়ে চালু থাকলেই সিয়াম সাধনা পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
প্রতি বছর আল্লাহ তায়ালার রহমত, বরকত আর মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে রমজান আমার দুয়ারে কড়া নাড়ে। যে রমজান একবার গত হয়ে যায়, সেটা আর ফিরে পাবার উপায় নেই। ক্ষণস্থায়ী এই পার্থিব জীবনে আমরা আর কতটি রমজান পাবো তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আখিরাতের অনন্ত জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতে প্রতিটি রমজানকেই সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে অতিবাহিত করতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন